Home জাতীয় দেশের অধিকাংশ ওষুধের মান যুগোপযোগী নয়

দেশের অধিকাংশ ওষুধের মান যুগোপযোগী নয়

33

ডেস্ক রিপোর্ট: দেশের অধিকাংশ ওষুধের মান যুগোপযোগী নয়। বিশ্বের অন্যান্য দেশে প্রতিবছর হালনাগাদ হচ্ছে ওষুধের মান। কিন্তু বাংলাদেশে একই মানের ওষুধ চলছে যুগের পর যুগ। এছাড়া ওষুধের কোল্ড চেইন মানা হচ্ছে না। অর্থাৎ একটা নির্দিষ্ট তাপমাত্রায় ওষুধগুলো রাখতে হয়। অর্থাৎ শীতাতপ নিয়ন্ত্রণ কক্ষে ওষুধ রাখা জরুরি। কিন্তু দেশের ৯৯ ভাগ ফার্মেসীতে নেই শীতাতপ নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা। এতে ওষুধের গুণগত মান নষ্ট হচ্ছে। আর রোগীর রোগ সারাতে বারবার ওষুধ পরিবর্তন করতে হচ্ছে। এতে বাড়ছে চিকিৎসা ব্যয় ও পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া। রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা হারাচ্ছে অনেকে।

২০১০ সালে সরকারের পক্ষ থেকে ‘ওষুধ কোম্পানি জিএমপি সক্ষমতা যাচাই বিষয়ক পরিদর্শন কমিটি’ গঠন করা হয়েছে। এই কমিটির টিম লিডার হলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বায়োকেমিস্টি রিসার্চ সেন্টারের পরিচালক ও ওষুধ প্রযুক্তি বিভাগের সাবেক অধ্যাপক আ ব ম ফারুক। বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের ফার্মেসী বিভাগের অধ্যাপকরা এই কমিটির সদস্য। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার গাইডলাইন অনুযায়ী ওষুধ তৈরি করছে কিনা তা যাচাই করতে কমিটির কাছে ওষুধ প্রশাসন অধিদপ্তরের পক্ষ থেকে ২৪৮টি ওষুধ কোম্পানির তালিকা দেওয়া হয়। তবে ২৪৮টি ওষুধ কোম্পানির মধ্যে ৫৫ কোম্পানির নাম ঠিকানা খুঁজে পায়নি ওষুধ কোম্পানি জিএমপি সক্ষমতা যাচাই বিষয়ক পরিদর্শন কমিটি। অর্থাৎ কাজীর গরু কেতাবে আছে, গোয়ালে নাই। কমিটি শুধু ১৯৩টি কোম্পানির হদিস পেয়েছে। ওষুধ কোম্পানির সংখ্যা আরো বেড়েছে। যেসব কোম্পানির নাম-ঠিকানা খুঁজে পাওয়া যায়নি, তারা মূলত লাইসেন্স নিয়ে বিদেশ থেকে কাঁচামাল আমদানি করে। সেইসব কাঁচামাল মিডফোর্ড ও চট্টগ্রামের খাতুনগঞ্জসহ বিভিন্ন এলাকায় বিক্রি করে থাকে। এসব কোম্পানি নকল ও ভেজাল ওষুধ উৎপাদন করে তারা বাজারজাত করে আসছে। এসব কোম্পানির তৈরী ওষুধের মধ্যে আটা, ময়দার গুড়াও পাওয়া গেছে। সাধারণত এসকল কোম্পানির নিম্ন ও ভেজাল ওষুধ গ্রামাঞ্চলে সর্বাধিক বিক্রয় হয়ে থাকে। এগুলো দেখার কেউ নাই।

তবে ২৪৮টি ওষুধ কোম্পানির মধ্যে ২০টি কোম্পানির ওষুধ মান আন্তর্জাতিক মানের। এই ২০টি কোম্পানির ওষুধের মান নিয়ন্ত্রণে নিজস্ব ব্যবস্থা রয়েছে। তারা বিশ্বের শতাধিক দেশে ওষুধ রপ্তানি করে। তবে ভেজাল ও নিম্নমানের ওষুধ তৈরি করার জন্য ৭২টি ওষুধ কোম্পানির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার সুপারিশ করেছে ওষুধ কোম্পানির জিএমপি সক্ষমতা যাচাই বিষয়ক পরির্দশন কমিটি। কিন্তু এখনো পর্যন্ত ২/১টি ছাড়া অন্য কারো বিরুদ্ধে কোন ধরনের ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়নি।

ওষুধ উৎপাদনের পর তা বিক্রি করা হয় ফার্মেসীর দোকান থেকে। রাজধানী ও বিভাগীয় শহরে কিছু সংখ্যক ফার্মেসীতে কোল্ড চেইন মানা হলেও অধিকাংশ ফার্মেসীতে তা মানা হচ্ছে না। বিশেষজ্ঞরা বলেন, ওষুধ একটি কেমিক্যাল সংমিশ্রণে তৈরি। এ কারণে নির্ধারিত তাপমাত্রায় ওষুধ রাখতে হয়। নইলে ওষুধ নষ্ট হয়ে যাবে। কিন্তু ৯৯ ভাগ ফার্মেসিই এক্ষেত্রে উপযুক্ত নয়। তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণের ব্যবস্থা না রেখেই ওষুধ সংরক্ষণ ও বিক্রি করছে তারা। এতে নষ্ট হচ্ছে ওষুধের গুণাগুণ। ওষুধ সংরক্ষণে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) সুনির্দিষ্ট নীতিমালা থাকলেও বাংলাদেশে তা মানা হচ্ছে না। নীতিমালায় সংরক্ষণ কক্ষের আদ্রতা ৬০ শতাংশের নিচে রাখার কথা বলা হয়েছে। ক্ষেত্রবিশেষ সংরক্ষণ কক্ষে শীতাতপ নিয়ন্ত্রণ যন্ত্র থাকার কথাও বলা হয়েছে নীতিমালায়। তাপমাত্রা সহনীয় পর্যায়ে আছে কিনা, সেজন্য কক্ষের একাধিক স্থানে থার্মোমিটার রাখার কথা বলা হয়েছে। সর্বোপরি কক্ষের আয়তনভেদে রাখতে হবে এক বা একাধিক রেফ্রিজারেটর ও ফ্রিজার। এ থেকে উৎপাদিত তাপ বের করে দেয়ার জন্য ব্যবস্থা করতে হবে একাধিক এগজস্ট ফ্যানের। সরেজমিনে দেখা গেছে, রাজধানীসহ দেশের বড় শহরগুলোর অনেক ফার্মেসিরও ওষুধ সংরক্ষণে উপযুক্ত ব্যবস্থা নেই। ফ্রিজার ছাড়াই ওষুধ বিক্রি করছে এসব এলাকার অধিকাংশ ফার্মেসি। বিশেষ করে গ্রামাঞ্চলের পরিস্থিতি আরো ভয়াবহ। অনেকে টিনের ঘরে ওষুধ বিক্রি করছে।

অন্যান্য দেশে যে কোন ওষুধ চিকিৎসকের প্রেসক্রিপশন ছাড়া বিক্রি সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। কিন্তু বাংলাদেশে পাড়া- মহল্লার মুদি দোকান থেকে শুরু করে গ্রাম-গঞ্জের হাটবাজারে ব্যাঙের ছাতার মতো গজিয়ে ওঠা হাজার হাজার ফার্মেসিতে সব ধরনের ওষুধ প্রেসক্রিপশন ছাড়া অবাধে বিক্রি হচ্ছে। ২০১৯ সালে ঢাকা শহরের বাসিন্দাদের ওপর কয়েকটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ফার্মেসি ও জনস্বাস্থ্য বিভাগের চালানো একটি গবেষণায় দেখা গেছে, ৪৭ শতাংশের বেশি নাগরিক ডাক্তারের প্রেসক্রিপশন ছাড়া নিজেরা দোকান থেকে ওষুধ কিনে খেয়ে থাকেন।

