Home জাতীয় ইসির তুঘলকি কাণ্ড

ইসির তুঘলকি কাণ্ড

25

ডেস্ক রিপোর্ট: দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের মাত্র ছয় মাস আগে কঠোর গোপনীয়তা অবলম্বন করে ১০টি সংসদীয় আসনের সীমানায় পরিবর্তন এনে বিতর্কের জন্ম দিয়েছে নির্বাচন কমিশন (ইসি)। অথচ গত ২৬ ফেব্রুয়ারি ৩০০ সংসদীয় আসনের সীমানা পুনর্নির্ধারণ করে ইসি যে খসড়া প্রকাশ করেছিল, সেখানে বর্তমান সীমানা বহাল রাখা হয়েছিল। এমনকি ইসির খসড়ার ওপর স্থানীয় জনগণ ও জনপ্রতিনিধিদের দাবি-আপত্তির ওপর শুনানি শেষেও কমিশনের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছিল, নির্বাচনের আগে কোনো আসনের সীমানায় পরিবর্তন আসছে না। অথচ অত্যন্ত গোপনে ১০টি আসনের সীমানা পরিবর্তন করে গত ১ জুন প্রজ্ঞাপনে স্বাক্ষর করেন নির্বাচন কমিশন সচিবালয়ের সচিব মো. জাহাঙ্গীর আলম। গতকাল শনিবার প্রজ্ঞাপনটি বিজি প্রেসের ওয়েবসাইটে প্রকাশ করা হয়। সংশ্লিষ্ট আসনগুলোয় ২০০৮ সালে করা বিতর্কিত সীমানায় ফিরে গেছে হাবিবুল আউয়াল কমিশন।খবর ইত্তেফাক
ইসির এই তুঘলকি কাণ্ডে রীতিমতো বিস্ময় প্রকাশ করেছেন পরিবর্তন আনা আসনগুলোর কোনো কোনো জনপ্রতিনিধি এবং বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতারা। সংক্ষুব্ধরা বলছেন, একজন নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি পাঁচ, দশ কিংবা আরো বেশি বছর ধরে নিজ নির্বাচনি আসনে নানা উন্নয়ন কর্মকাণ্ড করেছেন। এই সময়ে স্থানীয় ভোটার ও এলাকাবাসীর সঙ্গে জনপ্রতিনিধিদের নিয়মিত যোগাযোগ স্থাপিত হয়েছে। পরবর্তী নির্বাচনকে সামনে রেখে জনপ্রতিনিধিরা সর্বোচ্চ চেষ্টা ও আন্তরিকতা দিয়ে এলাকার উন্নয়নে নিজেকে সম্পৃক্ত রাখেন। কিন্তু যে উপজেলা, ইউনিয়ন বা এলাকায় প্রায় পাঁচ বছর ধরে তিনি উন্নয়ন কার্যক্রম করলেন; নির্বাচনের মাত্র তিন-চার মাস আগে সেই এলাকা তার সংসদীয় আসন থেকে কেটে নিয়ে অন্য নতুন এলাকা যুক্ত করা শুধু অযৌক্তিকই নয়; স্থানীয় ভোটার ও এলাকাবাসীর সঙ্গেও এক ধরনের প্রহসন।
ভুক্তভোগীদের মতে, সংসদীয় আসনের সীমানা পরিবর্তনের ক্ষেত্রেও যে বিষয়টি বিবেচনা করা হয়ে থাকে, সেটি হলো সংশ্লিষ্ট জনপ্রতিনিধি এলাকায় কতটুকু উন্নয়ন করেছেন, অর্থাৎ এলাকার মানুষের সঙ্গে তার উন্নয়ন-সম্পৃক্ততা। এছাড়া, একজন জনপ্রতিনিধির সঙ্গে পৌণে পাঁচ বছর যেই এলাকার উন্নয়ন-সংক্রান্ত কোনো সম্পর্ক ছিল না; যেখানকার ভোটার বা জনগণের প্রতি সঙ্গত কারণেই ঐ জনপ্রতিনিধির ভূমিকাও ছিল না; হঠাৎ সেই এলাকার মানুষ আগামী নির্বাচনে কেন ঐ প্রার্থীকে ভোট দেবেন?

