Home বাণিজ্য ও অর্থনীতি উঠে গেল সিংগেল ডিজিট সুদ বাংলাদেশ ব্যাংকের নতুন মুদ্রানীতি

উঠে গেল সিংগেল ডিজিট সুদ বাংলাদেশ ব্যাংকের নতুন মুদ্রানীতি

39

ডেস্ক রিপোর্ট: ঋণের সুদহার গণনায় নতুন পদ্ধতি চালু করল কেন্দ্রীয় ব্যাংক। মুদ্রানীতিতে ‘সিংগেল ডিজিট’ বা ৯ শতাংশের ক্যাপ তুলে দেওয়া হয়েছে। এর সঙ্গে বেসরকারি খাতে ঋণ প্রবৃদ্ধি কমিয়ে গতকাল রবিবার নতুন মুদ্রানীতি ঘোষণা করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। টাকার সরবরাহ কমিয়ে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ করতে এমন উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে বলে জানানো হয়েছে। রবিবার ২০২৩-২৪ অর্থবছরের প্রথমার্ধের (জুলাই-ডিসেম্বর-২০২৩) নতুন মুদ্রানীতি ঘোষণা করা হয়। খবর ইত্তফাক
ছয় মাস মেয়াদের এই মুদ্রানীতি ঘোষণার জন্য কেন্দ্রীয় ব্যাংকে সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করা হয়। মুদ্রানীতির বিভিন্ন দিক তুলে ধরেন কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রধান অর্থনীতিবিদ ড. হাবিবুর রহমান। মুদ্রানীতি ঘোষণাকালে গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদার বলেন, নতুন মুদ্রানীতিতে টাকার চাহিদা কমাতে নীতি সুদহার বাড়ানো হয়েছে। ঋণের সুদহারের যে ৯ শতাংশ ক্যাপ ছিল, তাও তুলে দেওয়া হয়েছে। গভর্নর বলেন, আমরা সরবরাহ সাইড ঠিক রেখে নীতি সুদহার বাড়াচ্ছি, যাতে সরকারি ঋণেও অর্থ খরচ বাড়ে। টাকার সরবরাহ কমিয়ে এনে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ করাটাই উদ্দেশ্য।
ব্যাংকঋণের সুদহার হবে সর্বোচ্চ ১০ দশমিক ১২ শতাংশ: ব্যাংকঋণের সীমা তুলে দিয়ে সুদ গণনার নতুন কাঠামো ঘোষণা করা হয়েছে। একই সঙ্গে আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর সুদহারের সীমাও তুলে দেওয়া হয়েছে। নতুন নিয়মে ব্যাংকঋণের সুদহার হবে সর্বোচ্চ ১০ দশমিক ১২ শতাংশ। আর আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর ঋণের সুদহার হবে সর্বোচ্চ ১২ দশমিক ১২ শতাংশ। এসএমই ও ভোক্তাঋণের তদারকি খরচের জন্য ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো আরো ১ শতাংশ বেশি সুদ আরোপ করতে পারবে।

হাবিবুর রহমান জানান, ১৮২ দিন মেয়াদি ট্রেজারি বিলের গড় হারের সঙ্গে ব্যাংকগুলো ৩ শতাংশ ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো ৫ শতাংশ সুদ যুক্ত করতে পারবে। এটাই হবে সুদের সর্বোচ্চ হার। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, গত ছয় মাসে ১৮২ দিন মেয়াদি ট্রেজারি বিলে গড় সুদ ছিল ৭ দশমিক ১২ শতাংশ।

অনুষ্ঠানে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘ব্যাংকঋণের ৯ শতাংশ সুদহার নির্ধারণ রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত ছিল। এই সীমা তুলে দেওয়ার সিদ্ধান্তটিও রাজনৈতিক। আমাদের কৃতিত্ব আমরা রাজনৈতিক নেতৃত্বকে পরিস্থিতি বোঝাতে সক্ষম হয়েছি। যখন এই সীমা দেওয়া হয়েছিল, তখন ব্যাংকগুলোর সুদ ১৮ শতাংশে উঠেছিল। তখন বিদেশি ঋণের সুদহার ছিল ২ শতাংশ। এখন বিদেশি ঋণের সুদ ৯-১০ শতাংশ। আবার টাকার অবমূল্যায়নের কারণে তার খরচ আরো বেশি হয়ে যাচ্ছে।

