Home মতামত একজন নুরু মিয়া :

একজন নুরু মিয়া :

64

সাইফুল ইসলাম শিশির:
৮ মার্চ সকালে ইউএস-বাংলা এয়ারলাইন্স যোগে কক্সবাজার এসে পৌঁছলাম। বায়ুযানে থাকা অবস্থাতেই এক সুহৃদ মেসেজ পাঠিয়েছে ‘মেরিন ড্রাইভ বন্ধ। ‘সেনাবাহিনী রোড সংস্কারের কাজ করছে।’
মনটাই খারাপ হয়ে গেল। ইদানীং কক্সবাজার আসা মানেই ভিন্ন আকর্ষণ। পাহাড় ঘেঁষে, সাগরের ফেনায়িত ঢেউ দেখে, মেরিন ড্রাইভ ধরে ছুটে চলা। দিগন্ত ছোয়া নীল জলরাশি। মন ছুটে যায় গাংচিলের ডানায় ভর করে দূর নীলিমায়।

আমার সাথে এক বড়ভাই এসেছেন। তিনি সজ্জন ভদ্রলোক, ভ্রমণ পিপাসু ও বটে। দেশ- বিদেশে ভ্রমণে তাঁর অনেক অভিজ্ঞতা। মেরিন ড্রাইভ বন্ধ শুনে, তিনিও কিছুটা দমে গেলেন। দুপুর ১টার মধ্যে আমাদের টেকনাফ পৌঁছাতে হবে। ড্রাইভার মাসুক কক্সের এক উদ্যমী যুবক। মুখে খোচাখোচা দাড়ি। মধ্যএশিয়ান কাজাখদের মতো চেহারা। পাহাড়- উপকূলের সব অলিগলি, রাস্তা- ঘাট তার চেনা।
“স্যার! আমার উপর ভরসা রাখতে পারেন। প্রয়োজনে “মিনি বান্দরবান” হয়ে রেজুখাল দিয়ে মেরিন ড্রাইভে গিয়ে উঠবো।” শুনে স্তম্ভিত হলাম। বলে কী! বান্দরবান ঘুরে টেকনাফ!! পর্তুগিজ নাবিক ভাস্কোডা গামার সেই উত্তমাশাঅন্তরীপ ঘুরে ভারতবর্ষে আগমনের মতো ব্যাপার ।
অবশ্য ভুল ভাংতে সময় লাগেনি। কক্সবাজার থেকে মরিচ্চা হয়ে পাহাড়ি উঁচুনিচু – আঁকাবাঁকা পথবেয়ে রেজুখাল পর্যন্ত নতুন সংযোগ সড়ক নির্মিত হয়েছে। এ পথের নান্দনিকতা হলো পাহাড় কেটে সুরঙ্গের মতো রাস্তা। শতশত ভ্রমণ পিপাসু কক্সে এলে মিনিবান্দরবান বেড়িয়ে যায়। পাহাড়ের ঢালে দু’দণ্ড দাঁড়িয়ে চা-কফি, ফাস্ট ফুড, সোনালী ডাব পান করে। মনে শান্তির পরশ বুলায়। রামুর এই পাহাড়ি অঞ্চল সোনালী সুপারির জন্য বিখ্যাত।
এ পথে না এলে হৃদয় দিয়ে উপলদ্ধি করতে পারতাম না, প্রকৃতি কত সুন্দর। মনে মনে চালক মাসুককে ধন্যবাদ দিলাম।

রেজুখাল হয়ে টেকনাফ- সাবরাং এর পথে ছুটে চলেছি। সম্প্রতি এ পথে একবার, দুবার, বেশ ক’বার এসেছি। তবুও দূর্বার এক আকর্ষণে ছুটে আসি। সাগর- পাহাড় আমাকে হাতছানি দিয়ে ডাকে।

টেকনাফে বিদ্যুৎ অফিসের সামনে ভূমি- রেজিষ্ট্রেশন অফিস। সামান্য কাজ ছিল, সেরে নিলাম। টেকনাফ এসে হারুনের ভাতঘরে না ঢুকে ফেরা দায়। রসনা তৃপ্তির এক নতুন ঠিকানা- “হারুন ভাতঘর।” রোকনুজ্জামান খানের ছড়ার মতো – আয়রে খোকন ঘরে আয়/ দুধ মাখা ভাত কাকে খায়। তাই দু’মুঠো সেখানেই খেয়ে নিলাম।

আর্মি ওয়েলফেয়ার অ্যাসোসিয়েশন’র রেস্ট হাউজ “জলতরঙ্গে রাত্রি যাপনের জন্য উঠেছি। একদম সাগর ঘেঁষে নান্দনিক পরিবেশ। জানালা খুলে বিছানায় যেতেই মনে হলো হাত দিয়ে পানি স্পর্শ করি। দারুণ অনুভূতি, যেন নীল সাগরে ভাসছি।

রাতের সমুদ্র সৈকত যেন নতুন সাজে সেজেছে। আলো ঝলমলে উপকূল। রাতের বেলা ঢেউয়ের মাথায় ফসফরাসের বিচ্ছুরন – আলোর খেলা । দারুণ মনোলোভা ।

