Home মতামত কেটে গেল সাপ্তাহিক সিমেকের তেরোটি বছর!!

কেটে গেল সাপ্তাহিক সিমেকের তেরোটি বছর!!

58

ইঞ্জিঃ সরদার মোঃ শাহীন:

আজ থেকে ঠিক ১৩ বছর আগে ম্যাজিষ্ট্রেট মহোদয় যেদিন আমাকে তাঁর জজকোর্টের এজলাশে ডাকলেন, সেদিন বুঝিনি একটা পত্রিকার প্রকাশনা কতটা কঠিন হতে পারে। জটিল হতে পারে। পুরো দায়িত্ব কাঁধে নিয়ে কতটা সাবধানী হতে হয়, সেটাও বুঝিনি সেদিন। মাথায় ছিল কেবল পত্রিকাটি বের করার চিন্তা; জাষ্ট এতটুকুই। এর বেশি বোঝার ক্ষমতা তখন আদৌ ছিল কি না, কিংবা থাকলেও সেটা বোঝার চেষ্টা করেছিলাম কি না, তারও কিছুই মনে নেই। কেবল এটুকু মনে আছে, ম্যাজিষ্ট্রেট মহোদয় ঘাড় ঘুরিয়ে দু’তিন বার আমায় দেখলেন। দু’তিনটি প্রশ্নও করলেন। কিন্তু একবারও ভ্রু কুঁচকাননি। ভ্রু কুঁচকালেন একেবারে শেষ প্রশ্নে। ভ্রু’র সাথে থুতনিটাও একটু বাঁকিয়ে বললেন, সিমেক শব্দটির মানে কি?
আমি একটুও অবাক হইনি তাঁর প্রশ্নে। কেননা জীবনে বহুবার বহুজনকে এর উত্তর দিতে হয়েছে। এবং দিয়েছি। এবারও ম্যাজিষ্ট্রেট মহোদয়কে দিলাম। তিনি সন্তুষ্ট হলেন বলে মনে হলো না। আবার খুব যে অসন্তুষ্টও হয়েছেন, সেটাও বোঝা গেল না। তিনি মাঝামাঝি থাকলেন। সন্তুষ্ট আর অসন্তুষ্টের ঠিক মাঝামঝি অবস্থানে থেকে তিনি নিমরাজী হলেন। এবং কাগজে সাইন দিতে দিতে মাথা নীচু করে বিড়বিড় করে শুধু বললেন, “নামটা বাংলায় হলে ভাল হতো। মানুষ সহজে বুঝতে পারতো।”
সহজে কোন কিছু মানুষের বোঝার জন্যে এদেশে যুগে যুগে নামের যে শ্রী হয়েছে তা ব্যাখ্যা দেবার সাহস পাইনি। ইখতিয়ার উদ্দিন মোহাম্মদ বিন বখতিয়ার খিলজি’র কথা বাদই দিলাম। নামটি এত বড় কেন, বা নামের অর্থই বা কি কে জানে! ধরলাম এটা বহু আগের কথা। আবু নাসের মোহাম্মদ তৈয়ব উদ্দিন খান তো বেশি দিন আগের না। আর বর্তমানই বা কম কিসের! ‘আবু হেনা সাদত আব্দুল্লাহ আল আনসারী কামাল বোগদাদী’ও তো বর্তমানেরই নাম। এগুলো কি সহজে বোঝার জন্যে রাখা হয়েছে, নাকি মাহাত্ম ভিন্ন কে জানে!
এ তো গেল মানুষের নামের শ্রী। এতগুলো শব্দের সমন্বয়ে রাখা নামের মধ্যে বাংলা শব্দ না থাকলেও হিন্দি, উর্দু, ফারসী কিংবা আরবী; সব ভাষার শব্দই আছে। যদিও কারো বাপের সাধ্য নেই এর অর্থ বোঝার। আবার কেউ বোঝার চেষ্টাও করে না। এদেশে সকল পত্রিকার নাম কি বাংলায় রাখা হয়েছে? মিল্লাত, ইত্তেফাক, ইনকিলাব কিংবা ডেসটিনি; সবই তো দেশের পত্রিকা। এসবের একটিও বাংলা শব্দ নয়; এবং এর অর্থও দেশের অধিকাংশ মানুষ জানে বলে আমার মনে হয় না।
তবে খুঁজলে এসবের ভাল অর্থ মিলবে; এটা আমি বিশ্বাস করি। কিন্তু বাংলাদেশের বিভিন্ন জায়গার নাম যেভাবে অবিশ্বাস্য যুক্তিতে রাখা হয়েছে সেটা বিশ্বাস করতে আমার কষ্ট হয়। নাম যদি হয় ‘মানুষ মারা’। কষ্ট তো একটু হবেই। এটি বাংলাদেশের একটি গ্রামের নাম। চুমাচুমি’ও তেমনি একটি নাম। পার্বত্য চট্টগ্রামের গ্রাম। গলাচিপা কিংবা বড়বালের কথা কে না জানে। আরো আছে। তবে লেখার অযোগ্য। জঘন্য রকমের অযোগ্য।