নীতি সুদহার বাড়ল :এ দিকে নতুন এই মুদ্রানীতিতে নীতি সুদহার হিসেবে বিবেচিত রেপো ৫০ বেসিস পয়েন্ট বাড়িয়ে ৬ দশমিক ৫০ শতাংশ করা হয়েছে। অর্থাত্ এখন কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে ব্যাংকগুলো জরুরি প্রয়োজনে অর্থ নিলে গুণতে হবে অতিরিক্ত সুদ। পাশাপাশি রিভার্স রেপো ২৫ বেসিস পয়েন্ট বাড়িয়ে ৪ দশমিক ২৫ শতাংশ থেকে ৪ দশমিক ৫০ শতাংশ করা হয়েছে। এখন কেন্দ্রীয় ব্যাংকে টাকা রাখলে ব্যাংকগুলো আগের চেয়ে বেশি সুদ পাবে। রেপো ও রিভার্স রেপোর এই নতুন হার ১ জুলাই থেকে কার্যকর হবে বলে বাংলাদেশ ব্যাংক জানিয়েছে।

নীতি সুদহার ও বাণিজ্যিক ব্যাংকের সুদহারের করিডোর প্রথা চালু হচ্ছে। এখন স্পেশাল রেপোকে বলা হবে স্ট্যান্ডার্ড ল্যান্ডিং ফ্যাসিলিটি (এসএলএফ), নীতি সুদ ও রিভার্স রোপোকে বলা হবে স্ট্যান্ডার্ড ডিপোজিট ফ্যাসিলিটি (এসডিএফ)।

বেসরকারি খাতে ঋণ প্রবৃদ্ধি কমল : মুদ্রানীতিতে বেসরকারি খাতে ঋণের প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে ১০ দশমিক ৯ শতাংশ। এর আগের মুদ্রানীতিতে প্রাক্কলন করেছিল ১৪ দশমিক ১ শতাংশ। অপরদিকে সরকারি ঋণের প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা ৪৩ শতাংশ। যা আগের মুদ্রানীতিতে প্রাক্কলন ছিল ৩৭ দশমিক ৭ শতাংশ। সব মিলিয়ে মোট অভ্যন্তরীণ ঋণের প্রবৃদ্ধি ধরা হয়েছে ১৬ দশমিক ৯ শতাংশ। আগামী অর্থবছরের বাজেটে মূল্যস্ফীতি ৬ শতাংশ এবং সাড়ে ৭ শতাংশ জিডিপি প্রবৃদ্ধি অর্জনের লক্ষ্য ঠিক করেছে সরকার। কেন্দ্রীয় ব্যাংক এবার প্রবৃদ্ধির লক্ষ্য অর্জনের চেয়ে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে জোর দিয়েছে।

রিজার্ভের হিসাব ‘দুই পদ্ধতিতেই’ :গত বছরই আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) কাছ থেকে সুদহার ও বৈদেশিক মুদ্রার বিনিময় হার বাজারভিত্তিক করার পরামর্শ আসে। বিদেশি মুদ্রার রিজার্ভ হিসাব করার আইএমএফ স্বীকৃত বিপিএম ৬ পদ্ধতি চালু করারও পরামর্শ দেওয়া হয়।

মুদ্রানীতি ঘোষণার অনুষ্ঠানে গভর্নর বলেন, বাংলাদেশ ব্যাংক এখন থেকে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের হিসাব ‘দুই পদ্ধতিতেই’ করবে। অর্থাত্, আগে যে পদ্ধতিতে করা হত, সেভাবেও করা হবে, আবার বিপিএম ৬ পদ্ধতিতেও করা হবে। তরে আমরা বিপিএম ৬ পদ্ধতি অনুযায়ী, প্রকৃত রিজার্ভের তথ্য হিসাব করলেও তা প্রকাশ করব না। পৃথিবীর কোনো দেশ তা প্রকাশ করে না। আইএমএফ-এর এ বিষয়ে কোনো বাধ্যবাধকতা নেই বলে জানান তিনি।

মুদ্রানীতির যে প্রক্ষেপণ চলতি জুন মাস শেষে অভ্যন্তরীণভাবে ধরা হয়েছিল বাংলাদেশ ব্যাংক তার কতটা অর্জন হয়েছে, সে তথ্যও জানানো হয় মুদ্রানীতির অনুষ্ঠানে। বলা হয়, সরকারি ঋণের প্রবৃদ্ধি ৩৭ দশমিক ৭ শতাংশ ধরা হলেও মে মাস শেষে অর্জন হয়েছে ৪৩ দশমিক ৩ শতাংশ। আর বেসরকারি খাতে ঋণ প্রবৃদ্ধি ধরা হয়েছিল ১৪ দশমিক ১ শতাংশ, হয়েছে ১১ দশমিক ১ শতাংশ। সব মিলিয়ে মোট অভ্যন্তরীণ ঋণের প্রবৃদ্ধি ধরা হয়েছিল ১৮ দশমিক ৫ শতাংশ, আর গত মে পর্যন্ত হয়েছে ১৬ দশমিক ৭ শতাংশ।