এদিকে ভেজাল ও নিম্নমানের ওষুধ বাজার ছয়লাব। কোনটা ভাল আর কোনটা খারাপ তা যাচাই করার সুযোগ নেই। বর্তমানে দেশে ৬২টি কোম্পানির প্যারাসিটামল বিক্রি করছে। একেকটা একেক মানের। আবার কিছু কোম্পানির প্যারাসিটামল খেলে কোন কাজই হয় না। দেশে ওষুধ নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা খুবই দুর্বল। হাঙ্গেরিতে উৎপাদন করে মাত্র ৬টি কোম্পানি। কিন্তু কোন কোম্পানি একটি ওষুধ উৎপাদন করলে, আরেকটি কোম্পানি সেই গ্রুপের ওষুধ উৎপাদন করতে পারে না। ওই দেশে ওষুধের মান নিয়ন্ত্রণে রয়েছে শক্তিশালী ব্যবস্থা। শুধু হাঙ্গেরি নয়, বিশ্বের অনেক দেশেই ওষুধের মান নিয়ন্ত্রণের শক্তিশালী মনিটরিং ব্যবস্থা রয়েছে। পাশাপাশি রয়েছে ভেজাল ওষুধ উৎপাদনের সঙ্গে জড়িত ব্যক্তির জন্য সবো‌র্চ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ড। ব্যতিক্রম শুধু বাংলাদেশ। সম্প্রতি ভেজাল প্যারাসিটামল সিরাপ সেবন করে ৫ শতাধিক শিশু মারা গেছে। গুরুতর অসুস্থ হয়েছে সহস্ত্রাধিক শিশু। কিন্তু এ ঘটনারও তেমন কোন শাস্তি হয়নি। এই কারণে এই দেশে ভেজাল ও নকল ওষুধে বাজার সয়লাব।

এর পেছনে আছে নানা কারণ। যারা নিয়ন্ত্রণ করবে তারা যদি সে বিষয়ে বিশেষজ্ঞ নয়, তাদের সেখানেই বসানো হয়েছে। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৭৪ সালে এক নির্দেশনা দিয়েছিলেন যে, ড্রাগ এডমিনিস্ট্রেশন, শিল্পকলা একাডেমী, বাংলা একাডেমী, জাতীয় যাদুঘর, রেডিও টিভি-এসব ক্ষেত্রে যারা সংশ্লিষ্ট বিষয়ে বিশেষজ্ঞ শুধু তাদের দিয়েই পরিচালনা করতে হবে। ওই সময় ওষুধ প্রশাসনের দায়িত্বে ছিলেন চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজের ফার্মাকোলজী বিভাগের অধ্যাপক ডা. হুমায়ুন হাই। বর্তমানে ওষুধ প্রশাসনে হ-য-ব-র-ল অবস্থা। লোকবলেরও অভাব। সেখানে সংশ্লিষ্ট বিষয়ে বিশেষজ্ঞের অভাব রয়েছে।

ইত্তেফাকের এই প্রতিনিধি সম্প্রতি থাইল্যান্ড সফরকালে বামরুনগ্রাদ ইন্টারন্যাশনাল হাসপাতাল ও ব্যাংকক জেনারেল হাসপাতালের অর্ধ শতাধিক চিকিৎসক ও রোগীদের সঙ্গে কথা বলেন। রোগীরা ওই দেশের চিকিৎসা সেবা ও ওষুধের মানে সন্তুষ্ট। চিকিৎসকরা বলেন, বাংলাদেশে আন্তর্জাতিক মানের অনেক চিকিৎসক আছেন। এ সময় চিকিৎসকরা অধ্যাপক ডা. এবিএম আব্দুল্লাহ, অধ্যাপক ডা. কাজী দীন মোহাম্মদ, অধ্যাপক ডা. হারুনুর রশীদ ও অধ্যাপক ডা. রাজিউল ইসলামের নাম উল্লেখ করেন। বামরুনগ্রাদ ইন্টারন্যাশনাল হাসপাতাল ও ব্যাংকক জেনারেল হাসপাতালের একাধিক চিকিৎসক বলেন, বাংলাদেশে আন্তর্জাতিক মানের চিকিৎসক থাকলেও ওষুধের মান নিয়ে প্রশ্ন আছে। ওই দেশের ওষুধ খেয়ে রোগীরা ভাল হচ্ছে না, অথচ একই ওষুধ থাইল্যান্ডে খেয়ে অনেক ভাল হয়ে যাচ্ছেন। এছাড়া রোগ নির্ণয়ে কিছু কিছু প্রযুক্তিতে বাংলাদেশ পিছিয়ে আছে।

