Home সারাদেশ আজ মুক্তিযোদ্ধা মোড়ল আব্দুস সালামের দ্বাদশ মৃত্যুবার্ষিকী।

আজ মুক্তিযোদ্ধা মোড়ল আব্দুস সালামের দ্বাদশ মৃত্যুবার্ষিকী।

75

নজরুল ইসলাম, তালা, সাতক্ষীরা প্রতিনিধিঃ ২০১১ সালের ৫ জুলাই তিনি আমাদের সকলকে ছেড়ে না ফেরার দেশে পাড়ি জমান।
মহান মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক মুক্বিযুদ্ধকালীন তালা থানা মুজিব বাহিনী কমান্ডার,জীবদ্দশায় অসাম্প্রদায়িক রাজনীতিক হিসেবে সমাজ পরিবর্তনের ও দুর্নীতিমুক্ত বাংলাদেশ গড়ার প্রত্যয়ে বিপ্লবী আর্দশের বীর সৈনিক রূপে স্বাক্ষর রেখে গেছেন তিনি। তার আদর্শ ও জীবন আচরণ সকলকে উজ্জীবিত ও অনুপ্রাণিত করবে। ৭১’র অকুতোভয় বীর সেনানী মোড়ল আব্দুস সালাম জন্মগ্রহণ করেন ১৯৪৮ খ্রিঃ ১লা এপ্রিল সাতক্ষীরা জেলার তালা উপজেলার কৃষ্ণকাটি গ্রামে। তার পিতার নাম হাজী আবুল কাশেম মোড়ল, মাতা আশাফুন্নেছা বেগম। ৩ ভাই ৪ বোনের মধ্যে তিনি সবার বড়। ছোট বেলায় তার বাবা-মা ও গ্রামবাসি আদর করে তাকে ডাকত বাঁচা বলে। লেখাপড়ার হাতে খড়ি কৃষ্ণকাটি প্রাইমারী স্কুলে। পরবর্তীতে ভর্তি হন কপিলমুনি সহচারী বিদ্যামন্দিরে। স্কুলে লেখাপড়ার সময় ১৯৬২ সালে ৮ম শ্রেণির ছাত্র থাকা অবস্থায় তদানীন্তন পাকিস্তান সরকারের হামিদুর রহমান শিক্ষা কমিশন বাতিলের আন্দোলন ও ধর্মঘট পালনের মধ্যে দিয়েই মূলত রাজনীতিতে হাতে খড়ি। তিনি ১৯৬৪ সালে কপিলমুনি সহচারী বিদ্যামন্দিরে ছাত্রদের বিভিন্ন দাবির আন্দোলন, স্কুলের নির্বাচিত ছাত্র মনিটর এবং ছাত্র ইউনিয়ন শাখার সভাপতি। ১৯৬৫ সালে ওই স্কুল থেকে ২য় বিভাগে ম্যাট্রিকুলেশন সম্পন্ন করেন। উচ্চ শিক্ষা লাভের উদ্দেশ্যে পরবর্তীতে ভর্তি হন বাংলার ঐতিহ্যবাহী বিদ্যাপীঠ দৌলতপুর ব্রজলাল (বি.এল কলেজ) মহাবিদ্যালয়ে এবং ১৯৬৬ সালে দৌলতপুর কলেজ শাখার ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। ১৯৬৭ সালে কৃতিত্বের সাথে উচ্চ মাধ্যমিক পাশ করেন। উচ্চ শিক্ষা লাভের আশায় পরবর্তীতে বাগেরহাট আচার্য্য প্রফুল্ল্য চন্দ্র মহাবিদ্যালয়ে (পি.সি কলেজ) স্নাতকে ভর্তি হন। সে সময়ে দেশে রাজনীতি তুঙ্গে, তিনিও সক্রিয়ভাবে ছাত্র রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়েন। ১৯৬৮-৭০ সালে পর পর দু’বার বাগেরহাট মহাকুমায় ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন।
১৯৬৯ সালে ১লা ফেব্রুয়ারি সরকার বিরোধী গণআন্দোলনে ক্যাম্পাস থেকে গ্রেপ্তার হন এবং ২ ফেব্রুয়ারি আন্দোলন মুখে সরকার তাকে মুক্তি দিতে বাধ্য হয়। একই বছর তৎকালীন পাকিস্তানের মন্ত্রী খান এ সবুর খান তার রাজনৈতিক সফরে তালায় এসে পরবর্তীতে কৃষ্ণকাটি হাইস্কুল পরিদর্শণে যান। এই সময় সবুর খান তার অঞ্চলে আসার প্রতিবাদে পাড়া থেকে ছেড়া জুতা সংগ্রহ করে কৃষ্ণকাটি রাস্তায় রাস্তায় জুতোর মালা টাঙ্গিয়ে দেন। ছাত্র অবস্থায় তিনি ১৯৭১ সালে জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর আহবানে মক্তিযুদ্ধে অংশ গ্রহন করেন এবং সাতক্ষীরার তালা পাইকগাছার উপজেলার কপিলমুনি অঞ্চলের অন্যতম সংগঠকের ভুমিকা পালন করেন। দেশের রাজনৈতিক টানা পোড়নের এক পর্যায় ১৯৭২ সালের ৩১ অক্টোবর জাসদ গঠনে সক্রিয় ভূমিকা পালনের পাশাপাশি ১৯৭৪ সালে খুলনা, বাগেরহাট, সাতক্ষীরা, নড়াইল, গোপালগঞ্জ, পিরোজপুর সহ কয়েকটি জেলার গণবাহিনী প্রধান ও সি.