মুডিসের রেটিং কমানোর কারণ ভূরাজনৈতিক : সাংবাদিকদের প্রশ্নের উত্তরে গভর্নর আবদুর রউফ তালুকদার বলেন, আন্তর্জাতিক ঋণমান যাচাইকারী প্রতিষ্ঠান মুডিস কর্তৃক দেশের ব্যাংকিং ব্যবস্থার সাম্প্রতিক অবনমন বাংলাদেশের ব্যাংকগুলোর জন্য খুব বেশি গুরুত্ব রাখে না। তিনি বলেন, ‘মুডিস আমাদের ব্যাংকিং সেক্টরের ওপর যে রেটিং করেছে, এটা মনে হচ্ছে ভূরাজনৈতিকভাবে হয়েছে, এটা পিউর অর্থনৈতিক রিপোর্টিং নয়। বিষয়টি ব্যাখ্যা করে তিনি বলেন, মুডিস ২০১২ সালে আমাদের যে রেটিং রেখেছে, তখন আমাদের রিজার্ভ ছিল ১০ বিলিয়ন ডলার। এর পরে আমাদের অর্থনীতি ও মাথাপিছু আয় বেড়েছে, আমাদের রিজার্ভ ৪৮ বিলিয়ন ছাড়িয়েছে, কিন্তু মুডিস আমাদের রেটিংয়ে পরিবর্তন আনেনি। প্রসঙ্গত, গত ৩১ মে স্থানীয় ছয়টি বাণিজ্যিক ব্যাংকের রেটিং কমিয়ে দেয় মুডিস ইনভেস্টর সার্ভিস।

‘সুদহার টার্গেটিং’ মুদ্রানীতি :প্রশ্নোত্তর পর্বে গভর্নর জানান, বিশ্বব্যাপী বর্তমানে চার ধরনের লক্ষ্যমাত্রা-ভিত্তিক মুদ্রানীতি প্রচলিত আছে। সুদহার, মূল্যস্ফীতি, মুদ্রা সরবরাহ এবং বিনিময় হার টার্গেটিং। বাংলাদেশ ব্যাংক এতদিন ‘মূল্যস্ফীতি টার্গেটিং’ মুদ্রানীতি প্রণয়ন করে আসছিল। এবার ‘সুদহার টার্গেটিং’ মুদ্রানীতি ঘোষণা করা হয়েছে। মুদ্রানীতিতে এটা কাঠামোগত পরিবর্তন বলা যায়।

চালু হবে টাকার পে-কার্ড :মুদ্রানীতিতে জানানো হয়, ডলার সাশ্রয়ে টাকার পে-কার্ড চালুর উদ্যোগ নিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এই কার্ড দিয়ে দেশে কেনাকাটা, বিভিন্ন বিল পরিশোধ ছাড়াও ভারত ভ্রমণের সময় রুপিতে খরচ করার সুযোগ পাবেন বাংলাদেশিরা। এতে ৬ শতাংশের মতো খরচ কমবে। গভর্নর বলেন, ‘আমরা টাকার একটি পে-কার্ড চালু করছি। এটাকে ভারতের রুপির সঙ্গে সংযুক্ত করে দেব। এই কার্ড থাকলে গ্রাহক বাংলাদেশে ডেবিট কার্ড হিসাবে ব্যবহার করতে পারবে। যে কোনো কেনাকাটা করতে পাবে। আবার যখন ইন্ডিয়া যাবেন তখনো কার্ড দিয়েই ভ্রমণ কোটায় ১২ হাজার ডলার খরচ করতে পারবেন। ফলে দুবার মানি চেঞ্জে যে লস (লোকসান) হচ্ছে তা আর হবে না। অর্থাত্ ভ্রমণে যেতে হলে প্রথমে টাকা থেকে ডলারে কনভার্ট করতে হয়, পরে ভারতে গিয়ে ডলার রুপিতে কনভার্ট করতে হয়। টাকার পে-কার্ড নিলে দুবার মানি চেঞ্জ করতে হবে না। এতে করে কমপক্ষে ৬ শতাংশের মতো সেইভ (খরচ কমবে) হবে। ইন্ডিয়াতে প্রতি বছর অনেক বাংলাদেশি ঘুরতে যান। এতে আমাদের অনেক ডলার বেঁচে যাবে। তিনি জানান, এটা কারেন্সি সোয়াপ হবে না। কারণ কারেন্সি সোয়াপ হলো এক দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংক অন্য দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কাছে যে ডলার ধার করে। এই কার্ডে গ্রাহক লেনদেন করবে।

অনুষ্ঠানে বাংলাদেশ ব্যাংকের ডেপুটি গভর্নর আহমেদ জামাল, কাজী ছাইদুর রহমান, আবু ফরাহ মো. নাছের, এ কে এম সাজেদুর রহমান খান, বিএফআইইউ প্রধান মাসুদ বিশ্বাস, প্রধান অর্থনীতিবিদ ড. হাবিবুর রহমান, নির্বাহী পরিচালক ও ভারপ্রাপ্ত মুখপাত্র আবুল বশরসহ গবেষণা বিভাগের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন।