Home মতামত ক্রিকেটীয় শ্রেণীসংগ্রামের যাত্রা

ক্রিকেটীয় শ্রেণীসংগ্রামের যাত্রা

143

রাকিন আবসার অর্নব:
বাংলাদেশের পরিচিত একটি এ্যাথলেটিক প্রতিষ্ঠানে ভর্তির লাইনে দাঁড়িয়ে ছিলাম। তখন আমি স্কুলে পড়ি। ইয়াবড় লাইন। দেশের সকল এ্যাথলেটরা একবার হলেও স্বপ্ন দেখে এই প্রতিষ্ঠানে ভর্তি হবার। বহু সময় অতিবাহিত করতে হবে এই লাইনে। আলাপচারিতায় পেছনের জনের সাথে বন্ধুত্ব হয়ে গেলো। কথায় কথায় জানতে পারলাম সে নাকি অলরেডি সিলেক্টেড তাও নিওম রক্ষার্থে লাইনে দাঁড়িয়েছে। আমি যখন ইন্ডোরে প্রবেশ করি তার আগেই ওজন এবং উচ্চতা মাপা হয়ে গেছে। ইন্ডোরের ভেতরে গিয়ে ট্রাইয়াল সেশনে তিনটি ক্যাচ, তিন বল ব্যাটিং এবং সম্ভবত তিন বল ফিল্ডিং টেস্ট নেয়া হয়েছিলো। এরপর পরিক্ষার সমাপ্তি। সেই টেস্টে আমি ফেইল করি।

এরপর হাল ছেড়ে দেইনি বরং নতুন ভাবে উদ্যমী হয়েছে। ভর্তি হয়েছি লোকাল ক্লাবে। ৫ বছর নিজেকে ঝালিয়ে নিয়েছি। বেশ কয়েক বছর খেলেছি স্কুলের জন্যেও। আরেকটি ক্লাবে ভর্তি হয়ে সেকেন্ড ডিভিশন পর্যন্ত খেলেছি। এরপর সুযোগ পেয়েছিলাম বয়স ভিত্তিক আন্তজেলা দলে খেলার। তবে স্বপ্নটা থেমে গিয়েছিলো বিভাগীয় বাছায় পর্বে। এতো কিছু নিজেকে জাহির করবার জন্য নয় বরং আমি একজন স্পোর্টসম্যান ছিলাম এতোটুকু প্রমান করবার জন্য উল্লেখ করছি। আমার খেলার মান নিয়েও কাওকে দোশারোপ করছিনা। বিভাগীয় দল থেকে ছিটকে পড়ার পরও খেলা ছেড়ে দেয়ার কথা ভাবতে পারিনি। তবে ততদিনে বোর্ডের অভ্যন্তরীণ কোন্দলের কারনে সকল প্রকারের লীগগুলো বন্ধ হয়ে যায়। সেই ধারাবাহীকতায় ঝিমিয়ে পড়ে ক্লাবগুলোও। একদফা জোর করে ফার্স্ট ডিভিশন লীগ শুরু হলেও স্থানীয় ক্লাবের কোচ রিভলভার উঁচিয়ে ট্রফি নিয়ে যায়। এরপর থেকে তাও প্রায় বন্ধ বলা চলে। এই ঘটনাকে কেন্দ্র করে বেশ আলাপে এসেছিলো রাজশাহীর ফার্স্ট ডিভিশন লীগ। আমার দেখা শত শত ক্রিকেটার হতাশায় খেলা ছেড়ে দেই এই সকল পরিস্থির মাঝে। লড়াই করে টিকে থাকে শুধু একজন। শুধু টিকে যায় তা নয় সে আজ জাতীয় দলের একজন খেলোয়াড়ও বটে। তবে যোগ্যতা সম্পন্ন অনেক ক্রিকেটার এই ভেকুয়ামের মাঝে ছিটকে যায় ক্রিকেট আঙ্গন থেকে।

এইবার কিছুটা প্রশ্ন কমন পড়ছে তাইতো? আমি শুধু একটা জেলার দৃষ্টিকোন থেকে বলছি। তবে অন্যান্ন জেলার বন্ধুদেরও যে একই অবস্থা তা আমি নিশ্চিত করে বলতে পারি।

ক্রিকেটার তুলে আনার ক্ষেত্রে ক্রিকেট বোর্ডের অবদান নেই, যা করছে জেলা পর্যায়ের কোচরা করছেন, বিবিসি বাংলাকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে এ কথা বললেন বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডের সাবেক কোচ পারভিন নাসিমা নাহার পুতুল। পুতুল আপার এই কথা এক সময় সত্য হলেও, সেই নিয়ম তিলে তিলে ভেঙ্গে দিয়েছে সিন্ডিকেট। ভেঙ্গে দিয়েছে যোগ্যতার কদর করার নিয়ম। পার্ফর্মেন্সের ভিত্তিতে উঠে আসা ক্রিকেটারের বদলে সহজ পদ্ধতিতে পরিচিত ফেস দেখে সিলেকশনের পথেই হেটেছে সিন্ডিকেট।