ও.সি. এর সদস্য হিসাবে দায়িত্ব পালন করেন। বর্ণাঢ্য রাজনৈতিক জীবনে কয়েকবার কারা বরণ করেন। প্রগতিশীল প্রতিটি আন্দোলনে তিনি ছিলেন সক্রীয়। তার দলের মতাদর্শগত সংগ্রাম পরিচালনায় বাঁধাগ্রস্থ হয়ে দল থেকে বিচ্ছিন্ন হন এবং বাসদ গঠন করে বাসদের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য নির্বাচিত হন। ১৯৮৪ সালে সংস্কারপন্থি জাসদের সাথে যুক্ত হন এবং ১৯৮৬-১৯৮৮ মেয়াদে জাসদের খুলনা জেলার সভাপতি ও পরবর্তীতে আমৃত্যু জাসদের (জেএসডি) কেন্দ্রীয় কমিটির সহ-সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন। মোড়ল আব্দুস সালাম তাঁর বর্ণাঢ্য রাজনীতির পাশাপাশি দেশের উন্নয়নে বিভিন্ন সামাজিক ও ইস্যুভিত্তিক আন্দোলনেও যুক্ত ছিলেন। তিনি ১৯৯৭ সালে হোমল্যান্ড লাইফ ইন্সুরেন্স কোম্পানীর খুলনা বিভাগীয় সমন্বয়কারী ছিলেন। এছাড়াও কেন্দ্রীয় পানি কমিটি ও ভূমি কমিটি পরিচালনায় দক্ষ ভূমিকা পালন করেন। দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের সামাজিক ও পরিবেশগত সমস্যায় সুপেয় পানির নিশ্চয়তা এবং এতদঞ্চলে জলাবদ্ধতা নিরসন আন্দোলনে কেন্দ্রীয় পানি কমিটির অন্যতম পুরোধা। এছাড়াও খুলনা সাতক্ষীরা অঞ্চলে খাস জমিতে ভূমিহীনদের অধিকার প্রতিষ্ঠার আন্দোলন সংগ্রাম এবং ভূমিহীন নারী পুরুষদের মাঝে খাসজমি বিতরণের নেতৃত্ব দেন। তিনি তালা উপজেলা ভূমি কমিটির সভাপতি ও কেন্দ্রীয় ভূমি কমিটির সহ-সভাপতি হিসাবে আমৃত্যু দায়িত্ব পালন করেন। তালা উপজেলার খাসজমি চিহ্নিতকরণ, ভূমিহীন বাছাই ও তালিকা প্রণয়ন ছিল তারই চিন্তার ফসল। সামাজিক জীবনে বীর মুক্তিযোদ্ধা মোড়ল আব্দুস সালাম শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, ক্লাব, ক্রীড়া প্রতিষ্ঠানের সাথে যুক্ত থেকে নিরলসভাবে কাজ করেছেন। তিনি কানাইদিয়া রথখোলা বালিকা মাধ্যমিক উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠাতা সদস্য, রায় সাহেব বিনোদ বিহারী সাধু স্মৃতি সংসদের আজীবন সদস্য, কপিলমুনি পাবলিক লাইব্রেরীর প্রতিষ্ঠাতা সহ-সভাপতি, কপিলমুনি আঞ্চলিক বিজ্ঞান ও যুক্তিবাদী সমিতির সভাপতি, কপিলমুনি ক্রীড়া শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের প্রধান পৃষ্ঠপোষক, কৃষ্ণকাটি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের পরিচালনা পর্ষদের সভাপতি সহ আরও বহু প্রতিষ্ঠানের গুরুত্বপূর্ণ পদে অধিষ্ঠিত ছিলেন। ব্যক্তি জীবনে মোড়ল আব্দুস সালাম এক কন্যা সন্তানের জনক। তিনি ছিলেন সম্পুর্ণ নির্লোভ, খাঁটি বাঙালী এবং আদর্শ দেশপ্রেমিক, সদালাপী, বিনয়ী, যুক্তিবাদী ও বিজ্ঞান মনোস্ক। তিনি কখনও সুযোগ সন্ধানী ছিলেন না। মানবতাবাদী ও অসাম্প্রদায়িকতাই ছিল তার ধর্ম। সকলের কাছে প্রিয় এই মানুষটি আমাদের মাঝে নেই। তিনি গত ৫ জুলাই ২০১১ খ্রিঃ মঙ্গলবার না ফেরারদেশে চলে জান। আমরা এ বীর সেনানীর অকাল প্রয়াণে শোকাহত, মর্মাহত। আমরা তাঁর বিদেহী আত্মার চির শান্তি কামনা করি।