Home মতামত ছাদের গায়ে চাঁদের আলো!!

ছাদের গায়ে চাঁদের আলো!!

122

সরদার মোঃ শাহীন:

ছোটবেলায় চাঁদ দেখার জন্যে আমাদের কোন ছাদ ছিল না। ছাদে যাবার সুযোগই ছিল না। ছাদ পাবো কোথায়? ছিল টিনের চাল। খাঁড়া খাঁড়া চাল। একবার একটু বেতাল হলেই ধপ্পাস। অথচ ক্লাস সিক্সে থাকতে সেই খাঁড়া টিনের চালেই উঠলাম পাকা বড়ই খাবো বলে। আমাদের ঘরের ঠিক পাশ ঘেষেই ছিল বড়ই গাছটি। খেয়াল করে দেখলাম, হাতের নাগালের মধ্যে বড় পাকনা বড়ই কখনোই থাকে না। লাল টকটকা বড় বড় পাকা বড়ইগুলো থাকে চালের বেজায়গায়। ঢিল ছুঁড়েও নিচে ফেলা যায় না।
তাই সাহস এবং কায়দা করে সেই চালেই উঠে পড়লাম। এবং একটু একটু করে আগাতে আগাতে চালের সবচেয়ে রিস্কি জায়গায় পৌঁছেও গেলাম। পাকা বড়ইগুলো আমার খুব কাছাকাছি। আর একটু হাত বাড়ালেই বড়ই গাছের ডাল। ডালে থোকায় থোকায় পাকনা পাকনা বড়ই। আমার আনন্দ যে আর ধরে না। আজ শুধু চাল বিজয়ই হয়নি। চালের জটিল জায়গার বড়ই বিজয়ও হবে। বড়ই আমার হাতে চলে আসবে একটু পরেই। আমি খুবই শিহরিত। শিহরন জাগা মনে যেই না হাত আর একটু বাড়িয়েছি, অমনি ধপ্পাস!
চালের টুয়ায় ধরে থাকা হাতের থাবা ছুটে যাবার কারণে চাল দিয়ে ছেচড়াতে ছেচড়াতে সোজা নিচে। নিচে পড়লাম ধুরুম করে শব্দ করে। নিমিষেই কিভাবে কি হয়ে গেল বুঝতে পারলাম না। মাথা ভনভন করছে। উঠে দাঁড়াবার চেষ্টা করলাম। কষ্ট করে এক সময় কোন রকমে উঠে দাঁড়াতেই বুঝলাম আমার বাম হাতখানা ভেঙে বাঁকা হয়ে নব্বই ডিগ্রী ঘুরে গেছে। ব্যথায় আমার সারা শরীর কুকড়ে উঠেছে। মাথা ঘুরছে। আর সাথে ঘুরছে স্বপ্ন। টিনের চালে উঠে পাকা বড়ই খাবার স্বপ্ন।
চালে উঠে এমনই বড়ই খাবার স্বপ্ন মাঝেমধ্যে দেখলেও, চালে উঠে চাঁদ দেখার স্বপ্ন কখনোই দেখিনি। দেখার দরকার পড়েনি। কেননা বড়ইয়ের চেয়েও চাঁদ ছিল সহজ লভ্য। হাতের নাগালেই। চাইলেই দেখা যেত। ঘরে বাইরে সব জায়গা থেকেই দেখা যেত। গাওগেরামে ঘরের বাইরে উঠোন কোণে দাঁড়িয়ে কিংবা পূর্ব আকাশে তাকিয়ে পূর্ণিমার চাঁদ দেখেই তৃপ্ত হওয়া যেত। কি বিশাল চাঁদ! বড় চাঁদ! বড় আকৃতির চাঁদ উদিত হতো পূর্বাকাশে। উদিত হবার সময় মনে হতো যেন চাঁদ নয়, হিম শীতল বিশাল এক আলোক পিন্ড ধেঁয়ে আসছে পৃথিবীর দিকে।
ইদানীং স্যোশাল মিডিয়ায় এই চাঁদ নিয়ে লেখালেখি এবং কথা হচ্ছে অনেক। যেমনি হচ্ছে চাঁদ নিয়ে, তেমনি ছাদ নিয়ে। চাঁদকে ছাদের সাথে মিলিয়ে রং তামাশা হচ্ছে। হঠাৎ করেই যেন বাংলাদেশে চাঁদ বিষয়ক বিশেষজ্ঞ বেড়ে গেছে। ঘরে ঘরে বিশেষজ্ঞ। মনে হচ্ছে চাঁদ নিয়ে জ্ঞান রাখে না এমন কেউ নেই এ বাংলায়। চাঁদ নিয়ে এই মাতামাতিটার জন্যে আসলে ভারত দায়ী। মাত্র কয়েক’শ কোটি টাকায় চাঁদে নভোযান পাঠিয়ে বাঙালির মাথাটাই নষ্ট করে দিয়েছে ভারত।
বাংলাদেশে ৩ কিঃমিঃ লম্বা একটা সেতু যেখানে ৬০০ কোটি টাকায় করা যায় না, সেখানে ৩ লক্ষাধিকের অধিক কিমি দূরের চাঁদে ভারত চলে গেল মাত্র ৬০০ কোটি টাকায়! মাথা নষ্ট তো হবেই। সেতু বানাবার কৌশল বুঝি বা না বুঝি, চাঁদে যাবার প্রযুক্তি সম্বন্ধে ধারণা রাখি বা না রাখি; মাথা আমাদের খাটাতেই হবে। কথা আমাদের বলতেই হবে। বিজ্ঞান আমরা না বুঝতে পারি, কিন্তু বিজ্ঞান নিয়ে মানুষকে জ্ঞান দিতে আমাদের জুড়ি নেই।