অত্যন্ত ন্যায্য ও গুরুত্বপূর্ণ এই বিষয়গুলোকে পুরোপুরি উপেক্ষা করে গোপনে হঠাৎ ১০টি আসনের সীমানা পরিবর্তন করে ইসি কার বা কোন মহলের স্বার্থ হাসিল করছে, সেটিই বড় প্রশ্ন হয়ে দেখা দিয়েছে।
রাজনীতি বিশ্লেষকরা বলছেন, ব্যক্তি বিশেষের এবং বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের এমন তুঘলকি কাণ্ডের দায়ভার দিন শেষে গিয়ে পড়ে সরকার প্রধানের ওপর। অথচ সরকার প্রধানের অজান্তেই বিশেষ কোনো উদ্দেশ্যে, বিশেষ কোনো প্রাপ্তির প্রতিদান দিতে এসব বিতর্কিত কাণ্ড ঘটিয়ে থাকেন সংশ্লিষ্ট ঐসব ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান। সুনির্দিষ্ট কারণ ছাড়াই ১০টি সংসদীয় আসন ভেঙে তছনছ করার ঘটনায় হতবাক স্থানীয় ভোটার ও জনপ্রতিনিধিরা।

ইসি সংশ্লিষ্টরা বলেন, সীমানা পুনর্নির্ধারণ সংক্রান্ত কমিটির দেখভালের দায়িত্বে থাকা নির্বাচন কমিশনার মো. আলমগীর কোনো আসনের সীমানা পরিবর্তন না করার পক্ষে জোরালো মতামত দিলেও কমিশনারদের কেউ কেউ তা আমলে নেননি। বরং অতি উত্সাহী হয়ে বিশেষ স্বার্থে সংশ্লিষ্ট আসনগুলো কাটছাঁট করেন। কাজী হাবিবুল আউয়ালের নেতৃত্বাধীন পাঁচ সদস্যের কমিশনের সবাইকে শপথ করিয়ে নেওয়া হয় যে, সীমানা সংক্রান্ত যে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে তা গেজেট প্রকাশের আগে কাউকে না বলার জন্য। ইসির সংশ্লিষ্ট অধিশাখাকেও রাখা হয়নি সীমানা চূড়ান্ত করণের কাজে। এই গোপনীয়তা নিয়ে নানান প্রশ্ন উঠেছে। সীমানা সংক্রান্ত কাজের স্বচ্ছতা নিয়ে রয়েছে প্রশ্ন।

চলতি বছরের ২৬ ফেব্রুয়ারি নির্বাচন কমিশন যে খসড়া সীমানার তালিকা প্রকাশ করেছিল তাতে কোনো পরিবর্তন আনা হয়নি। হঠাৎ চূড়ান্ত গেজেটে অযাচিতভাবে পরিবর্তন এনে বিতর্কের জন্ম দিয়েছে কমিশন। রাজনৈতিক দলগুলোর আস্থার সংকটে থাকা বর্তমান কমিশন অযৌক্তিক সীমানা পরিবর্তন করে নতুন করে অনাস্থার মধ্যে পড়ে গেল। খসড়া প্রকাশের সময় গেজেট বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছিল ১৯ মার্চের মধ্যে আপত্তি থাকলে উত্থাপন করতে বলা হয়েছিল। এতে ৩৮টি আসনে মোট ১৮৬টি দাবি-আপত্তির আবেদন জমা পড়ে। পরবর্তী সময়ে ৩ থেকে ১৪ মে পর্যন্ত চারটি পৃথক দিনে আবেদনগুলোর শুনানি করে নির্বাচন কমিশন।

