Home মতামত আত্মহত্যা কোনো সমাধান নয়, প্রতিকার ও প্রতিরোধ প্রয়োজন

আত্মহত্যা কোনো সমাধান নয়, প্রতিকার ও প্রতিরোধ প্রয়োজন

48

রিপন আল মামুন:

প্রতিবছরই আশঙ্কাজনক ভাবে বিশ্বব্যাপী আত্মহত্যার পরিমাণ বেড়েই চলছে। নিম্ন, মধ্যবিত্ত এমনকি উন্নত দেশগুলোতেও একই সাথে পাল্লা দিয়ে আত্মহত্যার পরিমাণ বেড়ে যাচ্ছে। বাংলাদেশও এর বাইরে নয়। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (হু), বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) এবং বিভিন্ন বেসরকারি সংস্থাগুলোর প্রতিবেদন গুলোর দিকে তাকালেই বুঝা যায় বাংলাদেশও আত্মহত্যার অভিশাপের বেড়াজালে বন্দি। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার গবেষণার তথ্য অনুযায়ী, প্রতি বছর বিশ্বে আত্মহত্যা করে প্রায় ৮ লাখ মানুষ। দৈনিক এ হার ২ হাজার ১৯১ এবং প্রতি লাখে ১৬ জন। গত ৫০ বছরে সারা বিশ্বে, বিশেষ করে উন্নয়নশীল দেশগুলোতে আত্মহত্যার হার বেড়েছে ৬০ শতাংশ। এর মধ্যে বাংলাদেশে আত্মহত্যার প্রবণতা বৃদ্ধি পেয়েছে ২ দশমিক ৬ শতাংশ। প্রতি বছরই এ হার বৃদ্ধি পাচ্ছে। গণমাধ্যম সূত্রে প্রাপ্ত তথ্যানুসারে, বিশ্বে প্রতি ৪০ সেকেন্ডে একজন এবং বাংলাদেশে প্রতিদিন গড়ে প্রায় ৩০ জন মানুষ আত্মহত্যা করছে। বিভিন্ন গবেষণায় দেখা যায়, বাংলাদেশে গত ৬ বছরে প্রায় ৭০ হাজার মানুষ আত্মহত্যার পথ বেছে নিয়েছে।

পরিসংখ্যানিক এই উপাত্ত গুলো একেবারেই উপেক্ষা করার মত নয়। এই যে এতগুলো মানুষ নিজেদের জীবনকে শেষ করে দিচ্ছে। নিজের পরিবার-পরিজন, আত্মীয়-স্বজন, এমনকি এই সুন্দর পৃথিবীর মায়া কাটিয়ে আত্মহত্যাকে সমাধানের পথ হিসেবে বেছে নেয়। মনোবিজ্ঞানীদের ভাষ্যমতে যারা আত্মহত্যা করে, তারা তখন এটিকে একমাত্র সমাধানের পথ হিসেবে মনে করে বলেই এটিকে গ্রহণ করে।
কিন্তু প্রশ্ন হতে পারে তারা কখন কিসের সমাধান খুঁজে এটিতে? ইতালির কবি ও ঔপন্যাসিক সেসার পাভিস এক প্রশ্নের উত্তর দিয়েছেন এভাবে, ‘আত্মহত্যা করার জন্য কারো কারণের অভাব হয় না।’ তাত্ত্বিকরা এ কারণগুলোকে ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করেছেন নানাভাবে। তাই গড়ে উঠেছে একাধিক তত্ত্ব। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্লিনিক্যাল সাইকোলজি বিভাগের প্রধান ড. মো. কামরুজ্জামান মজুমদার বলেন, ‘আত্মহত্যার অনেক কারণ থাকতে পারে। তার মধ্যে একটি হলো- মানসিক চাপ। প্রত্যেকেরই কিছু না কিছু মানসিক চাপ থাকে। চাপটা বেশি হয়ে গেলে কারো কারো মনে হয়, তিনি আর সমস্যার সমাধান করতে পারছেন না। পরিস্থিতির সঙ্গে খাপ খাওয়াতে পারছেন না। তখন জীবন থেকে পালানো বা আত্মহত্যার পথটাই তার কাছে সহজ মনে হয়।’

