Home মতামত এক নিরন্তর অনুপ্রেরণার নাম তোয়াব খান

এক নিরন্তর অনুপ্রেরণার নাম তোয়াব খান

32

তারিক আনাম খান: তোয়াব খান আমার মামা। পারিবারিক আন্তরিক ভাষায় আমার ‘কেলো মামু”। তিনি একাধারে আমার মামা। অর্থাৎ মায়ের আপন মামার ছেলে। তিনি আবার আমার আপন ফুফাতো ভাই। বৈবাহিক সূত্রে আবার আমার দুলাভাই। তবে
তিনি ছিলেন আমার কেলো মামু। হয়তো কেলো মামুর মধ্যে অদ্ভুত এক নিবিড়তা, এক আপন গন্ধ খুঁজে পেতাম বলেই তিনি সব সম্পর্কের ওপরে আমার মামু।

আবার বয়সে তিনি আমার মায়ের পিঠাপিঠি ছিলেন।
মাত্র এক বছরের বড় ছিলেন আমার মা। তাই
‘কেলো মামু’ শব্দ দুটোর সঙ্গে হাজির হয়ে যেত
আমাদের ছোটবেলা, আমাদের গৌরব, আমাদের
অনুকরণের এক নাম। এই খাঁ পরিবারের সঙ্গে
অনুকরণীয় সব নাম আমাদের ফুফাতো ভাইদের
মধ্যেই ছিল। যেমন- শফি খান, ডা. এম আর
খান, সহি খান- তেমনই একজন তোয়াব খান।
আমাদের ভাইবোনসহ অনেকের কাছে
বিস্ময় ছিল এ রকম অসম্ভব ফর্সা, সুদর্শন
একজন মানুষের নাম ‘কেলো’ কী করে হয়!
আর এই মানুষটাকে সিনেমায় কেউ ‘চান্স’ দেয়
না কেন?

তোয়াব খান আমার জন্মের আগে
থেকেই সাংবাদিক। জীবনের শেষ দিন পর্যন্তও
সাংবাদিক। আমাদের বাড়িতে সংবাদপত্র পাঠ ছিল
একটি নিয়মিত অভ্যাস। আমার চাচারাও
সংবাদপত্রের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে জড়িত ছিলেন।
সেই আজাদ পত্রিকা ও মওলানা আকরাম খাঁর
আমল থেকে পত্রিকার সঙ্গে এই পরিবারের
ঘনিষ্ঠতা শুরু। এ কারণে পত্রিকা, সংবাদপত্র,
খবর মানেই কেমন যেন আত্মীয় আত্মীয় গন্ধ
লাগে। বাড়িতে খবরের কাগজ কমপক্ষে দুটো
আসতই। পড়ার প্রতি খবর জানার প্রতি যে
প্রবল আগ্রহ তার বড় কারণ ছিলেন আমার
চাচা শামসুল আনাম খান, আর অবশ্যই তোয়াব
খান।

প্রথমে পড়তাম ‘সংবাদ। মনে হতো কি
সাহসী, অকুতোভয় আর প্রগতিশীলতা।
পত্রিকাটির সাহিত্য পাতাটাও ছিল অদ্ভুত
আকর্ষণীয়। সঙ্গে থাকত ‘পূর্বদেশ’, পরে দৈনিক
পাকিস্তান। দৈনিক পাকিস্তান তখন সরকারি
পত্রিকা। কিন্তু সেখানে মিথ্যাচার অন্তত ছিল
বলে মনে হতো না। তার কারণ এ পত্রিকায়
ছিলেন তোয়াব খানসহ সে সময়কার অকুতোভয়
সংবাদকর্মীরা। আর দৈনিক পাকিস্তানের বড়
কৃতিত্ব তার ছাপা, লেখা, চলতি কথ্য ভাষা
আর ঝকঝকে চৌকস প্রকাশনা। ছোটদের
পাতা, সাহিত্য পাতা কী ভীষণ আকর্ষণীয় আর
আধুনিক। এই যে তোয়াব খানসহ একদল
তেজি মানুষ সংবাদপত্রে কাজ করার ঝুঁকি
জেনেও এই সাংবাদিকতা পেশাকেই ধ্যান,
জ্ঞান করেছেন, তা আজও বড় প্রেরণার।