ক্রিকেটের শ্রেণী এবং ক্রিকেটের সংগ্রাম এই দুটো মিলে বলা যেতে পারে ক্রিকেটে শ্রেনীর যে সংগ্রাম তাই ক্রিকেটের শ্রেণীসংগ্রাম। ক্রিকেটের আবার শ্রেনী কি! স্কুল ক্রিকেট, বয়স ভিত্তিক ক্রিকেট, আন্তজেলা ক্রিকেট, আন্তবিভাগ ক্রিকেট নাকি জাতীয় দল? যদি বলি সব গুলোই। এই সকল যদি এক শ্রেনীর হয় তবে সংগ্রাম আবার কোন শ্রেনীর বিরুদ্ধে? আম্পায়ার, কোচ, টিম ম্যানেজমেন্ট নাকি বোর্ড? না একটিও নয় আবার সবার বিরুদ্ধেই। সংগ্রামটা মূলত সিন্ডিকেটের বিরুদ্ধে। সংগ্রামটা অপচর্চা এবং অপসংস্কৃতির বিরুদ্ধে। সংগ্রাম হচ্ছে স্পোর্টসম্যানশিপ ফিরিয়ে আনার লড়াই।

বহুল আলোচিতো আবাহনী ও মোহামেডানের ম্যাচে স্পোর্টসম্যানশিপের পরিচয় দেননি বেশ্ব সেরা অলরাউন্ডার সাকিব আল হাসান। এর জন্য ৩ ম্যাচ না খেলতে পারার শাস্তিও পেলেন তিনি। এবার চিন্তা করুনতো আমাদের মত প্রাথমিক স্তরের খেলোয়াড় অথবা সাবেক খেলোয়াড়রা কিংবা কোচরা অনেক চেষ্টা করেও এই সিন্ডিকেটের বিরুদ্ধে গিয়ে ভালো খেলোয়াড়দের ন্যায্য স্থানে তুলে আনতে পেরেছি? দীর্ঘদিন ধরে জেঁকে বসা এই অপসংস্কৃতি চর্চাকারীদের মাথার একটা চুলও নড়াতে পারেনি আমি বা আপনি। সেই যায়গা থেকে এর প্রতীবাদ স্বরুপ বিশ্বের এক নম্বর খেলোয়াড় যদি এর বিরুদ্ধে দাঁড়ায় তবে ক্রিকেট বাঁচানোর প্রশ্নে আমাদের তার পক্ষে না বিপক্ষে থাকা উচিৎ সেই সিদ্ধান্ত আপনার বিবেকের। আপনি আমি যা পারিনি আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য তা উপহার দিয়ে যাওয়াটা আমার দায়িত্ব মনে করেই আমি সাকিবের পাশে দাঁড়াতে চাই। তাই ম্যাচের মধ্যে ষ্ট্যাম্পে লাথি মাড়াটা আমি সিন্ডিকেট বা অপসংস্কৃতি চর্চাকারীদের মুখে লাথি মাড়ার সমান মনে করি। একইসাথে একটি যুক্তি খুব পরিষ্কার হওয়া উচিৎ, যখন ভদ্রলোকের খেলা অভদ্রলোকদের দ্বারা নিয়ন্ত্রীত হয় তখনও খেলাটিকে ভদ্রলোকদের খেলা প্রমান করতে চাওয়া মানে অভদ্রলোকদের ব্যবসার খুঁটি আরো পোক্ত করা। তাই বাংলাদেশের ক্রিকেটের ভবিষ্যৎ রক্ষা করতে আপনি এই শ্রেণী দ্বন্দ্বের কোন প্রান্তে অবস্থান করছেন তা বেশ গুরুত্ব বহন করে। এই সিদ্ধান্তের প্রেক্ষিতেই শুরু হতে পারে ক্রিকেটীয় শ্রেনী সংগ্রামের যাত্রাটা। শুরু হতে পারে অপসংস্কৃতির বিরুদ্ধে গিয়ে প্রকৃত সংস্কৃতি চর্চার যাত্রাটা। সাকিব এখানে সেই যাত্রার এক বলী হিসেবে কাজে লাগতে পারে। সিদ্ধান্ত আমার এবং আপনার আমরা এই কুরবানি শিকার করবো কি করবোনা।-লেখক: একজন সংবাদ কর্মী।

*মতামত বিভাগে প্রকাশিত সকল লেখাই লেখকের নিজস্ব ব্যক্তিগত বক্তব্য বা মতামত।