চাঁদ বিজ্ঞান নিয়ে জ্ঞান না থাকুক, চাঁদ বিষয়ক যথেষ্ঠ তথ্য কি আমাদের জানা আছে? যারা ইদানীং ট্রল করে বেড়াচ্ছি, সেই আমরা কি জানি খোদ চাঁদের বুকে একটি আগ্নেয়গিরির জ্বালামুখের নাম ‘বোস ক্রাটার’। যে ‘বোস’ হলেন ঢাকার খুব কাছের বিক্রমপুরের ছেলে সায়েন্স ফিকশনের জনক জগদীশ চন্দ্র বসু। বিশ্ববিজ্ঞানসহ উপমহাদেশে বিজ্ঞানের নবজাগরণে বিশেষ অবদান রাখায় তাঁর স্মরণেই এই নামকরণ করা হয়েছে।
তথ্যগুলো জানা কিন্তু খুব কঠিন কোন কাজ নয়। চাঁদ নিয়ে যারা এত্ত এত্ত ব্যাঙ্গাত্মক লেখা লিখছেন তারা দু’চারখানা বই কিংবা নিদেন পক্ষে পত্রপত্রিকায় চোখ রাখলেই জানতে পারেন। ক’দিন আগেও এসব নিয়ে নিয়ন মতিয়ুল নামের একজন চমৎকার বর্ণনা দিয়েছেন পত্রিকার পাতায়। যারা স্যোশাল মিডিয়ায় এত একটিভ, তারা কষ্ট করে মেইনষ্ট্রিম মিডিয়ায় একটু সময় দিলেই কিন্তু বিস্তর জানতে পারেন।
এক সময় মহাবিজ্ঞানী আইনষ্টাইন বলেছিলেন, মহারহস্যময় মহাবিশ্বের বিবর্তনের সহজ ব্যাখ্যা দিতে পারে ‘সাহা আয়োনাইজেশন ইকুয়েশন’। দিতে পারে কোটি কোটি আলোকবর্ষ দূরের নক্ষত্রের তাপমাত্রা-গঠন সম্পর্কে রাশি রাশি তথ্য। আর এই সাহা হলেন জ্যোতিঃপদার্থবিজ্ঞানের জনক। গাজীপুরের কালিয়াকৈর উপজেলার শেওড়াতলী গ্রামের মুদি দোকানির ছেলে মেঘনাদ সাহা (১৮৯৩- ১৯৫৬)।
এতো গেল বাংলার কৃতি সন্তান বিজ্ঞানী মেঘনাদ সাহা এবং জগদীশ চন্দ্র বসুর কথা। আরেকজন বসুও আছেন। তিনিও এই বাংলার। তিনি বিশ্বখ্যাত গাণিতিক পদার্থবিজ্ঞানী সত্যেন বোস (সত্যেন্দ্রনাথ বসু: ১৮৯৪-১৯৭৪)। যাকে বলা হয় বোস-আইনষ্টাইন পরিসংখ্যানের জনক। তিনি ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক। একদিন ভার্সিটির ক্লাসে পড়াতে গিয়ে ভুল করার মাধ্যমে ম্যাক্স প্ল্যাংকের কোয়ান্টাম তত্ত্ব ত্রুটিমুক্ত করেছিলেন তিনি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে চাকরি পেতে বোসের পক্ষে সুপারিশ করেছিলেন স্বয়ং আইনষ্টাইন।
সত্যেন বোস বিজ্ঞান গবেষণা করতেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের লালভবনে বসে। যা পরবর্তীকালে জাতীয় প্রেসক্লাবের অন্তর্ভুক্ত হয় এবং বর্তমানে সেটা জাতীয় প্রেস ক্লাবের সাবেক লালভবন নামেই পরিচিত। একদিন যেখানে বসে ‘জ্ঞানভিত্তিক সমাজ’ গঠনে গবেষণা করতেন বিশ্বখ্যাত বিজ্ঞানীরা, এখন সেখানে বসে ‘রাজনীতিভিত্তিক সমাজ’ গঠনের পক্ষে অনবরত বাণী প্রচার করেন রাজনীতিক এবং সাংবাদিকরা।
