Home খেলা দুই দশকে হারিয়েছে ঢাকার প্রায় অর্ধশত মাঠ

দুই দশকে হারিয়েছে ঢাকার প্রায় অর্ধশত মাঠ

63

ডেস্ক রিপোর্ট: চলতি শতকের শুরুতেও রাজধানী ঢাকায় সিটি করপোরেশনের অধীন খেলার মাঠ ছিল ৭০টির মতো। এখন দুই সিটি করপোরেশনের তত্ত্বাবধানে টিকে রয়েছে মোটে ২০টি। এ দুই দশকে নিশ্চিহ্ন হয়েছে প্রায় অর্ধশত মাঠ। যেগুলো টিকে রয়েছে খেলাধুলার স্বাস্থ্যসম্মত পরিবেশ হারিয়ে ফেলছে সেগুলোও। মাঠ বেদখল হয়ে যাওয়ার অভিযোগ উঠছে প্রায়ই। আবার নানা স্থাপনা নির্মাণের মাধ্যমে মাঠে খেলার জায়গা সংকুচিত করে ফেলার নিদর্শনও পাওয়া যায় অনেক।

একটি শহরে পর্যাপ্তসংখ্যক মাঠের উপস্থিতিকে অত্যাবশ্যক বলে মনে করেন নগর পরিকল্পনাবিদরা। নগরবাসীর নির্মল বিনোদন, সুস্থ পরিবেশ ও শিশু-কিশোরদের মানসিক বিকাশ নিশ্চিতের জন্য বিষয়টিতে সবসময়ই জোর দেয়া হয়। গত কয়েক দশকে ঢাকা আয়তন ও জনসংখ্যায় বাড়লেও খেলার মাঠ হারিয়ে গিয়েছে একটির পর একটি।

ঢাকার অবিভক্ত সিটি করপোরেশনের তথ্য অনুযায়ী, চলতি শতকের শুরুতেও নগর কর্তৃপক্ষের অধীন মাঠ ছিল ৬৮টি। অন্যদিকে রাজধানীতে বর্তমানে দুই সিটি করপোরেশনের নিয়ন্ত্রণাধীন মাঠ আছে ২০টি। সে হিসাবে দুই দশকে রাজধানীর বুক থেকে নিশ্চিহ্ন হয়েছে অন্তত ৪৮টি মাঠ। এর মধ্যে কোনো কোনোটিকে এখন পার্কে রূপ দেয়া হয়েছে।

চলতি শতকের শুরুতেই রাজধানীর খেলার মাঠগুলো বেদখল হয়ে যাওয়ার বিষয়টি বড় উদ্বেগের কারণ হয়ে ওঠে। ২০০৩ সালে রাজধানীর খেলার মাঠ ও পার্ক বেদখলের বিরুদ্ধে হাইকোর্টে একটি রিট করেছিল বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতি (বেলা)। বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনের (বাপা) পক্ষ থেকে ২০০৪ সালে একই বিষয়ে আরেকটি রিট হয়। এ দুই রিটের পরিপ্রেক্ষিতে রাজধানীর ৬৮টি খেলার মাঠ ও পার্কের জন্য সংরক্ষিত জায়গা ১৫ দিনের মধ্যে দখলমুক্ত করার নির্দেশ দেন হাইকোর্ট। এ আদেশ যথাযথভাবে পালনে গত দুই দশকে কোনো অগ্রগতি লক্ষ করা যায়নি। বরং দিন দিন পরিস্থিতির অবনতি ঘটেছে। একের পর এক মাঠ বেদখল হয়ে নির্মাণ হচ্ছে বাজার, রাজনৈতিক দলের কার্যালয়সহ নানা ধরনের স্থাপনা। কোনো কোনো মাঠে উন্মুক্ত জায়গা থাকলেও খেলার পরিবেশ নেই। এসব জায়গায় মাদক ব্যবসাসহ আরো নানা ধরনের অপরাধমূলক কার্যক্রমেরও অভিযোগ পাওয়া যায়।