ইসি সচিব স্বাক্ষরিত প্রজ্ঞাপন অনুযায়ী পিরোজপুর-১ ও পিরোজপুর-২; কুমিল্লা-১ ও কুমিল্লা-২; ফরিদপুর-২ ও ফরিদপুর-৪; নোয়াখালী-১ ও নোয়াখালী-২ এবং গাজীপুর-২ ও গাজীপুর-৫ আসনে পরিবর্তন আনা হয়েছে। এর মধ্যে পিরোজপুর ও কুমিল্লার চারটি সংসদীয় আসনের সীমানায় বড় পরিবর্তন এসেছে। একাদশ ও দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে পিরোজপুর-১ আসনটি পিরোজপুর সদর, নাজিরপুর ও নেছারাবাদ উপজেলা নিয়ে গঠিত ছিল। দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে নির্ধারিত নতুন সীমানায় এই আসনটি পিরোজপুর সদর উপজেলা, নাজিরপুর ও ইন্দুরকানী উপজেলা নিয়ে গঠন করা হয়েছে। একই সঙ্গে আগে কাউখালী, ভাণ্ডারিয়া ও ইন্দুরকানী উপজেলা নিয়ে গঠিত পিরোজপুর-২ সংসদীয় আসনটি নতুন সীমানা অনুযায়ী কাউখালী, ভাণ্ডারিয়া ও নেছারাবাদ উপজেলা নিয়ে গঠন করা হয়েছে। অথচ সর্বশেষ দুটি জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে ভাণ্ডারিয়া, কাউখালী ও ইন্দুরকানী উপজেলা নিয়ে। অর্থাৎ মাত্র ৬৯ হাজার ভোটার সংবলিত ইন্দুরকানী উপজেলাকে পিরোজপুর-২ আসন থেকে সরিয়ে পিরোজপুর-১ আসনে এবং ১ লাখ ৮৪ হাজার ভোটার সংবলিত নেছারাবাদ উপজেলাকে পিরোজপুর-১ আসন থেকে পিরোজপুর-২ আসনে যুক্ত করা হয়েছে। পিরোজপুর-১ আসন থেকে অতিরিক্ত সোয়া ১ লাখ ভোটার পিরোজপুর-২ আসনে সংযুক্ত করা হয়েছে। যেটি ইসি অসৎ উদ্দেশ্যে কাউকে খুশি করতে করেছে বলে মন্তব্য করেছেন সংশ্লিষ্ট এলাকার বিক্ষুব্ধরা। এই অযৌক্তিক হস্তক্ষেপে তীব্র ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরা। ইসির সীমানা খসড়া প্রকাশের পর স্থানীয় সংসদ সদস্য বিদ্যমান তিনটি আসন বহাল রাখার জন্য আবেদনও করেছিলেন। কিন্তু তাদের আবেদন উপেক্ষা করে নতুন সীমানা নির্ধারণ করে দেওয়া হয়েছে।

