Home সারাদেশ ধর্ষক শরিফুজ্জামান মনি এখন ভয়ঙ্কর সাইবার সন্ত্রাসী!

ধর্ষক শরিফুজ্জামান মনি এখন ভয়ঙ্কর সাইবার সন্ত্রাসী!

114

স্টাফ রিপোর্টার: শরিফুজ্জামান মনি সিকদার, পিরোজপুর সদর উপজেলার শিকদার মল্লিক ইউনিয়নবাসীসহ অনেকের কাছে এক আতঙ্কের নাম। সে ওই ইউনিয়নের পাচপাড়া এলাকার হাবিবুর রহমান সিকদারের ছেলে। তার কর্মকাণ্ডে সবচেয়ে বেশি আতঙ্কে থাকতে হয় ওই এলাকার সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের তরুণী ও নারীদের। ছোটবেলা থেকে বিভিন্ন অপরাধ কর্মকাণ্ডের সাথে সম্পৃক্ত শরিফুজ্জামান মনি সিকদারের নেতৃত্বে এলাকায় রয়েছে মাদক ও অস্ত্র ব্যবসার ভয়াবহ এক সিন্ডিকেট।
তার বিরুদ্ধে ঢাকা, খুলনা ও পিরোজপুরে মাদক, অস্ত্র ব্যবসা, ধর্ষণ, নারীনির্যাতনসহ চাঁদাবাজির অভিযোগের পাশাপাশি বিভিন্ন মেয়ে ও নারীদের সাথে বিাভিন্ন কৌশলে বন্ধুত্ব ও সম্পর্ক স্থাপন করে প্রতারণার মাধ্যমে অর্থ হাতিয়ে নেয়ার অভিযোগ রয়েছে।
এসব ঘটনায় পিরোজপুরসহ দেশের বিভিন্ন থানায় মনি সিকদারের বিরুদ্ধে রয়েছে একাধিক মামলা। ২০০৪ সালে তার বিরুদ্ধে পিরোজপুর সদর থানায় দায়ের হওয়া একটি ধর্ষণ মামলায় মনি সিকদার যাবজ্জীবন কারাদণ্ডপ্রাপ্ত। ওই মামলাটি বর্তমানে উচ্চ আদালতে বিচারাধীন। এছাড়া উল্লিখিত মনি সিকদার ঢাকা ও পিরোজপুরে মাদক ব্যবসার পাশাপাশি বিভিন্ন নারীর সাথে ভয়াবহ প্রতারণা, অস্ত্র ও সাইবার সন্ত্রাসের মাধ্যমে অর্থ ও সম্পদ আত্মসাৎ করার অভিযোগ রয়েছে।
অপর একটি সূত্র জানায়, মনি সিকদার তার ঢাকাস্থ বাসায় গোপন ক্যামেরা বসিয়ে বিভিন্ন নারীর সাথে প্রেমের সম্পর্ক করে তাদেরকে বাসায় নিয়ে অন্তরঙ্গ মুহূর্তের ভিডিও ধারণ করে রাখে। পরে সেসব ভিডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে দেয়ার ভয় দেখিয়ে ওই সকল নারীর নিকট মোটা অঙ্কের চাঁদা আদায়সহ তাদের নানাভাবে হয়রানি করারও অভিযোগ রয়েছে তার বিরুদ্ধে।
সম্প্রতি প্রতারক মনি সিকদার রাজধানীর মোহাম্মদপুর এলাকার এক নারীর সাথে বোনের সম্পর্ক স্থাপন করে প্রতারণার মাধ্যমে ডিজিটাল প্রযুক্তি ব্যবহার করে ওই নারীর পারিবারিক ও ব্যক্তিগত ছবি ও ভিডিও ধারণ করে। পরে ওই ছবি ও ভিডিও সামাজিক মাধ্যমে ছড়িয়ে দেয়াসহ অস্ত্রের ভয়ভীতি দেখিয়ে ওই নারীর নিকট থেকে মোটা অঙ্কের চাঁদা আদায় করে। এ ঘটনায় ওই নারী বাদী হয়ে গত ২১ অক্টোবর মোহাম্মদপুর থানায় ডিজিটাল নিরাপত্তা ও চাঁদাবাজির অভিযোগে একটি মামলা দায়ের করেন। ওই মামলায় গোয়েন্দা পুলিশের হাতে গ্রেফতার হয়ে মনি সিকদার বর্তমানে জেলহাজতে রয়েছে।
ওই নারীর দায়ের করা মামলা সূত্রে জানা যায়, গত ২০২১ সালে পিরোজপুরে ওই নারীর সাথে মনি সিকদারের পরিচয় হয়। সুচতুর মনি সিকদার ওই নারীকে বোন ডেকে তার সাথে সুসম্পর্ক স্থাপন করে ভুক্তভোগী নারীর ঢাকার বাসায় আসা-যাওয়া করতো। এর ভিতরে ওই নারীর বাসায় ম্যানেজার, ড্রাইভার ও দারোয়ান প্রয়োজন হলে মনি সিকদার সুকৌশলে তার নিজস্ব লোক ওই বাসায় নিয়োগ দিয়ে দেয়।
একপর্যায়ে মনি সিকদার ওই নারীর বাসায় নিয়োগ দেয়া ম্যানেজার, ড্রাইভারের মাধ্যমে সুকৌশলে ওই নারীর শয়নকক্ষে গোপন ক্যামেরা স্থাপন করে ওই নারীসহ তার পরিবারের ব্যক্তিগত ছবি ও ভিডিও ধারণ করে নেয়। এরপর ধারণ করা ওই ভিডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে দেয়ার ভয় দেখিয়ে মোটা অঙ্কের টাকা হাতিয়ে নেয়। টাকা নেয়ার পরেও ভুক্তভোগী ওই নারীকে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে নানাভাবে হয়রানি ও ভয়ভীতি দেখানোর কারণে বাধ্য হয়ে ওই নারী মোহাম্মদপুর থানায় শরিফুজ্জামান মনি সিকদারের বিরুদ্ধে মামলা করেন।
এছাড়াও মনি সিকদারের ধর্ষণ, খুন, অস্ত্র ও মাদক ব্যবসাসহ নারীদের সাথে প্রতারণার চিত্র তুলে ধরে তার বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেয়ার দাবি করে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর একাধিক সেক্টরের প্রধান বরাবরে লিখিত অভিযোগ করেছেন পিরোজপুরের আফরোজা খাতুন নামে জনৈক নারী।
ওই নারীর অভিযোগ সূত্রে জানা যায়, বিগত ১৫-২০ বছর ধরে মনি সিকদার নিজ এলাকাসহ যশোর, খুলনা ও রাজধানীজুড়ে অস্ত্র, মাদক ব্যবসাসহ বিভিন্ন কৌশলে প্রতারণা করে আসছে। পাশাপাশি সে বিভিন্ন অসহায় নারীকে ব্ল্যাকমেইল করে অস্ত্রের মুখে ধর্ষণ, এমনকি নির্মমভাবে হত্যা করেছে। তার বিরুদ্ধে ধর্ষণ, মাদক ও অস্ত্রের একাধিক মামলা রয়েছে। একাধিকবার সে গ্রেফতারও হয়েছে। একটি ধর্ষণ মামলায় তার যাবজ্জীবন কারাদণ্ড হয়। ওই মামলায় সে হাইকোর্ট থেকে জামিনে বের হয়ে আরো বেপরোয়া হয়ে ওঠে। একপর্যায়ে মনি ও তার লোকজনের হুমকিতে প্রাণের ভয়ে ওই মামলার ভিকটিম সপরিবারের ভারতে চলে যেতে বাধ্য হয়। মনি সিকদারের বিরুদ্ধে তার এলাকার সংখ্যালঘু তিন নারীকে ধর্ষণের পর হত্যার অভিযোগ রয়েছে বলেও ওই নারীর আবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে।
অনুসন্ধানে জানা যায়, ২০০৪ সালে গীতা রানী নামে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের এক নারীকে ধর্ষণের অভিযোগে মনি সিকদারসহ পাঁচজনের বিরুদ্ধে পিরোজপুর সদর থানায় নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনের ৯ (১) ধারায় মামলা রুজু হয়।
ওই মামলায় দোষীসাব্যস্ত করে ২০০৫ সালের ৬ সেপ্টেম্বর পিরোজপুর নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালের বিচারক মিয়া মো. শরীফ হোসেন মনি সিকদারসহ ৪ জনকে সশ্রম যাবজ্জীবন কারাদণ্ড প্রদান করেন।