এসবের তুলনায় ‘সিমেক’ চমৎকার একটি নাম। যার অর্থ – সম্ভাবনা জাগিয়ে তোলা। অর্থটি ম্যাজিষ্ট্রেট মহোদয়কে বলা লাগেনি। প্রচন্ড দয়াপরবশ হয়ে সিমেকের অর্থটি আমার কাছ থেকে না জেনেই তিনি তাঁর সামনে রাখা শপথনামায় স্বাক্ষর করিয়ে সাপ্তাহিক সিমেকের অনুমতি দিয়ে দিলেন। আমি অবাক। এবং প্রচন্ড খুশি। সারাদিন না খেয়ে কোর্টের বারান্দায় কাটিয়ে দেয়া এই আমি যারপরনাই খুশি হয়েছিলাম পত্রিকার অনুমতি পত্রটি হাতে পেয়ে।
অনুমতি পত্রটি হাতে পাবার অনেক আগের কথা। ডিনার কোন রকম সেরে শোনিমের আম্মু আর আমি বসেছি নাম রাখা বিষয়ক মিটিং এ। কঠিন মিটিং। প্রকাশিতব্য পত্রিকার নাম রাখা বিষয়ক মিডনাইট মিটিং। আমি ‘সময়ের আলো” নামটি মোটামুটি ঠিক করে ফেলেছি। একা একাই ঠিক করেছি। মনে হচ্ছিল এর চেয়ে যুৎসই নাম আর হয় না। শোনিমের আম্মু শুনবে আর টুপ করে লুফে নেবে। বাজার দখলে প্রথম আলো আর আমাদের সময়। এই দুটিকে মিলিয়ে একটি নাম ‘সময়ের আলো’; পারফেক্ট নাম।
নাহ! শোনিমের মায়ের এতে ঘোর আপত্তি। তার কথা পরিষ্কার। প্রস্তাবিত নামের মধ্যে নতুনত্বের কিছু নেই। আছে কেবল চুরি। শুরুতেই চুরি নিয়ে যাত্রা শুরু করলে বাকী জীবন যাবে শুধু চুরি করতে করতে। চুরি করা লাগবে কেন? আর বাজারের প্রচলিত নামই বা রাখা লাগবে কেন? নাম হবে ইউনিক। নতুন নাম, নতুন গন্ধ। হোক সেটা যে ভাষারই। ভাষা কখনোই কোন জাতির বা দেশের নয়। ভাষা কেবলই একটা টুলস। যোগাযোগের মাধ্যম। ভাষা কোন জাতিকে বানায় না। জাতি ভাষা বানায়। এদেশ থেকে, ওদেশ থেকে নানা শব্দ নিয়ে নিত্যদিন মানুষ ভাষার মধ্যে নতুনত্ব আনে। সিমেক তেমনি বাংলা ভাষার একটি নতুন শব্দ হবে।
মনে ধরলো যুক্তিটা। আর শেষ হলো পত্রিকার নাম রাখা বিষয়ক মিটিং। তার পরেরটা ইতিহাস। গেল তের বছরের একটা লম্বা ইতিহাস। সময় কত দ্রুত এগিয়ে চলে! বলতে বলতে আজ তেরটি বছর পার হয়ে গেল! সময় বদলেছে। কিন্তু গর্বের সাথে বলতে পারি আমরা বদলাইনি। বদলায়নি আমাদের পত্রিকার চরিত্র। প্রকাশের সেই প্রথম দিন যেমন ছিলাম, যেমন ছিল আমাদের চরিত্র; আজো ঠিক তেমনই আছি।
শুধুমাত্র পজিটিভ নিউজের ডালা নিয়ে আমরা হাজির হচ্ছি পাঠক দরবারে। হাজারো নেগেটিভ নিউজের ভীড়ে আমরা প্রতিনিয়ত খুঁজে বেড়াই কেবলই পজিটিভ নিউজ। নেগেটিভ নিউজের পাঠক প্রিয়তা প্রচন্ড রকমের বেশি জেনেও আমরা সেদিকে হাঁটিনি। আমরা প্রচার সংখ্যায় বড় হতে চাইনি। আদর্শে বড় হতে চেয়েছি। পাঠক সংখ্যায় বড় হতে চাইনি। আদর্শে অটুট থাকতে চেয়েছি।

