Home মতামত আমেরিকার পথে, আমেরিকার প্রান্তরে (পর্ব-১)!!!

আমেরিকার পথে, আমেরিকার প্রান্তরে (পর্ব-১)!!!

54

সরদার মোঃ শাহীন:

প্রায় তিনবছর ধরেই অপেক্ষা করছিলাম আমেরিকা যাওয়ার। যাওয়া আর হচ্ছিল না। ইউনিভার্সিটি অব ফ্লোরিডার কনফারেন্সে যাবার কথা ২০২০ সালের ফেব্রুয়ারির শেষের দিকে। ভিসা হাতে পেয়ে ফ্লাইটের টিকিট করতে যাবো। অমনি করোনা পেনডেমিক। ফলে আর যাওয়া হয়নি। মহামারী আকারে করোনা হানা দেয়ার পর থেকে শুধু আমেরিকা নয়, কোন দেশের কোন কনফারেন্সেই স্বশরীরে যাওয়া হয়নি।
তবে অংশ নিয়েছি বেশ কয়েকটাতে। কিন্তু সবই অনলাইনে; ওয়েবইনারে। কম্পিউটারের মনিটরে ছোট ছোট বক্সে ছোট ছোট মুখ দেখেছি। এতে কি আর মন ভরেছে! মন ভরার জন্যে ক্যাম্পাস প্রয়োজন। প্রয়োজন স্বশরীরে উপস্থিতি। আনন্দের কথা হলো, গেল ২০২২ সালের অক্টোবরে করোনা পরবর্তী প্রথম কনফারেন্সে স্বশরীরে অংশ নিতে পেরেছি। কিয়োতো কনফারেন্স। জাপানে থাকি বলেই এখানে অংশ নেয়াটা খুব সহজ ছিল। টোকিও থেকে বুলেট ট্রেনে উঠে সোজা কিয়োতো। ঘন্টা দু’য়েকের কিছুটা বেশি সময়ের জার্নি। বড় আরামদায়ক জার্নি। ফ্লাইটে ওঠার ঝক্কি ঝামেলা নেই; পিসিআর নেই। নেই করোনা টিকা বিষয়ক কাগজপত্রের যোগার যন্ত।
এসব কিছুকে আজকাল কিছুটা হলেও ফালতু মনে হয়। বাড়াবাড়ি মনে হয়। করোনা এখন পুরোপুরি বিশ্ববাসীর নিয়ন্ত্রণে। এটা মোটেই আর মৃত্যুঝুঁকি সৃষ্টি করছে না। মহামারী শেষ বলে বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থাও জানান দিয়েছে। বিশেষ করে যারা তিনডোজের টিকা নিয়েছে, তারা পুরোপুরি শংকামুক্ত। আক্রান্ত হলেও সাধারণ জ্বর সর্দির মত হয়। তাই এখনো কেন এসব নিয়ে মাতামাতি চলছে বা তথাকথিত বিশ্ব নিয়ন্ত্রক সংস্থা জিইয়ে রেখেছে সেটা কোটি টাকার প্রশ্ন।
ঢাকা থেকে ডঃ মুনির এবং ডঃ সঞ্জীব এসেছিল কিয়োতোতে। এটা তাদেরও প্রশ্ন। ওরাও প্রায় তিনবছর কোথায়ও যেতে পারেনি। ওদের সাথে ক’টা দিন থাকতে পেরে বেশ ভালো লেগেছে। বেশ ভালো সময় কেটেছে। প্রায় তিনবছর পরে আবার কনফারেন্সের আঙিনা বিভিন্ন দেশের গবেষকদের উপস্থিতিতে প্রাণবন্ত হয়ে উঠেছিল। করোনার খারাপ সময়ে আশা তো ছেড়েই দিয়েছিলাম। ভেবেছিলাম আর কোনদিন হয়তো কোথায়ও যাওয়া হবে না। হবে না দেখা আর কারো সাথে কোনদিন!
তবে দেখা সাক্ষাত শুরু হয়েছে এটাই আশার কথা। আস্তে আস্তে বিশ্বব্যাপী স্বশরীরে উপস্থিতি বাড়ছে। এবারের কনফারেন্স শিকাগোতে। শুনেছি অধিকাংশ অংশগ্রহণকারী স্বশরীরেই অংশ নেবে। তিন বছর অপেক্ষার পর আমিও যাচ্ছি। টোকিওর হানেদা থেকে রেগুলার ফ্লাইট না পেয়ে নারিতা এয়ারপোর্ট থেকে যাবার ব্যবস্থা করেছি। শীতের সন্ধ্যার ফ্লাইট। সময়টা মন্দ নয়। হালকা ফুরফুরে বাতাসের বিকেলে টোকিও থেকে ট্রেনে চেপে যথা সময়ে নারিতা পৌঁছে যাই।
