Home মতামত তালেবানি উত্থান: বিষবৃক্ষ থেকে অমৃত ফল!

তালেবানি উত্থান: বিষবৃক্ষ থেকে অমৃত ফল!

62

মুক্তার হোসেন নাহিদ:
‘২০ বছর আগের তালেবান আর এখনকার তালেবান এক নয়’-গণমাধ্যমে এমন মন্তব্য বেশ। কিন্তু সাম্রাজ্যবাদ ও সাম্প্রদায়িকতার গর্ভে জন্ম নেওয়া তালেবানি বিষবৃক্ষ অমৃত ফল দেবে!-আমার ছোট মাথায় তা ধরে না। আবার ট্রিলিয়ন ট্রিলিয়ন ডলার খরচ করে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ কেন আফগানিস্তান ছেড়ে গেল! কেন তাদের হাতে গড়া ৩ লক্ষ আফগান সেনা বিনা বাধায় মাত্র ৭০ থেকে ৭৫ হাজার তালেবান বাহিনীর কাছে নীরব আত্মসমর্পণ করল-সে ভাবনায় ব্যস্ত বিশ্লেষকরা। হয়তো ভবিষ্যতের গবেষণায় তা পাওয়া যাবে। কিন্তু গবেষণা ছাড়াই সামান্য উপলব্ধিতে এই ছোট্ট মাথায় আসে-এটা মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের নতুন খেলা। আর আন্তর্জাতিক সমর্থন পাওয়ার জন্য তালেবানরা গণতন্ত্র ও উদারতার যে জয়গান গাইছে তা অচিরেই টের পাবেন আফগান জনতা ও বিশ্ববাসী। তালেবানি শাসনের আঁচ পাবেন বাংলাদেশসহ এ অঞ্চলের দেশসমূহ’ও। কারণ ‘সাম্রাজ্যবাদ ও মৌলবাদী অপশক্তি’ বিশ^শান্তির জন্য দু’টোই বিষফোঁড়া।
‘কমিউনিস্ট শাসক নাজিবুল্লাহ থেকে পুতুল সরকার আশরাফ গনি’-উৎখাতের নেপথ্যের খলনায়ক মার্কিন সা¤্রাজ্যবাদ। তারাই মূলত সারা দুনিয়া সহ এই অঞ্চলের মৌলবাদ ও সন্ত্রাসবাদী সংকটের মূল হোতা। ওরা কখনো গণতন্ত্র রক্ষার নামে, কখনো উগ্র সাম্প্রদায়িক জঙ্গিবাদ দমনের ছুঁতোয় দেশে দেশে হামলা চালায়, দখলদারিত্ব কায়েম করে, রাষ্ট্রনায়কদের হত্যা করে। সাদ্দাম, গাদ্দাফি সহ অনেই সেই ষড়যন্ত্রে নির্মম মৃত্যুর শিকার। কিউবান বিপ্লবের মহানায়ক ফিদেল ক্যাস্ত্রোকেও ৬৩৮ বার হত্যার চেষ্টা করা হয়েছে। এখনো সাম্রাজ্যবাদী আগ্রাসনের হুংকার ঠেকাতে গর্জে উঠতে হচ্ছে কিউবান বীর জনতাকে। এই আফগানিস্তানেও নাজিবুল্লাহকে কাবুলে জাতিসংঘের দপ্তর থেকে টেনে হেঁচড়ে নামিয়ে রাস্তায় প্রকাশ্য পিটিয়ে নির্মমভাবে হত্যা করে তালেবানরা। কেবল হত্যা’ই নয়, ল্যাম্পপোস্টে উল্টো করে ঝুলিয়ে রাখা হয় নাজিবুল্লাহ মৃতদেহ। সেটাও হয়েছিল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ইশারায়। সে সময় তালেবান বাহিনী আফগান জনতাকে যে নির্মম নির্যাতন করেছে-তা ভুলে যাওয়ার নয়। ভুলেনি বাংলাদেশের মানুষও। তালেবানি শক্তিতে উৎসাহিত হয়ে আমাদের দেশেও রাস্তায় রাস্তায় শ্লোগান উঠেছে ‘আমরা হব তালেবান-বাংলা হবে আফগান’। ১৭ আগস্টে দেশজুড়ে সিরিজ বোমা হামলা, যশোরে উদীচি সম্মেলনে হামলা, পল্টন ময়দানে সিপিবি সমাবেশে হামলা,রমনার বটমূলে হামলা, ২১ আগস্টে গ্রেনেড হামলা এবং হলি আর্টিজানে হামলা উগ্র জঙ্গিবাদী গোষ্ঠীর বর্বরতা। মানুষ তা ভুলে নি। সেসবের পিছনে আফগান ফেরত বহু তালেবানি জঙ্গি ছিল। এবারও আফগানিস্তানে তালেবানি উত্থানের সাথে সাথে সামাজিক মাধ্যম ফেসবুকে এক শ্রেণির মানুষ তালেবানের প্রশংসা মঞ্চমুখ। অনেকেই বেশ খানিকটা পুলকিত। যে তালেবানকে দিয়ে মার্কিনীরা নাজিবুল্লাহ সরকার উৎখাত করেছিল, সেই তালেবানকে হঠিয়ে তারা বসিয়েছিল হামিদ কারজাইয়ের পুতুল সরকার। এখন আবার তালেবানি উত্থানের পর সেই সরকারের ভবিষ্যৎ রূপরেখা কেমন হবে-তা নিয়েও চলছে গোপন দরকষাকষি। ফলে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ ও উগ্রপন্থী তালেবান-দু’টোই যে বিষবৃক্ষ তা বুঝতে রাজনীতির বিশাল গবেষণা লাগে না। ঠাণ্ডা মাথায় একটু চিন্তা করলেই হয়।