আদর্শ ধরে রাখার জন্যে এবং প্রত্যেক পাঠকের কাছে নিজেদের অবস্থান পরিষ্কারের জন্যে আমাদের চেষ্টা এবং উদ্যোগের কোন কমতি শুরু থেকেই ছিল না। এবং এখনো নেই। এটা বোঝার জন্যে আমাদের নিউজগুলো যেমনি বিচার্য, তেমনি বিচার্য আমাদের মুখোশবিহীন রূপ। একটু লক্ষ্য করলেই দেখবেন, সিমেকের প্রথম পাতার উপরের দিকের বামপাশে নিত্যবার ছাপা হচ্ছে আদর্শের নিত্যতার কথামালা; “নেতিবাচক বা হতাশার নয়; ইতিবাচক সংবাদ, সুসংবাদ, সাফল্য এবং উন্নয়নের সংবাদ নিয়েই আমাদের নিয়মিত আয়োজন।”
এসবে তেমন লাভ হয়নি। বরং সরকারের এত্তএত্ত সাফল্য এবং উন্নয়নের সংবাদ নিয়মিত ছাপাবার কারণে পাঠককুলে সন্দেহ বেড়েছে বেজায় রকমের। পাঠক না কমলেও বেড়েছে দালালী চরিত্রের তকমা। পাঠককুলের বড় একটি অংশ ‘সরকারের দালাল’ হিসেবে আমাদের গায়ে তকমা লাগিয়ে দিয়েছে। পাশাপাশি সরকারী দলের লোকজনও তাদের রাজনৈতিক সংবাদ না ছাপানোতে আমাদের উপর বেজায় নাখোশ। কেউ কেউ বর্ণচোরা ‘জামাতী’ হিসেবেও দেখার চেষ্টা করছেন।
বিপদ আমাদের সবদিকে। কেউই আমাদেরকে আমাদের মত করে দেখার চেষ্টা করেনি। করেছে ঠিক তাদের মত করে দেখার। দুঃখটা কেবলই আমাদের ঠিক এই জায়গায়। কী হতো আমাদেরকে আমাদের মত করে দেখলে! আমাদের মত করে দেখলেই এক নতুন কনসেপ্ট দেখতে পেতো সবাই! দেখতে পেতো বাংলাদেশের প্রথম পত্রিকা!! শুধু ভাল সংবাদের সমারোহে নিয়মিত ছাপানো সম্পূর্ণ নতুন ধারার একটি সাপ্তাহিক পত্রিকা!!!