Home রাজনীতি ঢাকা-৫ আসনে নৌকার হালচাল কে হচ্ছেন দ্বাদশ নির্বাচনে নৌকারমাঝি

ঢাকা-৫ আসনে নৌকার হালচাল কে হচ্ছেন দ্বাদশ নির্বাচনে নৌকারমাঝি

28

স্টাফ রিপোটার: এক সময়ে বিএনপি-জামায়াতের ঘাটি হিসেবে পরিচিত ঢাকা-৫ নির্বাচনী এলাকায় টানা ১৫ বছর যাবত রাজত্ব করছে আওয়ামী লীগের মনোনীত নৌকার মাঝি। বিগত ১৫ বছরে এই আসনটি এখন আওয়ামী লীগের ঘাঁটি হিসেবে পরিচিত লাভ করেছে। তবে দ্বাদশ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে নৌকার মনোনয়ন প্রত্যাশীরা একাধিক ভাগে বিভক্ত হয়ে পড়েছেন। স্থানীয় নেতাকর্মীরাও মিছিল-মিটিংয়ে বিভক্ত হয়ে অংশ নিচ্ছেন। এই বিভক্তির মূলে রয়েছে নিজেদের শক্তিশালী নেতা হিসেবে পরিচিত করা এবং আখের গোছানো-দ্বাদশ নির্বাচনে নৌকার শক্ত প্রার্থী হিসেবে জানান দেওয়া।
আগামী দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ঢাকা-৫ আসনে নৌকার মনোনয়ন (টিকিট) পেতে মাঠে দৌড়-ঝাপ করছেন হাফ ডজন নেতা। তাদের মধ্যে বর্তমান সংসদ সদস্য কাজী মনিরুল ইসলাম মনুও রয়েছেন। এছাড়া আলোচনায় রয়েছেন প্রয়াত হাবিবুর রহমান মোল্লার জেষ্ঠ্যপুত্র মশিউর রহমান মোল্লা সজল, আওয়ামী স্বেচ্ছাসেবক লীগের ঢাকা মহানগর দক্ষিণের সভাপতি কামরুল হাসান রিপন, যাত্রাবাড়ী থানা আওয়ামী লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক হারুনর রশিদ মুন্না, ডেমরা থানা আওয়ামী লীগের সাবেক সভাপতি অ্যাডভোকেট রফিকুল ইসলাম খান মাসুদ, আওয়ামী লীগের আন্তর্জাতিক বিষয়ক উপ-কমিটির সাবেক সদস্য নেহরীন মোস্তফা দিশি, ১৪ দলের শরিক জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল (জাসদ) এর কেন্দ্রীয় সহ-সভাপতি মো. শহীদুল ইসলাম প্রমুখ।
ঢাকা-৫ আসনের মনোনয়ন প্রত্যাশীদের অভিযোগ, ঢাকা-৫ আসনটি আওয়ামী লীগের একটি শক্তিশালী ঘাঁটি। কিন্তু আসনটিতে সাংগঠনিক গ্রুপিং আর একনেতা আরেক নেতার বিরুদ্ধে নানা অপপ্রচারে লিপ্ত থাকায় কোন্দল আরও বাড়ছে। এতে একাধিক ভাগে বিভক্ত হয়ে পড়েছে তৃণমূল আওয়ামী লীগের নেতারা। যে যার ইচ্ছে মতো নিজেদের শক্তির জানান দিতে বিএনপি-জামায়াত আর্দশের লোকদের কাছে টানছে এবং ওয়ার্ড-থানায় পদ-পদবী দিতে তৎবির করছেন। ফলে দলের ত্যাগী-পরিক্ষীত ও স্থানীয় নেতাদের এই গ্রুপিংয়ের খেসারত দিতে হচ্ছে। শুধু তাই নয়, একশ্রেনির নেতাকর্মীরা আওয়ামী লীগের মনোনয়ন প্রত্যাশীদের গ্রুপে ঢুকেই এখানে দলীয় ব্যানারে চাঁদাবাজি শুরু করছেন। এমনটি জানিয়েছেন ভুক্তভোগীরা। স্থানীয় এমপির নামে প্রতিটি বাস স্টেশন, সিএনজি স্টেশন ও ফুটপাত থেকে চাঁদা তোলা হয়। এছাড়া বালু ভরাটের নামে স্থানীয়দের জিম্মি করে চাঁদা আদায় হচ্ছে অহরহ।