একইভাবে দাউদকান্দি ও মেঘনা উপজেলা নিয়ে গঠিত কুমিল্লা-১ আসনটি নতুন সীমানায় দাউদকান্দি ও তিতাস উপজেলা নিয়ে গঠন করা হয়েছে। আগে আসনটিতে ভোটার ছিল ৪ লাখ ২ হাজার। নতুন করে আসনটিতে মেঘনার পরিবর্তে তিতাস যুক্ত করা হয়েছে। এখন ভোটার সংখ্যা দাঁড়িয়েছে পৌনে ৫ লাখের মতো। আগের সীমানা অনুযায়ী হোমনা ও তিতাস উপজেলা নিয়ে কুমিল্লা-২ আসনটি ছিল। ভোটার সংখ্যা ছিল সাড়ে ৩ লাখ। নতুন সীমানায় হোমনা ও মেঘনা উপজেলা নিয়ে গঠন করা হয়েছে। ভোটার সংখ্যা কমে দাঁড়িয়েছে ৩ লাখ ২ হাজারে। এই দুটি আসনও অসমভাবে বণ্টন করা হয়েছে। এছাড়া নগরকান্দা ও সালথা উপজেলা এবং সদরপুর উপজেলার কৃষ্ণপুর ইউনিয়ন নিয়ে গঠিত ফরিদপুর-২ আসন থেকে কৃষ্ণপুর ইউনিয়ন বাদ দেওয়া হয়েছে। সেটা যুক্ত করা হয়েছে ফরিদপুর-৪ আসনের সঙ্গে। নোয়াখালী ১ ও ২ আসনের সীমানায় একটি ইউনিয়ন রদবদল করা হয়েছে। নোয়াখালী-১ থেকে বজরা ইউনিয়ন কেটে নোয়াখালী-২ আসনের সঙ্গে যুক্ত করা হয়েছে। আর সেনবাগ উপজেলা এবং সোনাইমুড়ী উপজেলার বারগাঁও, নাটেশ্বর ও অম্বরনগর নিয়ে আগে গঠিত নোয়াখালী-২ আসনটি নতুন সীমানায় সেনবাগ উপজেলা ও সোনাইমুড়ী উপজেলার বারগাঁও, নাটেশ্বর, অম্বরনগর ও বজরা ইউনিয়ন নিয়ে গঠন হয়েছে। একাদশ জাতীয় নির্বাচনে গাজীপুর সিটি করপোরেশনের ৩৯ নম্বর ওয়ার্ড গাজীপুর-৫ আসনের অন্তর্ভুক্ত ছিল, যা নতুন সীমানায় গাজীপুর-২ আসনের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে এবং ৫ আসন থেকে বাদ দেওয়া হয়েছে। ফলে নতুন নির্বাচনি সীমানা অনুযায়ী গাজীপুর-২ ও ৫ আসনে পরিবর্তন এসেছে।

এর বাইরের একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর থেকে নতুন গঠিত প্রশাসনিক এলাকা অন্তর্ভুক্তের ফলে আরো আটটি আসনেও সাময়িক পরিবর্তন এসেছে। অবশ্য এ আটটির ক্ষেত্রে আসনগত কোনো পরিবর্তন আসেনি। এর মধ্যে কালকিনি উপজেলা নিয়ে গঠিত মাদারীপুর-৩ আসনের সঙ্গে ডাসার উপজেলা যুক্ত এবং ময়মনসিংহ-৪ আসনে ময়মনসিংহ সদর আসনের সঙ্গে ময়মনসিংহ সিটি করপোরেশনকে যুক্ত করা হয়েছে। আর ধর্মপাশা, তাহিরপুর ও জামালগঞ্জ উপজেলা নিয়ে একাদশের গঠিত সুনামগঞ্জ-১ আসন ধর্মপাশা ও মধ্যনগর করায় মধ্যনগরের নাম যুক্ত হয়েছে। জগন্নাথপুর ও দক্ষিণ সুরমা উপজেলা নিয়ে গঠিত সুনামগঞ্জ-৩ আসনের দক্ষিণ সুরমার নাম পরিবর্তন করে সরকার শান্তিগঞ্জ উপজেলা করায় নির্বাচনি সীমানায় এই অংশটুকু পরিবর্তন আনা হয়েছে। সিলেট-১ আসনে সিটি করপোরেশনের ১ থেকে ২৭ নম্বর এবং ৩১ থেকে ৩৯ নম্বর ওয়ার্ড ও সদর উপজেলা, একই কারণে সিলেট-২ আসনে পরিবর্তন হয়ে সিটি করপোরেশনের ২৮ থেকে ৩০ ও ৪০ থেকে ৪২ নম্বর ওয়ার্ড এবং দক্ষিণ সুরমা, ফেঞ্চুগঞ্জ ও বালাগঞ্জ উপজেলা নিয়ে গঠিত হয়েছে। কক্সবাজার সদর ও রামু উপজেলা আসন নিয়ে গঠিত কক্সবাজার-৩ আসনের সদর উপজেলা ভেঙে ঈদগাঁও নামে নতুন আরেকটি উপজেলা করায় এই নামটিও যুক্ত হয়েছে নতুন সীমানায়।