Home মতামত একজন সাধারণ বাবার সাধারণ গল্প!!

একজন সাধারণ বাবার সাধারণ গল্প!!

49

সরদার মোঃ শাহীন:

ছেলেবেলার কথা। টানাটানির অস্বচ্ছল সংসারে মায়ের আশা, ছেলেকে বিএসসি ইঞ্জিনিয়ার বানাবেন। সংসারে ঘানি টানার টানাটানি ঘুচবে ছেলেটা কেবল ইঞ্জিনিয়ার হলেই। অভাব দূর হয়ে প্রাচুর্য্যতা আসবে। আসবে স্বচ্ছলতা, শান্তি এবং সুখ। আশেপাশের পরিবেশ মধ্যবিত্ত পরিবারের মাকে এই শিক্ষাটাই দিচ্ছিল। তখনকার সামাজিক পরিবেশটাই এমন ছিল। দারিদ্র্য বিমোচনের একমাত্র পথ ডাক্তার অথবা ইঞ্জিনিয়ার হওয়া।
তখনকার সময়ের সার্বিক পারিপার্শ্বিকতাই আমার মায়ের আশাটাকে এমন ভাবে পোক্ত করে দেয়। মায়ের আশাটা আমার স্কুল জীবন থেকেই। স্বাধীনতা উত্তর বাংলা যখন অভাব আর দারিদ্রতার কষাঘাতে সাংঘাতিকভাবে পর্যুদস্ত, তখন শুধু আমার মা কেন, সব মায়েরাই এমনটা কামনা করতেন। অন্তত আমাদের আশপাশের সব মায়েরা তো করতেনই। সমাজটাই এমন ছিল তখন। কার কাছ থেকে যেন মা জেনেছেন, পড়াশোনায় সাবজেক্ট আছে মাত্র দুইটা। মেডিক্যাল আর ইঞ্জিনিয়ারিং। দুইটাতেই উপরি আয় প্রচন্ড। কাজকর্ম তেমন কিচ্ছু করা লাগে না। কেবল কাগজে সাইন করো আর টাকা গোনো।
দু’টো বিষয়ের মধ্যে বেশি রোজগারপাতি হয় ইঞ্জিনিয়ারিং এ। কাড়ি কাড়ি রোজগারপাতি। কনফার্ম শট, মাইর নাই কোনো। সন্ধ্যায় ঘরে ফেরার সময় ব্রিফকেস ভর্তি টাকা নিয়ে ফেরা যায়। একবার কেউ ইঞ্জিনিয়ার হলো তো, তার পুরো জীবনের গ্যারান্টি এসে গেল। পেছন ফিরে আর কখনোই তাকে তাকাতে হবে না। যা কিছু তার আছে, সব কেবলই সামনের দিকে। সামনের উজ্জ্বল ভবিষ্যতের দিকে। ইঞ্জিনিয়ার হলে কেবল টাকা মেলে না, বউও মেলে। দেখতে শুনতে বড় ঘরের ভাল একখানা বউ মেলে।
এক কথায় নারী এবং গাড়ি দু’টোরই গ্যারান্টি আছে। গ্যারান্টিটি দিয়েছিল আমার বড় ভাইয়ের বন্ধু। কলেজে পড়ার সময় বড় ভাইয়ের সেই বন্ধু কঠিন একটা বুদ্ধি দিল। বড়ভাই তুল্য মানুষটি তখন পিডিবিতে জব করেন। অনেক লম্বা একটি মই নিয়ে সারাদিন শহরের আনাচে কানাচে দলবল নিয়ে দৌঁড়ে বেড়ান। যেখানেই বিদ্যুৎ ট্রিপ করে, সেখানেই তার দল উপস্থিত। নতুন বিদ্যুৎ কানেকশনও তার দলই করে।
তিনি বললেন ইঞ্জিনিয়ারিংই যদি পড়ি, তাহলে যেন ইলেট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ি। কাজকর্ম তেমন কিচ্ছু না। নতুন নতুন বিদ্যুৎ সংযোগে স্বাক্ষর দেব আর কামাবো। টাকা রাখার জায়গা থাকবে না। ফ্যাক্টরী হলে তো কথাই নেই। ব্যাগভর্তি টাকা দেবে। টাকা কামাবার আরো একটা বিশাল পথ আছে। অবৈধ সংযোগ দেয়া কিংবা বৈধ সংযোগের মিটার রিডিং চুরি করা। এতে গ্রাহকের কাছ থেকে মাসোহারা আসে অগণিত। দারুণ বিষয়। বিদ্যুৎ রাষ্ট্রের, আর টাকা ইঞ্জিনিয়ারের।
