Home বাণিজ্য ও অর্থনীতি কমেছে আয়, বেড়েছে দ্রব্যমূল্য

কমেছে আয়, বেড়েছে দ্রব্যমূল্য

57

ডেস্ক রিপোর্ট: নূর আলী ও আফিয়া সুলতানার ছোট্ট পরিবারটি ছিল পুরো এলাকার আদর্শ। নূর আলীর ছোট ব্যবসা আর আফিয়ার কিন্ডারগার্টেন স্কুলের শিক্ষকতার চাকরি। দুই জনের আয়ে দুই ছেলেমেয়ের লেখাপড়াসহ সবকিছু ভালোই চলছিল। করোনায় নূর আলীর ব্যবসা পুরোই শেষ। আর আফিয়া সুলতানার স্কুল বন্ধ হয়ে গেছে। সম্বল কেবল কয়েকটা বাচ্চাকে বাসায় গিয়ে পড়ানো।

আফিয়া জানান, ছেলে ইউনিভার্সিটিতে পড়ে, সে নিজে টিউশনি করে নিজের লেখাপড়ার খরচ চালাচ্ছে আর ছোট মেয়েটার লেখাপড়া চালানোই এখন মুশকিল হয়ে পড়েছে। কারণ আয়-রোজগার না থাকায়, তিন বেলা কোনো রকম খেয়ে বাঁচতে হচ্ছে। আফিয়া বলেন, ‘এখন প্রায়শই বাবার বাড়ি থেকে এটা সেটা এনে সংসার চালাচ্ছি, কাউকে কিছু বলা যাচ্ছে না। করোনায় আয় কমে গেছে কিন্তু বাজারে দিনে দিনে দ্রব্যমূল্য বাড়ছে। গত দুই বছরে খুব কাছের কোনো আত্মীয়ের বিয়ে কিংবা জন্মদিনে আমরা যেতে পারিনি। কারণ সামর্থ্যে ওসব আর কুলোয় না…।’

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বৈশ্বিক মহামারি করোনা মধ্যবিত্তদের রীতিমতো ‘চিড়েচ্যাপটা’ করে দিয়েছে। রাজধানীসহ সারা দেশে মধ্যবিত্তের আয় কমেছে অথচ দ্রব্যমূল্য বেড়ে যাওয়ায় ব্যয় বেড়েছে। বিভিন্ন গবেষণা সংস্থার জরিপে উঠে আসা তথ্যমতে, করোনার এ সময়ে আয় কমেছে দেশের ৬০ শতাংশেরও বেশি কর্মজীবীর। অনেকের ব্যবসা বন্ধ হয়ে গেছে। এতে সবচেয়ে বেশি সংকটে পড়েছেন দেশের চাকরি, ব্যবসাসহ নানা পেশায় জীবিকানির্বাহ করা মধ্যবিত্তরা। এই শ্রেণির অনেকেই করোনাকালে চাকরি হারিয়েছেন, আবার কারো বেতন কমিয়ে দেওয়া হয়েছে। পাশাপাশি অন্য কাজের উত্সগুলোও বন্ধ হয়ে গেছে। অথচ সংসার চালানোর নিত্যপণ্যের দাম বেড়েই চলেছে। সামাজিক অবস্থান ধরে রাখতে কেউ কেউ বাধ্য হয়ে সঞ্চয় ভেঙে খাচ্ছেন। কারো সংসারের খরচ কমাতে কমাতে দেওয়ালে পিঠ ঠেকেছে কিন্তু বলতে পারছেন না। রাজধানীসহ সারা দেশের মধ্যবিত্তের চেহারায় এখন বিষণ²তার ছাপ স্পষ্ট।

তারা বলছেন, দেশে সব কিছুতেই মধ্যবিত্তের অংশগ্রহণ সবচেয়ে বেশি। দেশের রাজনীতি, উন্নয়ন ও অর্থনীতিতে মধ্যবিত্তের অংশগ্রহণ উল্লেখযোগ্য। অথচ রাষ্ট্রীয়ভাবে মধ্যবিত্তদের সুনির্দিষ্ট কোনো সংজ্ঞা নেই। সমাজবিজ্ঞানীদের মতে, যাদের দৈনিক আয় ১০ থেকে ৪০ ডলারের মধ্যে, দেশে তারাই মধ্যবিত্ত। এ হিসাবে মধ্যবিত্তের মাসিক আয় ২৫ হাজার থেকে ১ লাখ টাকার মধ্যে। যে কোনোভাবে আয় করে যারা এ ধরনের একটি সামাজিক মর্যাদা তৈরি করেছেন, তারাই মধ্যবিত্ত। এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক বলছে, এক ব্যক্তির ক্রয় ক্ষমতা (পিপিপি) যদি প্রতিদিন দুই মার্কিন ডলার থেকে ২০ মার্কিন ডলারের মধ্যে হয় তবে তাকে মধ্যবিত্ত বলা যায়। এ হিসাবে বাংলাদেশে মধ্যবিত্ত ৩ কোটি ৭ লাখ। বিশ্বব্যাংকের মধ্যবিত্তের আয়ের হিসাবটি একটু বেশি। যাদের প্রতিদিন আয় ১০ থেকে ৫০ ডলার, তারা মধ্যবিত্ত। তবে বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে দুই থেকে চার ডলার প্রতিদিনের আয় হলেই মধ্যবিত্ত। সেই হিসাবে যার মাসিক আয় ৪০ হাজার থেকে ৮০ হাজার টাকা, সে-ই মধ্যবিত্ত। এটি বাংলাদেশের মোট জনগোষ্ঠীর ৩০ ভাগ। ১৬ কোটি মানুষের হিসেবে সেই সংখ্যাটি দাঁড়ায় ৪ কোটি ৮০ লাখ।