এক সময় নারিতা এয়ারপোর্ট লোকজনে গমগম করতো। হাজার হাজার যাত্রী পদচারণার সেই নারিতা এয়ারপোর্ট এখন যেন ভূতুরে বাড়ি। কাউন্টারের পর কাউন্টার খালি। জনমানবহীন। লোকজন নেই বললেই চলে। ফ্লাইট নেই, তাই মানুষজনও নেই। করোনার বিধি নিষেধ উঠে গেলেও ফ্লাইটের চলাচল এখনো স্বাভাবিক হয়নি। হবার কথাও না। প্লেনের যে অস্বাভাবিক ভাড়া, তাতে খুব বেশি না ঠেকলে পারতপক্ষে কেউ প্লেনে উঠতে চায় না।
সারা পৃথিবীর সব দেশের সব এভিয়েশনই একাট্টা হয়েছে। দলবেঁধে ভাড়া বাড়িয়েছে। কঠিন যুক্তি তাদের হাতে। করোনা মহামারী এবং ইউক্রেন রাশিয়া যুদ্ধের কারণে ভাড়া না বাড়িয়ে উপায় নেই। প্রথমে করোনায় সব স্থবির হয়ে গেল। যাত্রী শূন্য হলো এভিয়েশন। একটা হাহাকার পড়ে গেল এভিয়েশন জগতে। একের পর এক এভিয়েশন তাদের সকল ফ্লাইট অপারেশন বন্ধ রাখতে বাধ্য হলো। এর পরপরই শুরু হলো যুদ্ধ। যুদ্ধের কারণে বিশ্বব্যাপী বেড়ে গেল তেলের দাম। এই দু’ইয়ে মিলে এভিয়েশন জগতে টালমাটাল অবস্থা।
আর যায় কোথায়! এই দু’টো কারণকে পুঁজি করে তারা কুবুদ্ধি আটলো। সার্ভাইভের নামে ভাড়া বাড়িয়ে দিল। ব্যাপারটিকে সহজ চোখে দেখলে মনে হবে ঠিকই আছে। ভাড়া না বাড়িয়ে উপায় কি? তেলের দাম বেড়েছে বলে ভাড়া বাড়বে, এটা সত্যি। কিন্তু তাই বলে তিনগুন? কিংবা কোন কোন ক্ষেত্রে পাঁচগুন বাড়বে? তেলের দাম বেড়েছে কত পার্সেন্ট? বাড়ার কারণে প্রতি টিকিটে বড়জোর ২০০ ডলার সার চার্জ হিসেবে বাড়তি নিলেই হতো। এভিয়েশনের আর কোন খরচ তো বাড়েনি। বরং ঢের কমেছে।
তাহলে ভাড়া তিন থেকে পাঁচগুন বাড়লো কেন? মাত্রাতিরিক্ত এমন আকাশচুম্বি ভাড়া গুনে কার সাধ্য প্লেনে চড়ে? সমস্ত পৃথিবীর ট্যুরিজম সেক্টর অচল হয়ে পড়ে আছে। পর্যটক প্রায় শূন্যের কোঠায়। এর মূল কারণ অস্বাভাবিক ভাড়া বৃদ্ধি। করোনার প্রথম দু’বছর পরই ট্যুরিজমে পর্যটকদের ঢল নামার কথা। আজও মানুষ সেভাবে নামতে পারছে না কেবল অস্বাভাবিক ভাড়ার কারণে।
আসলে আর্ন্তজাতিক এভিয়েশন সেক্টরটা লুটপাটের বাণিজ্য করছে। করোনায় সব বন্ধ হয়ে যাবার পরে প্রত্যেক দেশের সরকারি কোষাগার থেকে এরা টাকা নিয়েছে প্রণোদনার নামে। বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার নিয়েছে। সব দেশের সব সরকারও দেদারছে তাদের দিয়েছে। দিয়েছে, কেননা আন্তর্জাতিক যোগাযোগ এবং বাণিজ্যের ক্ষেত্রে এর কোন বিকল্প নেই। তবে একদিকে প্রণোদনা নিলেও অন্যদিকে কর্মী ছাটাই করেছে ঢালাও ভাবে।