আমি তো ভেবে ভেবে মোছ ওঠার আগেই মোছে তেল দেয়া শুরু করে দিয়েছি। এবং তেল দিতে দিতে মোছ না উঠাতে পারলেও একদিন ইলেকট্রিক ইঞ্জিনিয়ারিং এ ভর্তিও হয়ে গেছি। যেন বিশাল এক তেলেছমাতি কান্ড করে ফেলেছি। চারদিক পরিবর্তন হতে শুরু করছে। পরিবর্তন আমার ভাবসাবেও এসে গেছে। এসেছে আমার চলাফেরায়। হাঁটাচলা করি চীফ ইঞ্জিনিয়ারের মত। দোকান থেকে একটা রাবার ষ্ট্যাম্প বানিয়েছি, “ইঞ্জিঃ সরদার মোঃ শাহীন, চীফ ইঞ্জিনিয়ার”।
হাতের সামনে হাবিজাবি কাগজ যাই পাই, তাতেই সিল মারি। আর করি দারুণ একখানা স্বাক্ষর। চীফ ইঞ্জিনিয়ারের স্বাক্ষর। এভাবে স্বাক্ষর করতে করতে নিজের বইখাতা মোটামুটি শেষ করে ফেলেছি। এবং ধরেছি বড় ভাইয়ের খাতা কাগজ। তিনি মহা বিরক্ত। সেদিকে নজর দিয়ে লাভ নেই আমার। আমি আমার কর্ম চালিয়েই যাচ্ছি। সিল মারি আর স্বাক্ষর করি। এভাবে স্বাক্ষর করতে করতে সকালে বাসায় আসা দৈনিক ইত্তেফাকেও স্বাক্ষর করা শুরু করলাম।
বিপদটা হলো ঠিক এখানেই। ঝামেলা পাকালেন আমার বাবা। সেই ছোটবেলা থেকে মা যখন আমাকে ইঞ্জিনিয়ার হতে উৎসাহিত করতেন, বাবা চুপ করে থাকতেন। কিছু বলতেন না। ভাবলেশহীন ভাবে শুধু মায়ের কথা শুনতেন কেবল। নিত্যদিন সংসারের ঘানি টানা মানুষটির যেন কোন ভাবনা নেই, আশা আকাঙ্খাও নেই। আনমনে কোনভাবে বিশাল সংসার নিয়ে দিনটা পার করে দেয়াই যেন তাঁর একমাত্র কাজ।
সেই তিনি এবার মুখ খুললেন। স্বাক্ষরে ভর্তি পত্রিকাটি হাতে নিয়ে আমায় কাছে ডাকলেন এবং আমাকে তাঁর পাশে বসিয়ে বললেন, “বাবা! এই পৃথিবীতে ভালো এবং মন্দ দু’টি কাজ আছে। একটি আরেকটির ঠিক উল্টো। কিন্তু কাজ দু’টি খুব পাশাপাশি চলে। তেমনি দু’টো পথও আছে। আলাদা আলাদা পথ; একটি সহজ এবং অন্যটি কঠিন। যেমন ধরো, মানুষের উপকার করা। এটা ভালো কাজ। তবে কাজটি খুব কঠিন। কাজের পথটিও কঠিন। আবার ধরো, মানুষের ক্ষতি করা। এটা খারাপ কাজ। তবে খুব সহজ কাজ। এবং কাজের পথটিও খুবই সহজ পথ।”
কথাগুলো নরম ভাবে বলে তিনি থামলেন। যেন একটু দম নিলেন। সদ্য রিটায়ারমেন্টে যাওয়া বাবা আমার দুর্বল। কিছুটা অসুস্থও। ভুল বললাম। কিছুটা নয়, বেশ অসুস্থ। ক’দিন আগেই রিটায়ারমেন্টে গেছেন। রিটায়ারমেন্টের দিনই হার্ট অ্যাটাক হয় তাঁর। বাঁচবেন বলে কেউ আশা করিনি আমরা। ঢাকার সোহরাওয়ার্দী হার্ট ইন্সটিটিউটের সিসিইউতে জীবনমৃত্যুর সন্ধিক্ষণে ছিলেন। ভাগ্যের জোরে সে যাত্রায় সেরে ওঠেন তিনি।
কিছুটা দম নিয়ে তিনি এবার বললেন, “আমি তোমার অভাগা বাবা! তোমার ন্যূনতম চাহিদাও ঠিকভাবে পূরণ করতে পারি না। পড়াশোনা করতে তোমার যতসামান্য যা লাগে তাও দিতে পারি না সময় মত। এতে আমার খুব কষ্ট হয়। খুব! তোমাকে কিছু বলার সাহসও আমি হারিয়ে ফেলেছি। উপদেশ দেবার শক্তিও আমার নেই। অস্বচ্ছল, অসহায় বাবাদের এই শক্তি থাকেও না হয়তো। দুঃখী এই বাবাকে তুমি ক্ষমা করে দিও, বাবা!!”
এবার বাবা আমার কাঁদছেন। বালিশে হেলান দিয়ে থাকা আঁধাশোয়া বাবার চোখের কোণ বেয়ে ফোঁটায় ফোঁটায় পানি গড়িয়ে পড়ছে। আমি চুপ করে বসে আছি তাঁর পাশে। আমার পিঠে তাঁর হাত। পৃথিবীর সেরা মানুষটির সেরা স্নেহের হাত! নিজেকে কিছুটা নিয়ন্ত্রণ করে বাবা এবার বলতে শুরু করলেন, “হয়তো বেশি দিন আর আমি নেই! তাই দু’টি কথা বলি তোমায়! মনে রাখবে, মানুষের ক্ষতি করা খুব সহজ। কিন্তু উপকার করা খুব কঠিন। ক্ষতি করার মত সহজ কাজের চিন্তা মাথায় আনবে না কখনো। পারলে মানুষের উপকার করবে। ভাল কাজ করবে। ভাল কাজ করা যত কঠিনই হোক সেটাই করতে চেষ্টা করবে। কখনোই সহজ কাজে সহজ পথে হাঁটবে না। তাতে তোমারও ক্ষতি; সমাজেরও ক্ষতি। সমাজের ক্ষতি তো রাষ্ট্রেরই ক্ষতি, বাবা। তুমি এমন কিছু করবে না যাতে রাষ্ট্রের ক্ষতি হয়। বিদ্যুৎ প্রকৌশলী হয়ে অবৈধ টাকা হাতে নেয়া রাষ্ট্রের ক্ষতি করা। আমি চাই না আমার ছেলে রাষ্ট্রের ক্ষতি করুক।”
কারো ক্ষতি না করে বরং উপকারের দীক্ষাটা আমি বাবার কাছ থেকেই সেদিন পেয়েছিলাম। আর কোন না কোন ভাবে মানুষের কিছুটা উপকারে আসার ইচ্ছেটা আমার জেগেছিল সেই বাবার কথাতেই। ক্লাসের পাঠ্যবইতে পড়েছিলাম জগত সেরা দার্শনিক হাজী মোহাম্মদ মহসিনের দানশীলতার কথা। তাঁর উদারতার কথা। স্যার যখন ক্লাসে হাজী মোহাম্মদ মহসিনের বিভিন্ন উদ্যোগের কথা বলতেন, আমার গায়ের পশমগুলো তখনই দাঁড়িয়ে যেত। ইচ্ছে জাগতো, একদিন আমিও বড় হয়ে মহসিনের মত হবো। ভাল কাজ করবো।
আমার ছোটবেলার সেই সুপ্ত বাসনায় ঘি ঢেলে দিলেন বাবা আমার। ভেঙে দিলেন ভুল পথে যাবার ভুল ভাবনা। সেদিনই পণ করলাম, আর যাই করি, ঘুষ খাবো না। দেশের ভাল ছাড়া ক্ষতি করবো না। আর বাংলাদেশেও থাকবো না। দেশে চাকরি করলে বেতন কম। তাই বিদেশে যাবো। হালাল রুজী করবো। যেই ভাবনা সেই কাজ। পাশ করার পরে দেশের কোথায়ও চাকরির জন্যে চেষ্টা করিনি। টুকটাক ব্যবসা করে চলেছি। আর চেষ্টা করেছি উচ্চ শিক্ষার্থে বিদেশে যাবার।
বাবার পরামর্শে ইঞ্জিনিয়ারিং পাশ করে দেশ ছেড়ে বিদেশ বিভূঁইয়ে যেয়ে জীবনে সফল হতে পেরেছি কি না জানি না। প্রকৃত সফলতার সংজ্ঞাটাও আমার ঠিকভাবে জানা নেই। জানার চেষ্টাও করি না। এসব মাথায়ই নেই না কখনো। শুধু বাবাকে মাথায় রাখি। সারাক্ষণ রাখি। ২৮ বছর আগে কান্নাভরা রাতের একুশে সেপ্টেম্বর আমাকে এতিম করে চিরতরে চলে যাওয়া সাধারণ বাবাই আমার অতি অসাধারণ শক্তি! বেঁচে থাকার অসাধারণ প্রেরণা!!

-লেখক: উপদেষ্টা সম্পাদক, যুগবার্তা ডট কম।