হয়তো এ কারণেই জ্ঞানভিত্তিক সমাজ গঠনের পরিবর্তে রাজনীতিভিত্তিক সমাজ গঠিত হয়েছে এ দেশে। সমাজের আড্ডায় জ্ঞানের আলোচনা হয় না, হয় রাজনীতির আলোচনা। বই কিংবা দৈনিক পত্রিকা পড়ার পাঠক এদেশে তৈরি হয়নি। হয়েছে অনুমান কিংবা মিথ্যা নির্ভর রাজনীতি কিংবা গুজবের পাঠক। অনলাইন যুগের আগে ১৬ কোটির দেশে দৈনিক পত্রিকা ছাপা হতো মাত্র ২৫ লাখ। আর এখন কত হয়, সেটা পত্রিকাওয়ালারা স্বীকারই করবে না। স্বীকার করলে ইজ্জতে লাগবে তাদের।
অথচ মেধাবীরা দেশ ছাড়লে রাজনীতিকদের ইজ্জতে লাগে না। ভারত বিভাগের পর পাকিস্তান আমলে মেধাবীরা দলবেঁধে ভারতে চলে গেছে। তাদের বেশির ভাগ ছিল হিন্দু সম্প্রদায়ের। রাজনীতিকগণ এ নিয়ে মাথা ঘামায়নি। ভাবখানা এমন ছিল যেন হিন্দুরা দেশ ছাড়ছে; মেধাবীরা নয়। দেশ স্বাধীনের পর মেধাবীরা যাওয়া শুরু করলো ইউরোপ আমেরিকায়। এবার হিন্দু নয়, মুসলমিরাই বেশি। এখানেও রাজনীতিকরা নির্বিকার। এখানেও ভাবখানা তাদের এমন যে, বিদেশে আদম যাচ্ছে; মেধাবীরা যাচ্ছে না।
এভাবেই বছরের পর বছর মেধাশূন্য হচ্ছে দেশ। এই মেধাবীরাই বিদেশে গিয়ে গর্ব করার মত জায়গায় কাজ করছে। কাজ করছে নাসায়। অবদান রাখছে মহাকাশসহ বিশ্ববিজ্ঞানের নানা গবেষণায়। এতে বিশ্ববিজ্ঞান হচ্ছে সমৃদ্ধ। আধুনিক বিস্ময়কর বিজ্ঞানের ভিত তৈরিতে অসামান্য অবদান রাখা এদেশেরই পলিমাটিতে বেড়ে ওঠা এসব সন্তানদের নিয়ে বাইরের পৃথিবী গর্বিত। অথচ আমরা তাদের নামটিও জানি না। জানার চেষ্টাও করি না।
কিন্তু ভারতীয়রা জানে। মেধাবীদের মূল্য দিতে জানে। মেধাবীরা বিদেশে থাকুক আর দেশে থাকুক; আলোচনায় থাকে। পাঠ্য পুস্তকে তাদের কর্ম নিয়ে চ্যাপ্টার থাকে। তাদেরকে চেনা এবং জানার সুযোগ থাকে নব প্রজন্মের। পাশাপাশি রাজনৈতিক নেতৃত্ব ভারতের বিজ্ঞানের নবজাগরণে তাদের মেধা কাজে লাগায়। তাদেরকে রাখে অগ্রণী ভূমিকায়। এসব অগ্রনায়কদের কৃতিত্বে গর্বিত প্রতিবেশী ভারত।
হয়তো এ জন্যেই এসব মেধাবীদের অবদানেই ভারত আজ চন্দ্রবিজয়ী। মেধাবীদের মূল্যায়ন হয় বলেই ভারতের পাড়ায় পাড়ায় আজ মেধাবীর ছড়াছড়ি। আর মেধাবীদের মূল্য দিতে জানি না বলে আমাদের পাড়ায় পাড়ায় এখন শুধু সভাপতি আর সেক্রেটারি। দল বা সংগঠনের সভাপতি আর সেক্রেটারী। কেননা সমাজে মূল্য তো কেবল তাদেরই। পত্রিকার পাতায় পাতায় শুধু তাদের কথা আর তাদেরই বন্দনাগীতি।
হয়তো এ জন্যেই আমাদের ভাবনা বেশিদূর যেতে পারে না। আকাঙ্খার সীমানা জাতীয় সংসদ কিংবা সচিবালয়ে এসেই থেমে যায়। আমাদের কাছে বাড়ির ছাদই যেন আকাশের চাঁদ। হয়তো এ জন্যেই বাড়ির ছাদে উঠেই চাঁদে যাবার তৃপ্তি পাই। চাঁদে যাবার কথা ভাবতে পারিই না। ছাদের বুকে চাঁদের আলোতেই আমরা ভবিষ্যতের স্বপ্ন বুনি। জ্যোৎস্নামাখা বড় সেকেলে সে সব স্বপ্ন!!

-লেখক: উপদেষ্টা সম্পাদক , যুগবার্তা ডট কম।