এদিকে বাংলাদেশে এক শ্রেণীর চিকিৎসক কমিশন খেয়ে যেসব কোম্পানি ভেজাল ও নিম্নমানের ওষুধ তৈরি করে প্রেসক্রিপশনে সেসব ওষুধ দেন। এতে রোগীর রোগ তো ভালই হয়, উল্টো নানা পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া দেখা দয়। মিডফোর্ডসহ রাজধানীর আশেপাশে ও দেশের বিভিন্ন স্থানে এক শ্রেণীর ওষুধ বিক্রেতা আছেন, তারা নিজেরাই ওষুধ তৈরি করে বাজারের সরবরাহ করে আসছেন। অতি সম্প্রতি ওষুধ প্রশাসন ও র‍্যাব পুলিশের হাতেও অনেকে ধরা পড়েছেন।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বায়োকেমিস্টি রিসার্চ সেন্টারের পরিচালক ও ওষুধ প্রযুক্তি বিভাগের সাবেক অধ্যাপক আ ব ম ফারুক বলেন, ওষুধ সংরক্ষণে কোল্ড চেইন মানছে না দেশের অধিকাংশ ফার্মেসী। এতে ওষুধের গুণগত মান নষ্ট হচ্ছে। ওষুধকে অবশ্যই নিদিষ্ট তাপমাত্রায় রাখতে হবে। ওষুধ বিক্রি ও সংরক্ষণের দায়িত্বে থাকতে হবে শিক্ষিত ফার্মাসিস্ট। তারাই ওষুধের মান নিয়ন্ত্রণে অভিজ্ঞ। কিন্তু এক্ষেত্রে তারা চিকিৎসকের ব্যবস্থাপত্র অনুযায়ী ওষুধ বিক্রি করবেন এবং সেবনের পরামর্শও দেবেন। এক্ষেত্রই নকল ও ভেজাল ওষুধ বিক্রিও কমে যাবে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ওষুধ প্রযুক্তি বিভাগের অধ্যাপক ডা. এ কে লুত্ফুল কবীর বলেন, ওষুধ একটি নির্দিষ্ট তামপাত্রায় ও পরিবেশে রাখতে হয়। কিন্তু তা মানা হচ্ছে না। সরকারি অনেক হেলথ কমপ্লেক্সেও কোল্ড চেইন ব্যবস্থা নেই। তিনি বলেন, ওষুধ রাসায়নিক পদার্থ। তার নিজস্ব বৈশিষ্ট্য আছে। নির্দিষ্ট তাপমাত্রায় ওষুধ না রাখলে তার গুণগত মান নষ্ট হবে।

১০ জন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক বলেন, ভেজাল ও নিম্নমানের ওষুধে রোগীর রোগ ভাল তো হবেই না, উল্টো এসব ওষুধ সেবন করে অনেক রোগীর অঙ্গহানিসহ প্রাণহানির ঘটনাও ঘটছে। মান নিয়ন্ত্রণের ব্যবস্থা জোরদাড় করতে হবে। ভেজাল ও নকল ওষুধ উৎপাদনকারীদের বিরুদ্ধে মৃত্যুদন্ডসহ কঠোর শাস্তির ব্যবস্থা রাখতে হবে। তাহলে ওষুধের মান নিয়ন্ত্রণ সম্ভব বলে বিশেষজ্ঞরা অভিমত দেন। উন্নত মানের ওষুধ উৎপাদনকারী দুটি কোম্পানির প্রধানগণ ইত্তেফাককে বলেন, কিছু কোম্পানি নিম্নমানের কাঁচামাল ক্রয় করে বিক্রি করেন এবং ওষুধ উৎপাদন করেন। তারা নকল ও ভেজাল নিম্নমানের ওষুধ বিক্রয়ের ক্ষেত্রে এক শ্রেণীর চিকিৎসকদের কমিশনসহ নানা উপহার দিয়ে থাকেন। তবে ২০ টি কোম্পানি সততা ও নিষ্ঠার সাথে আন্তর্জাতিক মানের ওষুধ উৎপাদন করছে এবং বিদেশেও ওষুধ রপ্তানিও করছে। আগামী পাঁচ বছরের মধ্যে বিশাল অবদান রাখবে দেশের এই সকল ওষুধ শিল্প।-ইত্তেফাক