ঢাকা-৫ আসনের বর্তমান সংসদ সদস্য কাজী মনিরুল ইসলাম মনু বলছেন, আমার নেত্রী মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যাকে যোগ্য মনে করবেন,তাকেই নৌকার মনোনয়ন দিবেন। আমার কোনো গ্রুপিং নাই। আমার সঙ্গে যারা আছে, আমরা সবাই জননেত্রী শেখ হাসিনার কর্মী। উনার প্রতিটি নির্দেশ অক্ষরে অক্ষরে আমি পালনের চেষ্টা করছি। একপ্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, আমার এলাকার মধ্যে চাঁদাবাজির বিষয়ে আপনি যেটা বললেন সেটা ৮০ ভাগ সত্য। বিভিন্নভাবে, বিভিন্ন উপায়ে চাঁদাবাজি হচ্ছে। বাস-টেম্পো স্টেশন, এটা-সেটা সমানে চাঁদাবাজি হচ্ছে। এটা আমার নিয়ন্ত্রণে নেই। ভ্যান গাড়ি নিয়ে গেলেও নাকি চাঁদা দিতে হয়, সব জায়গায় একই অবস্থা। এসব চাঁদাবাজি কারা করে সেটা আমি জানি না। প্রশাসনকে এ ব্যাপারে শক্ত হওয়া উচিত। তিনি বলেন, স্থানীয় প্রশাসন যদি শক্ত হয় তাহলে আমরা আরও শক্তিশালী হতে পারি। তিনি বলেন, স্থানীয় প্রশাসনকে চিঠি দিয়ে বলেছি,যারা চাঁদাবাজি, ধান্দাবাজি করে তাদের বিরুদ্ধে ব্যাবস্থা নিতে। এমনকি এতে আমার কোনো আত্মীয়-স্বজন জড়িত থাকলে তাদের বিরুদ্ধেও কঠোর ব্যাবস্থা নিতে অনুরোধ জানিয়েছি। এছাড়াও আমি ব্যাক্তিগতভাবে কঠোর হুঁশিয়ারী উচ্ছারন করে বার ফেসবুকে বলেছি, আমি পুলিশ প্রশাসনকেও বলেছি। আমার কোনো আত্মীয়-স্বজন, আমার ভাই, আমার নিজের ছেলেও যদি করে তাহলেও তাদের ছাড়বেন না। আমার ভাইদের কেউ চেনে না, আমার ছেলেও এগুলোর মধ্যে নেই। আমার ৫টা ভাই, তাদের কেউ চেনে না। কিছু স্বার্থান্বেষী মহল আমার নাম ভাঙিয়ে এগুলো করে। আমি তাদের চিনিও না। এগুলো নিয়ন্ত্রণ করতে পারে একমাত্র পুলিশ প্রশাসন। তাদের হস্তক্ষেপ ছাড়া এগুলো নিয়ন্ত্রণ করা যাবে না। তবে কাজী মনিরুল ইসলাম মনুর অভিযোগ, কিছু মনোনয়ন প্রত্যাশী দিন দিন নৌকাকে ডুবাতে এবং আওয়ামী লীগের সুনাম নষ্ট করার ষড়যন্ত্রে মাঠে নেমেছেন। তারা নিজেদের বলয় তৈরি করে চাাঁদাবাজি ও জমি দখলের মতো কর্মকাণ্ডে লিপ্ত রয়েছেন। ওইসব মনোনয়ন প্রত্যাশীরা অপকর্ম করছেন আর আমার নামও ভাঙিয়ে আমাকে বিব্রতকর অবস্থা ফেলে দিচ্ছেন। কাজী মনিরুল ইসলাম মনু এমপি বলেন, আমার দায়িত্বপালনের ২ বছর তিন মাস চলছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উন্নয়ন চিত্র নাগরিকদের সামনে তুলে ধরছি। এলাকার মানুষের সঙ্গে সুসম্পর্ক রাখার চেষ্টা করছি। জনগণই