তখন সাংবাদিকদের চাকরির নিরাপত্তা আর বেতনও
খুব বেশি ছিল না। সেটিও আমরা জানতাম।
তোয়াব খান, আমার কেলো মামু আপাদমস্তক একজন সাংবাদিক। ঢাকায় এসে তার কাছাকাছি কদিন থেকে দেখেছি তার দেখা পাওয়াটাই ছিল দুঃসাধ্য। সংবাদপত্রের কাজ শেষে গভীর রাতে তিনি বাড়ি ফিরতেন। আবার সকালে উঠেই নিজের কাগজখানায় একবার চোখ বুলিয়ে অন্য কাগজে কী ছাপা হলো তা খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখতেন। ভুল কিছু
লিখলে সেটার যুক্তি-তথ্য দিয়ে বাড়ির সবাইকে
জানাতেন। কিংবা খবরের ভেতরের খবরটা
মাঝে মাঝে প্রকাশ করতেন। কিন্তু ওই যে
সাংবাদিকরা যেমন ‘সোর্স’ জানান না, তেমনি
তার বাড়ির লোকজনও জানতে পারতাম না
খবরের উৎস। তবে খবর নিয়ে বাড়ির লোকের
সমালোচনা তিনি শুনতেন।

মাঝে মাঝে আমার কাছে তাকে রহস্যমানব মনে হতো। ব্যক্তিজীবনে একেবারেই বাহুল্যবর্জিত আপাদমস্তক ভদ্রলোক মানুষ ছিলেন আমার মামু তোয়াব খান। কোনো কিছু নিয়ে তাকে কখনো বাড়াবাড়ি করতে দেখিনি। পোশাক, খাওয়া দাওয়া, ঘর-দুয়ার নিয়ে তার বাড়াবাড়ি ছিল না। এ রকম অভিযোগহীন, কাজে ও সংবাদপত্র সৃজনে মগ্ন অতিমাত্রার ভদ্রলোক তোয়াব খান তাই অনুকরণীয় দৃষ্টান্ত।

এ অবস্থার ব্যত্যয় কোনো দিন দেখিনি,
এমনকি যখন তোয়াব খান রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ
ক্ষমতার কাছাকাছি থেকেছেন, তখনও দেখিনি।
শৃঙ্খলা, কর্মনিষ্ঠা আর পেশাদারত্বের চূড়ান্ত
নিদর্শন হয়ে তিনি থেকেছেন। তার বাম হাতও
বোধ হয় জানতে পারত না, ডান হাত কী
করছে। ক্ষমতার এত কাছাকাছি থেকেও কত
সুবিধাই তো কত লোক করে নেয় বা নিতে
পারে। কিন্তু সেখানেও তোয়াব খান নির্লোভ
ছিলেন।

একেবারে আপন চেষ্টা, শ্রম ও নিষ্ঠায়
তোয়াব খান নিজেকে এতদূর নিয়ে গেছেন, তা
আমাদের কাছে অনুকরণীয় ও অনুপ্রেরণার উৎস
হয়ে ছিল, থাকবে। তেমনি সংবাদপত্র, সংবাদ,
সাংবাদিকতা যে একটি সৃজনশীল ও সার্বক্ষণিক
পেশা, তা তোয়াব খানের নামের সঙ্গে জড়িয়ে
আছে, থাকবে। নির্লোভ ও একনিষ্ঠ হয়ে নিজ
কর্মের প্রতি মগ্ন থেকে অভিযোগহীন এক
জীবনযাপনে অনুপ্রেরণা আমার কেলো মামু-
আছেন, থাকবেন।

-লেখক : বিশিষ্ট অভিনেতা ও নাট্যকার এবং তোয়াব খানের ভাগনে।