সম্প্রতি এক দুর্ঘটনার পর থেকে সাগর তীরের নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার করা হয়েছে। গোয়েন্দা নজরদারি বাড়ানো হয়েছে। জনমানুষের মধ্যে এখন আস্থা ফিরে এসেছে। রাতভর মানুষ ঘুরে বেড়াচ্ছে নির্ভাবনায়।

রাতে হালকা খাবার খেয়ে রিলাক্স মুডে দু’ভাই সাগর পাড়ে গিয়ে বসলাম। জনকোলাহল নেই। শুধু শোঁশোঁ সাগরের গর্জন শোনা যাচ্ছে। ছাতার নিচে হেলান দেয়া চেয়ারে গিয়ে বসলাম। দু’একটা মশার কামড় বিরক্তের উদ্রেক ঘটায়। আলো- আঁধারিতে পাশ থেকে একজন বলে উঠলো “স্যার কয়েল জ্বালিয়ে দেব। মশার কামড়ে টিকতে পারবেন না।” আওয়াজ দিলাম ব্যবস্থা করুন। মাঝ বয়সী একজন কয়েল নিয়ে দৌড়ে এলো। কথা শুনে মনে হচ্ছিল উত্তর বঙ্গের কেউ হবে। পরে নামধাম জানা গেল। নূরু মিয়া, বাড়ি পাবনা জেলার সুজানগর উপজেলায়। দীর্ঘ ২৭ বছর ধরে সে এই সাগর পাড়ে পড়ে আছে। কাজ শুরু করে ছিলো মহাজনের ছাতা/ চেয়ার পাহারা দেয়া। এখনো সেই কাজ করে তবে এখন নিজের ব্যবসা।

নিজভূম ছেড়ে বিভূঁইয়ে কেন সে পড়ে আছে!? জানতে চাইলে নূরু মিয়া একটু বিচলিত হয়ে পড়ে। “দুঃখের খুটিতে হাত দিলেন স্যার! কথা তুলতে চাইনা। বড় দুঃখ লাগে। সব ভুলে থাকতে চাই। কিন্তু পারিনা–” যা বললো নূরু মিয়া, তার মোদ্দা কথা হলোঃ

নূরু মিয়ার জন্ম সুজানগরের এক পশ্চাৎপদ গ্রামে। দুঃখের মধ্যে হাবুডুবু খাওয়া এক দরিদ্র পরিবার। যে বয়সে তার স্কুলে যাবার কথা ছিল, সেই বয়সে সে মানুষের বাড়িতে ফুট ফরমাশ খাটা শুরু করে। গ্রামের মানুষের হাতের লাঠি নূরু। কারোর কোন কাজ থাকলে প্রথমেই ডাক পড়ে নূরু মিয়ার। সেও মানুষের জন্য নিবেদিত প্রাণ। এখানে ওখানে কাউকে পাঠাতে হলেও সেই নূরুকেই ডাকতে হয়। বউ-ছেলে নিয়ে ভালোই চলছিল তার সংসার।

একদিন মোড়ল বাড়ি থেকে তার ডাক আসে, খুলনা যেতে হবে। মোড়লের জামাই বাবাজী অন্যত্র বদলি হয়েছে। মাল- সামানা গোছানো, গাড়িতে তোলা, গন্তব্যে পৌঁছানোর ব্যবস্থা করতে হবে। সপ্তাহ খানেক সময় লাগবে। সেই প্রস্তুতি নিয়ে নূরু মিয়া গ্রাম ছাড়ে। পড়ে থাকে বউ- ছেলেমেয়ে, সংসার।

দু’দিন পর সাড়ে চার বছরের ছেলেটা তার ডাইরিয়ায় আক্রান্ত হয়। গ্রামে কোন ডাক্তার নেই। নূরু-বউ দিশা হারা হয়ে পড়ে। কী করবে? কোথায় নিয়ে যাবে? কূল কিনারা পায়না। বিপদের দিনে কেউ এগিয়ে আসেনি। কারও সাহায্য পায়নি। দু’দিনের মাথায় ছেলেটা মারা যায়। নূরু মিয়া মরা ছেলের মুখটা পর্যন্ত দেখতে পায়নি।

নূরু মিয়া নিজের মনকে প্রবোধ দিতে পারেনা। মানুষের বিপদে সে সব সময় ছুটে গেছে। অথচ তার ছেলেটাকে কেউ ডাক্তার দেখায়নি, হাসপাতালে নিয়ে যায়নি। রাগে, দুঃখে, অভিমানে গ্রাম ছেড়েছে। শোক-তাপ-দুঃখ ভুলে থাকতে দূরে বহু দূরে চলে এসেছে। মনে হলে তার বুকের ভিতর সে দুঃখ এখনো চিন চিন করে। হঠাৎ খেয়াল করলাম নূরু মিয়া ডুকরে ডুকরে কাদছে। সময়ের সাথে সাথে পাল্লা দিয়ে নূরু মিয়ার ক্রন্দন- সমূদ্রের গর্জন যেন আরও বেগবান হচ্ছে। তাকে স্বান্তনা দেবার ভাষা আমার জানা নেই।


১৯ মার্চ,২০২২ সাল
থানা রোড, সিরাজগঞ্জ