করোনায় নিম্ন আয়ের লোকজন সরকার ও বিত্তবানদের কাছ থেকে নানা সাহায্য-সহায়তা পেলেও মধ্যবিত্তরা সামাজিক মর্যাদা রক্ষায় কারো কাছে হাত পেতে সাহায্য নিতে পারেনি। তাদের সহায়তা দিতেও সরকার কিংবা বিত্তবানরা কেউ এগিয়ে আসেননি। এর মধ্যে বাজারে প্রতিটি পণ্যের দাম বেড়ে গেছে। মধ্যবিত্ত পরিবারের ছেলেমেয়েদের একটি বড় অংশ নিজের লেখাপড়া নিজেই টিউশনি করে চালাতেন। স্কুল-কলেজ বন্ধ থাকায় সে আয়ের পথও প্রায় বন্ধ। ফলে মধ্যবিত্ত পরিবারগুলো চরম আর্থিক দুরবস্থার মধ্যে পড়েছে।

করোনাকালে মধ্যবিত্তের দুর্বিষহ জীবনচিত্র উঠে এসেছে বিভিন্ন গবেষণা প্রতিবেদনে। সরকারি গবেষণা সংস্থা বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) এক গবেষণায় বলা হয়েছে, দেশে করোনা ভাইরাসের প্রভাবে চাকরি হারিয়েছেন প্রায় ১৩ শতাংশ মানুষ। আয় কমেছে প্রায় ৬০ শতাংশ মানুষের। ব্র্যাকের এক গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়, করোনার প্রভাবে ৩৬ শতাংশ মানুষ চাকরি হারিয়েছেন। ৩ শতাংশের চাকরি থাকলেও বেতন পান না। এদের বড় অংশই মধ্যবিত্ত।

উন্নয়ন অন্বেষণের এক গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়, বাংলাদেশে ৯০ লাখ মানুষ আনুষ্ঠানিক খাতে চাকরি করেন। এর মধ্যে ১৫ লাখ সরকারি খাতে। বাকি ৭৫ লাখ মানুষ বেসরকারি খাতে। অনানুষ্ঠানিক খাতে কাজ করেন ৬ কোটি ৮ লাখ মানুষ। করোনার কারণে বাংলাদেশে বেসরকারি খাতের চাকরির আয় এরই মধ্যে ঝুঁকির মুখে পড়েছে। একটি অংশের চাকরি আছে কিন্তু বেতন নেই। আবার কারো বেতন কমে গেছে। এসএমই সেক্টরেও ধস নেমেছে।

তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা রাশেদা কে চৌধুরী বলেন, বিভিন্ন স্বাধীন গবেষণায় দেখা গেছে, অর্থনীতির সুফল সবার মধ্যে পৌঁছায় না। কেউ কেউ সম্পদের পাহাড় গড়ছেন। অন্যদিকে খেটে খাওয়া মানুষের কষ্ট বাড়ছে। সবক্ষেত্রে বৈষম্য বিরাজ করছে। আমরা বঙ্গবন্ধুর দেখানো পথ থেকে সরে এসেছি। কল্যাণমূলক রাষ্ট্রের যে ধারণা সেখান থেকে সরে গেছি। আমরা অবকাঠামোগত উন্নয়ন নিয়ে ভাবছি কিন্তু মানবসম্পদ উন্নয়ন নিয়ে ভাবছি না। আমাদের সংসদ এখন ব্যবসাবান্ধব, সামাজিক সুরক্ষাবান্ধব নয়।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকল্যাণ ও গবেষণা ইন্সটিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক, তৌহিদুল হক বলেন, মধ্যবিত্তের একেক পরিবারের সমস্যা একেক রকম। আমাদের দেশে ৮৭ শতাংশ পরিবার এক জনের উপার্জনে চলে। ফলে করোনাকালে এক জনের উপার্জনে চলা পরিবারগুলো বেশি সংকটে পড়েছে। এই সমাজবিজ্ঞানী বলেন, মধ্যবিত্তের সংকট যে বেড়ে গেছে, তার বড় প্রমাণ টিসিবির দীর্ঘ লাইন। যারা আগে ঐ লাইনে দাঁড়াত না, তাদেরও এখন সেখানে দেখা যায়। নিত্যপণ্যের বাজার নিয়ন্ত্রণে আনতে পারলে এ সমস্যার অনেকটা সমাধান হতে পারত বলে জানান তিনি।-ইত্তেফাক