এ বিষয়ে বেলার প্রধান নির্বাহী সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান বলেন, তখন আমরা শুধু ঢাকা সিটি করপোরেশনের অন্তর্ভুক্ত মাঠগুলো নিয়ে রিট করেছিলাম। আদালত মাঠ ও পার্ক দখলমুক্ত করতে বলেছেন। কিন্তু তার বাস্তবায়ন খুব একটা দেখা যাচ্ছে না।

তবে ঢাকার সব মাঠই সিটি করপোরেশনের তত্ত্বাবধানে নেই। দুই সিটির অধীন মাঠ ছাড়াও ঢাকায় আরো অন্তত ২০০ খোলা জায়গার তথ্য পাওয়া যায়, যেগুলোকে মাঠ হিসেবে ব্যবহার করা হয়। ২০১৯ সালে করা বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্সের (বিআইপি) জরিপে উঠে আসে, কয়েক বছর আগেও ঢাকায় মাঠের সংখ্যা ছিল ২৩০। এর মধ্যে ১৪০টি প্রাতিষ্ঠানিক মাঠ, যেগুলো ওই প্রতিষ্ঠানের কম্পাউন্ডের ভেতরে অবস্থিত। অর্ধশতাধিক জায়গা ছিল ব্যক্তিমালিকানাধীন। এসব খোলা জায়গা শিশুরা মাঠ হিসেবে ব্যবহার করত। পরে সেসব জায়গায় অট্টালিকা গড়ে ওঠে। ৪০টির মতো মাঠ ছিল সবার জন্য উন্মুক্ত। এর মধ্যে আবার ১৬টি বেদখল হয়ে পড়েছে। ফলে এখন রাজধানীতে সিটি করপোরেশনের আওতাধীন ও আওতাবহির্ভূত উন্মুক্ত মাঠ আছে মাত্র ২৪টি। এর মধ্যে কিছু খেলার মাঠ সংস্কার করায় সেগুলোর সৌন্দর্য বেড়েছে ঠিকই, কিন্তু সেসব মাঠে প্রবেশে সীমাবদ্ধতা তৈরি হয়েছে।

এদিকে ২০০০ সালের একটি জরিপে দেখা যায়, ওই সময় ঢাকা শহরে খেলার মাঠ ছিল ১৫০টি। যদিও ঢাকার মাঠ নিয়ে সরকারি কোনো পরিসংখ্যান পাওয়া যায়নি।

রাজধানীর ঐতিহ্যবাহী খেলার মাঠগুলোর অন্যতম গেন্ডারিয়ার ধূপখোলা মাঠ। বর্তমানে এটির উন্নয়ন কার্যক্রম চলছে। মাঠটিতে চলছে স্থাপনা নির্মাণের কাজ। নির্মাণসামগ্রী রাখায় মাঠের বড় একটি অংশ এখন খেলার অনুপযোগী হয়ে পড়েছে।

এ নিয়ে ধূপখোলা মাঠে কথা হয় গেন্ডারিয়ার প্রবীণ বাসিন্দা হাসান মাহমুদের (৬০) সঙ্গে। শৈশবের স্মৃতিচারণ করে তিনি বলেন, একসময় এখানে দুরন্তপনার ছড়াছড়ি ছিল। সকাল থেকে শুরু হয়ে দিনের আলো মিলিয়ে না যাওয়া পর্যন্ত খেলতাম আমরা। আট-দশ বছর আগেও এখানে শিশু-কিশোরদের স্বতঃস্ফূর্ত আনাগোনা ছিল। সম্প্রতি মাঠ উন্নয়নের কাজ শুরু হওয়ার পর নির্মাণসামগ্রী রাখায় খেলার পরিবেশ নষ্ট হয়ে গেছে। কয়েক মাস হলো খেলাধুলা বন্ধ।

সিটি করপোরেশনের খেলার মাঠগুলোর মধ্যে ১২টি ঢাকা দক্ষিণ সিটির অধীনে। ঢাকা উত্তরের অধীনে রয়েছে আটটি। ঢাকা দক্ষিণের ১২টি মাঠ হলো বাংলাদেশ মাঠ, গোলাপবাগ মাঠ, মুক্তিযোদ্ধা সাদেক হোসেন খোকা মাঠ, লালবাগ শ্মশানঘাট খেলার মাঠ, খিলগাঁও খেলার মাঠ, ধানমন্ডি খেলার মাঠ, কলাবাগান খেলার মাঠ, মরহুম হাজি আলী ঈদগাহ মাঠ, বালুর মাঠ ঈদগাহ মাঠ, আরমানিটোলা খেলার মাঠ, ধূপখোলা মাঠ ও জোড়াপুকুর খেলার মাঠ। ঢাকা উত্তর সিটির আটটি খেলার মাঠ হলো বনানী মাঠ, বনানী খেলার মাঠ, বড় মগবাজার খেলার মাঠ, গোলার টেক মাঠ, তাজমহল রোড মাঠ, জাকির হোসেন রোড খেলার মাঠ, সলিমুল্লাহ রোড খেলার মাঠ ও বৈশাখী খেলার মাঠ।

নগরবিদ ইকবাল হাবিব বলেন, দুই সিটির মাঠের সংখ্যা কমে যাওয়ার বড় একটি কারণ হলো এখন অনেক মাঠই পার্ক ও মাঠে রূপান্তরিত হয়েছে। সে হিসেবে দুই সিটিতে মাঠ ও পার্ক আছে ৪৯টি। মাঠ ও পার্ককে এক ধরে নিয়েই দুই সিটির উন্নয়ন কার্যক্রম এগোচ্ছে। তবে বর্তমানে যে কাজটি জরুরি, বিদ্যমান মাঠগুলোয় খেলার পরিবেশ যেন ব্যাহত না হয় সেদিকে খেয়াল রাখা।

তিনি বলেন, ঢাকায় মাঠের সংখ্যা আরো বাড়বে। এক্ষেত্রে দুই সিটির আওতায় নতুন যে পৌরসভাগুলো এসেছে, ওইসব পৌরসভার মাঠগুলোও চিহ্নিত করতে হবে। নতুন পৌরসভাগুলোয় দেখা যায় অনেক খোলা জায়গা আছে। সেখানে শিশুরা খেলছেও। কিন্তু এর অনেকগুলোই মাঠ হিসেবে চিহ্নিত নয়। কোনো জায়গা যদি মাঠ হিসেবে চিহ্নিত না হয় তাহলে সেটি যেকোনো মুহূর্তেই ভিন্ন কাজে ব্যবহার হতে পারে। বর্তমানে কোনো মাঠ দখল হলে আমরা মাঠ রক্ষায় আন্দোলন করতে পারছি, কারণ এগুলো মাঠ হিসেবে চিহ্নিত আছে। যদি মাঠটি সিটি করপোরেশন কর্তৃপক্ষের রেজিস্ট্রি করা না থাকে তাহলে ওই মাঠ আজ হোক কাল হোক অন্য কাজে ব্যবহার হবেই।

রাজধানীর টিকে থাকা মাঠগুলোও দখলের ঝুঁকিতে রয়েছে। আবার অনেক মাঠের মালিকানা নিয়ে দ্বন্দ্বও রয়েছে। ডিএসসিসি এলাকাধীন আলিয়া মাদ্রাসার মাঠটি সরকারি দুটি সংস্থা নিজেদের বলে দাবি করছে। একইভাবে ১১ নম্বর ওয়ার্ডের একটি খোলা জায়গায় সরকারি আরেকটি সংস্থা ভবন নির্মাণ করেছে। ১৩ নম্বর ওয়ার্ডের মুক্তাঙ্গনের মাঠটি ডিএসসিসির প্রশাসন দখলমুক্ত করার পরও বারবার দখল হয়ে যাচ্ছে।

সার্বিক বিষয়ে জানতে চাইলে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা ফরিদ আহাম্মদ বলেন, আমাদের তালিকাভুক্ত কোনো মাঠ হারিয়ে যায়নি এবং বেদখলও নেই। এরই মধ্যে আমরা বেশ কয়েকটি মাঠের উন্নয়নকাজ শেষ করেছি। আরো কয়েকটি মাঠের কাজ চলমান রয়েছে। তাছাড়া নতুন নতুন মাঠ তৈরির ব্যাপারেও আমাদের সমন্বিত পরিকল্পনা চলছে।-আমাদের সময়.কম