মানেটা কি দাঁড়ায়? রাষ্ট্রীয় কোষাগার খালি করে টাকাও নিল, আবার কর্মচারীদেরও ছাটাই করে সেই রাষ্ট্রের ঘাড়েই বেকার করে ফেলে দিল। ওদের আর বেতনভাতাও দেয়া লাগলো না। ফলত এয়ারলাইন্সগুলোর ক্ষতি তো হলোই না, উল্টো লাভের পাল্লা ভারী হলো। প্রথমে কাটলো রাষ্ট্রের পকেট। তার পরপরই কর্মচারীদের। আর এখন কাটছে সাধারণ যাত্রী সকলের পকেট। গেল তিন বছর ধরে ওরা কেবল পকেট কেটেই চলেছে।
বাকী ছিল যাত্রীসেবা। এখন এখানেও হাত দিয়েছে। সব ধরণের সেবা কাটছাট করে দিচ্ছে। সবই করছে করোনার দোহাই দিয়ে। আসলে এসব কিচ্ছু না। জাষ্ট জোচ্চরী। খরচ কমানোর ধান্দা। ধরা যাক খাবারের কথা। কোন রকমের কিছু একটা খাবার দিয়েই হাত গুটাচ্ছে। করোনা সতর্কতায় খাবারের পরিমাণ একেবারেই কমিয়ে ফেলা হয়েছে। কোন রকম কিছু একটা খেতে দিয়েই ফ্লাইটের বাতি নিভিয়ে দিচ্ছে।
পারতপক্ষে খাবার দিতে চায় না করোনার নামে। কোন রকম দেয়। একান্তই দেয়া লাগে, তাই দেয়। ইকোনমি ক্লাসে যেমন তেমন, বিজনেস ক্লাসেও দিতে চায় না। আগে বিজনেজ ক্লাসে খাবারের হিড়িক পরতো। একটার পর একটা আসতে থাকতো। এখন তাড়াহুড়া করে এটাসেটা দিয়ে একটা পর্ব কোনরকম শেষ করে। এদিকে লাউঞ্জও বন্ধ। এয়ারপোর্ট লাউঞ্জের সেই কলরব আর নেই গেল তিনটি বছর। কিন্তু ভাড়া তিনগুন।
২০২২ সালের ডিসেম্বরের সন্ধ্যে। নারিতা থেকে অল নিপ্পন এয়ারওয়েজের প্লেনে চড়ে প্রথম বারের মত কিছুটা অবাকই হলাম। হাওয়া যেন বদলাতে শুরু করেছে। গেল তিনবছরের করোনা প্যানিক কিছুটা হলেও কেটে গেছে বলে মনে হলো। মনে হলো করোনার ধারা অনেকটাই পরিবর্তনের ধারায় ফিরছে। এতদিনকার কড়াকড়ি অনেকটাই শিথিলের পথে।। মাস্ক নিয়ে কোন কথা নেই। শরীরের তাপমাত্রা মাপার বিষয়টিও আর নেই। কেবিন ক্রু সকল খুব স্বাভাবিক আচরণ করছে। না চাইলেও খাবার কিংবা পানীয় নিজ থেকে সরবরাহ করছে।
ভালই হলো। এবারের দীর্ঘ সময়ের জার্নিতে অন্তত ক্ষুধার কষ্টটা থাকবে না। খাই বা না খাই; চাইলেও খেতে পারবো না শর্তে একটা কষ্ট থেকেই যেত। মনের মধ্যে জমে থাকা নিভু নিভু কষ্ট। তবে আজ অন্য কষ্ট আছে। শোনিমটা সাথে না থাকার কষ্ট। আমার শোনিমটা সাথে থাকলে খুব ভালো হতো। ও খুব মজা পেত। ইদানীং ফ্লাইটের বাড়াবাড়ি রকমের যন্ত্রণায় ও আর ফ্লাইটেই ওঠতে চায় না।
আসলে ওদের কষ্টটাই আলাদা। করোনা মহামারী বিশ্বকে অনেক কষ্ট দিয়েছে। অনেক ক্ষতি করেছে। তবে সবচেয়ে বেশি ক্ষতি করেছে কোমলমতি শিক্ষার্থীদের। ওরা শিক্ষা এবং শিক্ষাঙ্গন থেকে বঞ্চিত হয়েছে মাসের পর মাস। ওদের মনোবিকাশের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সময়ে ওরা পায়নি শিক্ষাঙ্গনের আঙিনা। পায়নি শিক্ষকের সান্নিধ্য কিংবা বন্ধুদের নৈকট্য। সুন্দর জীবন গঠনে এ তিনের যে কত বড় ভূমিকা তা ওরা টের পাবে বাকী জীবনের প্রতিটি ধাপে! প্রতিটা বাঁকে বাঁকে!! চলবে…

লেখক: সম্পাদক, সিমেকনিউজ ডটকম।