বলতে পারে আমি কতটুকু খারাপ আর কতটুকু ভালো করেছি। দলের নেতাদের সঙ্গে আমার দূরত্ব বাড়েনি। অনেকে মনে কষ্ট নিয়ে হয়ত বলতে পারেন আমাকে এই দিল না, সেই দিল না। আমরা কী দিতে পারি? দূরত্ব বলতে এমন নয় যে আমি তাদের নিয়ে মিছিল করি না। আমি তাদের নিয়ে মিছিল করি, দলের সকল প্রোগ্রামে যাই। দূরত্ব কীভাবে হলো আমি জানি না। আমি নেতাকর্মীদের সঙ্গে আছি, থাকব। তিনি বলেন, আমাদের এখানে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি খুব ভালো। এখানে কর্মীদের মধ্যে কোনো মারামারি নেই। দলে পক্ষ-বিপক্ষ থাকবে, পৃথিবীর সবখানেই এটা আছে। আমাদের এখানে মারামারি, ধরাধরি, অমুক-তমুক, এটা সেটা, এগুলো নেই। আমার এই দুই থানার নেতাকর্মীদের সঙ্গে অত্যন্ত ভালো সম্পর্ক আছে।
স্থানীয় নেতাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, যাত্রাবাড়ি থানা আওয়ামী লীগের সাবেক সভাপতি কাজী মনিরুল ইসলাম মনু এমপি নির্বাচিত হওয়ার পর থেকে যেমরা-যাত্রাবাড়ি থানার তৃণমূল নেতাকর্মীরা উজ্জীবিত। এতদিন দলের যে সকল নেতাকর্মী ক্ষোভ-অভিমানে নিষ্ক্রীয় ছিল, তারাও এখন আওয়ামী লীগের প্রতিটি সভা ও শান্তি সমাবেশসব দলের সকল কর্মসূচিতে অংশ নিচ্ছেন। তৃণমূল নেতাকর্মীদের দাবি,আগের এমপি মনখোলে কারো সঙ্গে কথাও বলেনি। শুধুমাত্র নির্বাচন আসলে মাঠে নেমেছিল। কিন্তু কাজী মনিরুল ইসলাম মনু এমপি হয়েও তৃণমূল নেতাকর্মীদের সঙ্গে প্রতিদিন আড্ডা দিচ্ছেন এবং তাদের চাওয়া-পাওয়া এবং মান-অভিমানের কথা শুনে তাৎক্ষনিকভাবে ব্যাবস্থা নিচ্ছেন।
ঢাকা-৫ আসনে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন চান আলহাজ¦ মশিউর রহমান মোল্লা সজল। তিনি বলেন, আগামী নির্বাচনকে কেন্দ্র করে গণসংযোগ শুরু করে দিয়েছি। বিভিন্ন ওয়ার্ডে যাচ্ছি, স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলছি। চলার পথে সবার সাথে কুশল বিনিময় করছি। এলাকার মুরব্বীদের সঙ্গে কথা বলছি, তাদের থেকে দোয়া নিচ্ছি। এছাড়া আওয়ামী লীগ বা দল থেকে যেসব নির্দেশনা আসছে সে অনুযায়ী কাজ চলছে। তিনি বলেন, দল যদি আমাকে মনোনয়ন দেয় এবং জনগণ যদি আমাকে ভোটে জয়যুক্ত করে, তবে বর্তমানে যে অনিয়মগুলো চলছে তা বন্ধ হয়ে যাবে। এখানে চাঁদাবাজি, মাদক, জমি দখল, অবৈধ বালি ব্যবসার সমস্যা প্রকট। আমি চেষ্টা করব এসব সমস্যা দূর করতে। সবচেয়ে যে বড় বিষয় হচ্ছে, দলীয় শৃঙ্খলা বা চেইন অব কমান্ড। উপনির্বাচনের পর এটি একদমই ভেঙে গেছে। স্থানীয় আওয়ামী লীগের মধ্যে কোনো চেইন অব কমান্ড নেই। ঐক্যবদ্ধ হয়ে কেউ কাজ করছে না। বিভিন্ন ভাগে বিভক্ত হয়ে কাজ করলেও সেটা নিয়ে আমার কথা নয়। তবে বড় কোনো কর্মসূচিতে ঐক্যবদ্ধ হতে পারছি না। একটা পক্ষ আমরা রাস্তায় থাকছি, আরেকটা পক্ষ রাস্তায় নেই। দ্বাদশ নির্বাচনে নৌকার মনোনয়ন চান স্বেচ্ছাসেবক লীগের ঢাকা মহানগর দক্ষিণের সভাপতি কামরুল ইসলাম রিপন। তিনি বলেন, দীর্ঘদিন ধরে এ আসনের প্রত্যেকের সঙ্গে সমন্বয় করে কাজ করে যাচ্ছি। এই আসনটি হলো ঢাকার এন্ট্রি পয়েন্ট। এখানে জামায়াত-বিএনপির অবস্থানের বিরুদ্ধে রাজপথের আন্দোলন করে যাচ্ছি। তিনি বলেন, হেফাজত, জামায়াত-বিএনপির সকল কর্মসূচি প্রতিহত করতে যাত্রাবাড়ী চৌরাস্তা আমার নেতাকর্মীরা দখলে রেখেছিল, সেটা এখনও দখলেই আছে। যুব সমাজ আমার সঙ্গে কাজ করে। করোনাকালীন সময়ে আমি প্রত্যেক ঘরে ঘরে গিয়েছি। এই ঈদে শেখ হাসিনার নির্দেশে কয়েক হাজার পরিবারকে বিভিন্ন উপহার সামগ্রী বিতরণ করেছি। আরেক মনোনয়ন প্রত্যাশী যাত্রাবাড়ী থানা আওয়ামী লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক হারুনর রশিদ মুন্না। তিনি বলেন, ১৯৯০ সাল থেকে ছাত্র রাজনীতি করছি। ৯২ সালে থানা আওয়ামী লীগের প্রথম যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক, ৯৮ সালে সাধারণ সম্পাদক ছিলাম। ২০০৪ সালে কাজী মনু সভাপতি, আমি সাধারণ সম্পাদক (অবিভক্ত ডেমরা), ২০১৬ সালে কাজী মনু সভাপতি আমি সাধারণ সম্পাদক। লড়াই, সংগ্রাম, আন্দোলন, ত্যাগ, পরিশ্রম কম করিনি। ২০০৮ সালে আমাকে মনোনয়ন দেওয়া হয়েছিল। দলের প্রেক্ষাপটে আমি মনে করি এবার আমার হক, আমার নেতাকর্মীদের হক। তিনি বলেন, আওয়ামী লীগ একটা বড় দল। ১৫ বছর ধরে ক্ষমতায়, গ্রুপিং থাকবে না, এটা কি হয়? গ্রুপিং অবশ্যই থাকবে।
উল্লেখ্য, ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের ৪৮, ৪৯, ৫০, ৬০, ৬১, ৬২, ৬৪, ৬৫, ৬৬, ৬৭, ৬৮, ৬৯ ও ৭০ নং ওয়ার্ড নিয়ে গঠিত ঢাকা-৫ নির্বাচনী এলাকার সংসদীয় আসন। এ আসনে মোট ভোটার সংখ্যা ৪ লাখ ৭১ হাজার ১২৯ জন। এর মধ্যে পুরুষ ভোটার ২ লাখ ৪১ হাজার ৪৬৪ জন আর নারী ভোটার ২ লাখ ২৯ হাজার ৬৬৫ জন। এ আসনটি দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলের জন্য রাজধানীর প্রবেশমুখ হওয়ায় রাজনৈতিক দলগুলোর কাছে খুব গুরুত্বপূর্ণ হিসেবে বিবেচিত হয়। এরআগে ২০২০ সালের ৬ মে ঢাকা-৫ আসনের সংসদ সদস্য ও বর্ষীয়ান আওয়ামী লীগ নেতা হাবিবুর রহমান মোল্লা মৃত্যুবরণ করেন। ওই বছরই উপ-নির্বাচনে বিজয়ী হন আওয়ামী লীগের প্রার্থী বর্তমান সংসদ সদস্য কাজী মনিরুল ইসলাম মনু।