আফগানিস্তানের সমস্যা ও সংকট বহু পুরনো। রাজার শাসন থেকে রাষ্ট্রপতি-প্রধানমন্ত্রী কিংবা কমিউনিজম নীতিতে গণতন্ত্র আর মার্কিনীদের পুতুল সরকার কারজাই-গণির তথাকথিত গণতন্ত্র এবং মুজাহিদীন-তালেবানি শাসনে-আফগান সংকট দূর হয়নি, হচ্ছে না। এ সংকট আগামী দিনেও যাবে না। যদি না আফগানিস্তান তালেবান ও মার্কিন সা¤্রাজ্যবাদ থেকে মুক্ত হয়ে নিজেদের শক্তিতে প্রকৃত অর্থে জনগণের সরকার গঠন করতে না পারে। চেষ্টা করেছিল ১৯৬৫ সালে গঠিত ‘দ্যা পিপলস ডেমোক্র্যাটিক পার্টি অব আফগানিস্তান (পিডিপিএ)’-নামে নুর মহম্মদ তারাকির নেতৃত্ত্বাধীন কমিউনিস্ট পার্টি। ১৯৭৮-এ তারাকি দেশের রাষ্ট্রপতি এবং বাবরাক কামাল হন উপপ্রধানমন্ত্রী। সোভিয়েত ইউনিয়নের সহযোগিতায় ‘পিডিপিএ’ সরকার দেশকে এগিয়ে নিয়ে যান অর্থনৈতিক ও সামাজিক সাম্যতার ভিত্তিতে। কিন্তু মৌলবাদ ও রক্ষণশীল কিছু ইসলামিক নেতা মিলে সেই সরকার উৎখাতে গড়ে তুলেন ‘মুজাহিদীন’ নামে জঙ্গিবাদী বাহিনী। ’৭৯-তে এই বাহিনীর হাতে খুন হন তারাকি। সোভিয়েত ইউনিয়ন ভাঙতে এই মুজাহিদীন বাহিনীকে বিপুল অর্থ ও অস্ত্রের যোগান দেয় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। আর এ সাথে সহযোগিতা করে তাদের মিত্র ব্রিটেন, পাকিস্তান ও সৌদিআরব। ’৮৬-তে কমিউনিস্ট নেতা নাজিবুল্লাহ ক্ষমতায় আসেন। তাকে হঠিয়ে ইসলামিক আফগানিস্তান গঠন করার জন্য ওয়াবীবাদী নেতা ওসামা বিন লাদেন ˆতরি করে ‘আল কায়দা’। এই লাদেনও মার্কিনীদের সৃষ্টি। লক্ষ্য সোভিয়েত ইউনিয়নের পতন। ১৯৭৯-৮৯ টানা দশ বছর ‘অপারেশন সাইক্লোন’-এর নামে গোপনে আফগান মুজাহিদীন বাহিনীকে ব্যাপক অর্থ, অস্ত্র ও প্রশিক্ষণে সাহায্য করে মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থা সিআইএ। একইভাবে সাহায্য করে ব্রিটিশ গোয়েন্দা সংস্থা এম১৬। অবশেষে ১৯৯২ সালে আমেরিকা, পাকিস্তান ও সৌদি আরবের মদদপুষ্ট মুজাহিদীন বাহিনীর বুরহানুদ্দিন হন আফগান রাষ্ট্রপতি। তার কয়েক বছর পর ’৯৫ সালে ক্ষমতা দখল করে তালেবানরা। হত্যা করা হয় কমিউনিস্ট নেতা নাজিবুল্লাহকে। কিন্তু টুইন টাওয়ারে হামলার ছুঁতোয় এই তালেবানকেই উৎখাত করতে সরাসরি মার্কিন সেনা আফগানিস্তানে পাঠায় আমেরিকা। তালেবানকে পরাস্ত করে বসায় হামিদ কারজাইয়ের পুতুল সরকার। টানা ২০ বছর তা চলেছে। ট্রিলিয়ন ট্রিয়লন ডলারও খরচ করেছে। মারা গেছে মার্কিন ও ন্যাটো বাহিনীর বহু সেনা। প্রশিক্ষণের মাধ্যমে প্রস্তুত করেছে ৩ লক্ষ আফগান সেনাবাহিনী। সেই বাহিনী তালেবানি শক্তির কাছে তাসের ঘরের মতো উড়ে গেল। বিনা বাধায় ক্ষমতা দখল করলো তালেবানরা।
কিন্তু কিভাবে! এত অস্ত্র তারা পেল কই! কেন আফগান সেনারা নীরবে পরাজয় মেনে নিল-এসব প্রশ্নের উত্তর একটাই এর পিছনে কলকাঠি নাড়ছে ওই মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ। এটা তাদের নয়া কৌশল। এই মার্কিনীরাই ’৯৫-তে তালেবানরা ক্ষমতা দখল করলে ‘ইতিবাচক পদক্ষেপ’ হিসেবে স্বাগত জানিয়েছিল। এখন বাংলাদেশ সহ বিশ্বের অনেক দেশকে একদিকে সমর্থন না দেওয়ার আহবান করছে, অন্যদিকে নিজেরা তালেবানি সরকারের রূপ রেখা কি হবে-তা নিয়ে দরকষাকষি করছে। সাম্রাজ্যবাদী এই কালসাপ যাইতেও কাটে, আসতেও কাটে।
ফিরে আসি শিরোনামে। বলেছি ‘বিষবৃক্ষ থেকে অমৃত ফল!’ সত্যি তাই হবে। তালেবানরা যদি আগের তালেবান না হবে, যদি তারা উদার ও মানবিক হবে-তা হলে কেন হাজারে হাজারে আফগান জনতা উজবেকিস্তা ও পাকিস্তান সীমান্তে ছুটছে পাগলের মতো! কেন সেখানে বোরখা কেনার ধুম পড়েছে! কেন সরকারি-বেসরকারি মহিলা কর্মজীবীরা আতংকিত! সিনেমা হলগুলো বন্ধ হয়ে গেছে। আফিম খেত পাহারা দিচ্ছে মার্কিন ˆসন্যরা। আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমের সংবাদ সূত্র বলছে, গণি সরকার, মার্কিন ও ন্যাটো বাহিনীর সাথে যারা কাজ করেছে তালেবানরা বাড়ি বাড়ি গিয়ে তালাশ করছে। সাংবাদিকদের বাড়িতেও যাওয়া হচ্ছে। বাড়িতে না পাওয়ার কারণে চরম গালাগালির পাশাপাশি কোনো কোন পরিবারের সদস্যকেও হত্যার অভিযোগ উঠেছে। ডয়চে ভেলের একজন আফগান সম্পাদরকের বাড়িতে তাকে না পাওয়ায় পরিবারের সদস্যকে হত্যা করা হয়েছে। হত্যা করা হয়েছে হাজারা নৃ- গোষ্ঠীর ৯ জনকে। চলছে নির্মম নির্যাতন। আফগান নারীরা কোলের সন্তানকে ছুঁড়ে মারছে কাঁটাতারের ওপারে। তাদের করুন আর্তি “ওদের বাঁচান”। এ দৃশ্য দেখে চোখের জল ফেলছে মার্কিন ˆসন্যরাও। বিমানবন্দরে জনতার স্তোতে গুলি করা হয়েছে। আফগান জনতা আতংকিত। ফলে তালেবানরা যদি সত্যিই উদারপন্থী হবে এবং আগের চেয়ে ভালোই হবে-তাহলে এ নির্মমতা কেন!
তাই তালেবানি উগ্র সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠীর উত্থানে যেমন শংকিত আফগান জনতা, ততোটাই উদ্বিঘ্ন বাংলাদেশের মানুষ। এ ভয় তালেবানি পথ ধরে এদেশে নতুন করে জঙ্গিবাদ মাথাচাড়া দেওয়ার! ভয়ের কারণও আছে। ইতোমধ্যে একজন পুলিশ কর্মকর্তা বলেছেন, অনেকেই আফগান যাচ্ছে। ভারতীয় সীমান্তে কেউ কেউ ধরাও পড়েছে। অতীতে জঙ্গিবাদী গোষ্ঠীগুলোর মধ্যে আফগান ফেরত তালেবান যোদ্ধা ছিল। জঙ্গি আক্রমণসমূহও ছিল ভয়ংকর। বাংলাদেশের বহু তরুণ এমনকি বয়স্করাও তালেবানের উত্থানে বেশ পুলকিতভাবে ফেসবুকে উচ্ছ্বাস প্রকাশ করেছে। তালেবানিরা যতই গণতন্ত্রের কথা বলুক, ওদের অন্তরে সাম্প্রদায়িকতার বিষ। ওরা ফোণা তুলে ছোবল দিবেই। আর সাথে আছে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের মতো আরেক বিষধর নাগিন। তাই এই দুই বিষবৃক্ষ থেকে অমৃত ফল আসবে না, আসবে বিষাক্ত নীল ছোবল। সেই ছোবল থেকে রক্ষায় প্রস্তু থাকতে হবে বাংলাদেশকে, প্রস্তুত হতে হবে এই অঞ্চলের দেশগুলোকে-লেখক: সাবেক ছাত্র আন্দোলনের কর্মী।