এছাড়া মনি সিকদারের বিরুদ্ধে রাজধানীর যাত্রাবাড়ী থানায় মামলা নং-৫৩, তাং ১৫/০৭/২০১৩ইং, ধারা- মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইনের ১৯ (১)-এর ৯(খ)। পিরোজপুর সদর থানার মামলা নং-২৫, তারিখ-৩১/৭/২০১৬ইং, ধারা- মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইনের ১৯ (১)-এর ৯(খ)। পিরোজপুর সদর থানার মামলা নং-২৩, তারিখ-১৫/৯/২০১০ইং, ধারা-১৪৩/৩২৩/৩২৪/৩২৬/৩০৭/৪২৭/৩৮০ পেনাল কোড। পিরোজপুর সদর থানার মামলা নং-১৬, তারিখ-১৩/৯/২০১০ইং, ধারা- নারী ও শিশুনির্যাতন দমন আইন (সংশোধনী ২০০৩) ১০-সহ ৩২৩/৩২৫/৩৮০/৪২৭ পেনাল কোড। পিরোজপুর সদর থানার মামলা নং-২০, তারিখ-১৯/৩/২০২১ইং, ধারা-১৪৩/৩৪১/৩২৩/৩২৫/৩০৭/৪২৭/৩৭৯/৫০৬ পেনাল কোড। রাজধানীর শ্যামপুর থানার মামলা নং-২৪, তারিখ-২০/১১/২০১৭ইং, ধারা- মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইনের ১৯ (১)-এর ৯(খ)/২৫। পিরোজপুর সদর থানার মামলা নং-০৮, তারিখ-০৭/১০/২০১৬ইং, ধারা-৪৪৭/৩২৩/৩২৬/৩৭৯/৩০৭/৪২৭/৫০৬ পেনাল কোড। পিরোজপুর সদর থানার মামলা নং-০৬, তারিখ-০৬/২/২০১৫ইং, ধারা-৩৭৯/৪৪৭/৩২৩/৩৫৪/৫০৬ পেনাল কোড।
মনি সিকদারের কর্মকাণ্ডের বিষয়ে খোঁজখবর নিতে তার নিজ এলাকার সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের কয়েকজনের সাথে কথা হয় এ প্রতিবেদকের। তারা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, তাদের সম্প্রদায়ের একাধিক মেয়ে ও গৃহবধূ মনি সিকদার ও তাদের বাহিনীর সদস্যদের দ্বারা নির্যাতন ও ধর্ষণের শিকার হয়েছে। শুধুমাত্র গীতা রানীর ঘটনায় একটি মামলা হলেও জামিনে এসে তাদের হুমকিতে গীতাসহ তার পরিবার দেশ ছাড়তে বাধ্য হয়েছে। এ কারণে নানা অভিযোগ থাকার পরেও প্রাণের ভয়ে কেউ তাদের বিরুদ্ধে মামলা করা বা প্রকাশ্যে কথা বলার সাহস পায় না।
এছাড়া মনি এলাকায় অস্ত্র ও মাদক ব্যবসার পাশাপাশি চাঁদাবাজি এবং সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ওপর নানাভাবে নির্যাতন করতো বলে জানান কয়েকজন।
পিরোজপুর সদর উপজেলা পরিষদের ভাইস চেয়ারম্যান ও পিরোজপুর সোহরাওয়ার্দী কলেজের সাবেক ভিপি এসএম বায়েজিদ জানান, মনি সিকদার ও তার বাহিনীর নানা অত্যাচার-নির্যাতনে অতীষ্ঠ ওই এলাকার সাধারণ মানুষ। বিশেষ করে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের লোকজন তার দ্বারা বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এলাকায় নারীনির্যাতন, ধর্ষণ, মাদক ও অস্ত্র ব্যবসাসহ বিভিন্ন অপরাধ করে আসছে তারা। এসব ঘটনায় তার বিরুদ্ধে একাধিক মামলাও রয়েছে।