তাছাড়া যারা আত্মহত্যা করছে তাদের পারিবারিক অবস্থা এবং আত্মহত্যার কারণগুলো অনুসন্ধান করলে দেখা যায় এতে বিভিন্ন মনস্তাত্ত্বিক দিক রয়েছে। হতাশা, জীবনের আনন্দ হারিয়ে ফেলা, বিষণ্ণতা, উদ্বিগ্নতা, সমস্যা সমাধান করার ক্ষমতা কমে যাওয়া, ক্ষমতা হ্রাস পাওয়া যা আগে ছিল এবং আবেগ নিয়ন্ত্রণে দুর্বলতাসহ বহু মনস্তাত্ত্বিক কারণ রয়েছে এই আত্মহত্যার পেছনে। তাই বলে এই আত্মহত্যাকে
অভিশাপ মনে করে অবহেলা করলে চলবে না। এর থেকে উত্তরণের পথ আমাদের খুঁজতে হবে। এজন্য আমাদের সম্মিলিত প্রচেষ্টা প্রয়োজন। আমাদের পরিবার, স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় এমনকি সামাজিকভাবে যেসব মানুষ আত্মহত্যার বিষয়ে ঝুঁকিপূর্ণ তাদের প্রতি আমাদের বিশেষ দৃষ্টি দেওয়া উচিত। পরিবারে যে মানুষটি হতাশার সাগরে ডুবে রয়ে জীবনের বেঁচে থাকার আগ্রহটাই হারিয়ে ফেলেছে তার প্রতি বিশেষ যত্ন নেওয়া উচিত। প্রয়োজন হলে তাকে মনোরোগ বিশেষজ্ঞের কাছে নিয়ে যাওয়া উচিত। কারণ মানসিক সুস্থতা শারীরিক সুস্থতার চেয়ে কোন অংশেই কম নয়। আবার স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ে সচেতনতা মূলক সভা সমাবেশ, মিছিল মিটিং আত্মহত্যা প্রতিরোধে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে।

একটি লক্ষ্যনীয় বিষয় হলো আত্মহত্যার মতো একটি আবেগীয় বিষয়েরও বৈধতা রয়েছে। একটি মানুষ হতাশায় ডুবে গিয়ে আত্মহত্যার পথ বেছে নেওয়ার চেষ্টা করে আর আমরা সেটিকেই কিনা বৈধতা দিয়েছি। নতুন করে পৃথিবী এই প্রশ্নের সম্মুখীন হচ্ছে। বেশিরভাগ পশ্চিমা দেশগুলিতে আত্মহত্যা কোন অপরাধ নয়। অস্ট্রেলিয়াতেও আত্মহত্যার বৈধতা রয়েছে। ১৯৯৬ থেকে ১৯৯৭ সাল পর্যন্ত অস্ট্রেলিয়ার উত্তরাঞ্চলীয় প্রদেশে বৈধ ডাক্তারের সহায়তায় আত্মহত্যার ব্যবস্থা ছিল। ইউরোপের কোনও দেশ আত্মহত্যা বা আত্মহত্যার চেষ্টা করাকে অপরাধ বলে মনে করা হয় না। ইংল্যান্ড ও ওয়েলস আত্মহত্যার আইন ১৯৬১ এবং রিপাবলিক অফ আয়ারল্যান্ডের মাধ্যমে ১৯৯৩ সালে আত্মঘাতী হত্যাকাণ্ডকে অপরাধ থাকে অব্যাহতি দেয়া হয়েছিল। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও সুইজারল্যান্ডেও এই ঘৃন্য কাজটিকে বৈধতা দেওয়া হয়েছে। একটি হাস্যকর বিষয় হচ্ছে সুইজারল্যান্ডের লাউসনে হাইকোর্ট ২০০৬ সালের রায়ে মনস্তাত্ত্বিক সমস্যার সঙ্গে জড়িত একটি বেনামী ব্যক্তিকে তার নিজের জীবন শেষ করার অধিকার প্রদান করেছিল

ব্যক্তির স্বাধীনতার নামে কাউকে আত্মহত্যার বৈধতা না দিয়ে এই অভিশাপ থেকে উত্তরণের সময়োপযোগী সিদ্ধান্ত গ্রহণের সময় এসেছে এখন। তবে এটাও অস্বীকার করা যায় না যে যেসব দেশে আত্মহত্যার বৈধতা নেই সেখানেও প্রচুর আত্মহত্যার ঘটনা ঘটে। তাই এখন আমাদের সময়োপযোগী সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে হবে। সামাজিক ও ধর্মীয়ভাবে নীতি-নৈতিকতার প্রসার ঘটাতে হবে। বিশেষ করে ছাত্র-ছাত্রীদের সচেতনতায় শিক্ষা ব্যবস্থাকে জীবন ঘনিষ্ঠ করা উচিত। সর্বোপরি সকলের সম্মিলিত প্রচেষ্টাই পারে আত্মহত্যার মতো অভিশাপ থেকে আমাদের মুক্ত করতে।
এজন্য আজ ‘বিশ্ব আত্মহত্যা প্রতিরোধ দিবসে’ আমাদের সকলের স্লোগান হোক –
আত্মহত্যা কোনো সমাধান নয়
প্রতিকার ও প্রতিরোধে একে করব জয়।

-লেখক: শিক্ষার্থী, মনোবিজ্ঞান বিভাগ। জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা।