Home মতামত আটলান্টিকের বুকে টাইটান সাবমেরিনে দুর্ঘটনা

আটলান্টিকের বুকে টাইটান সাবমেরিনে দুর্ঘটনা

57

নেহাৎ দুর্ঘটনা না অন্য কিছু?

পাঁচজন যাত্রী নিয়ে টাইটানিকের অনুসন্ধানে গিয়ে আটলান্টিক মহাসাগরে বিস্ফারিত ডুবোজাহাজ টাইটান এর সলিলসমাধি কী স্রেফ একটি দুর্ঘটনা, নাকি কান্ডজ্ঞানহীন কারো দায়িত্বে অবহেলা করুণ পরিণতি ?

নিউফাউন্ডল্যান্ডের হার্বারসাইড পার্ক থেকে যাত্রা শুরু করেছিল পাঁচজন সৌখিন অভিযাত্রী সহ টাইটান সাবমার্সিবল।
প্রায় ১১১ বছর আগে আটলান্টিক মহাসাগরে নিমজ্জিত টাইটানিক জাহাজটি দেখতে সাগরে ডুব দেবার ৯০ মিনিট পর পানির প্রচণ্ড চাপে টাইটান ধ্বংস হয়ে যায়।

ডুবোযানটির যাত্রীদের মধ্যে ছিলেন ওই যাত্রার আয়োজনকারী কোম্পানি ওশানগেটের প্রধান( সিইও) ৬১ বছর বয়স্ক স্টকটন রাশ, ব্রিটিশ অভিযাত্রী হ্যামিশ হার্ডিং (৫৮), পাকিস্তানি-ব্রিটিশ ব্যবসায়ী শাহজাদা দাউদ (৪৮) ও তার পুত্র সুলেমান দাউদ (১৯), ও ফরাসি ডুবুরি পল হেনরি নরগোরলেট।
যে সর্ববৃহৎ যাত্রীবাহী জাহাজটি বানানো হয়েছিল এমন অহংকার নিয়ে যে এই টাইটানিক কোনদিন ডুববে না। অথচ এটির প্রথম ভয়েজেই সলিল সমাধি ঘটলো ১৯১২ সালে।
অবশেষে এই জাহাজের সন্ধান মিললো কানাডার নিউফাউন্ডল্যান্ডের সেন্ট জোনস থেকে প্রায় চারশো কিলোমিটার দূরে আটলান্টিক মহাসাগরের প্রায় বারোহাজার পাঁচশো ফিট তলদেশে।
এই টাইটানিক নিয়ে মানুষের কৌতুহলের যেন শেষ নেই। রচিত হয়েছে অসংখ্য গল্প কাহিনী, নির্মিত হয়েছে কালজয়ী চলচ্চিত্র।
১১১ বছর পর ২০২৩ সালের ১৮ জুনে আটলান্টিকের তলদেশে নিমজ্জমান এই টাইটানিককে দেখার জন্য ওশান গেট পর্যটন কোম্পানির যে পরীক্ষামূলক (?) সাবমার্সিবল জাহাজটিতে চরে পাঁচজন উপরোক্ত সৌখিন যাত্রী যাত্রা শুরু করেছিল সেই জাহাজটির নামও রাখা হয়েছিল টাইটান ( টাইটানিকের নামের সাথে মিল রেখে ) । সেটি আটলান্টিকের দু’মাইল গভীরে যাবার পরই আটলান্টিকের পানির প্রচন্ড চাপে ফেটে গিয়ে সলিল সমাধি ঘটলো।
অর্থাৎ আইসবার্গের ধাক্কায় ডুবে যাওয়া এক টাইটানিককে দেখতে গিয়ে পানির চাপে ফেটে ডুবে গেল আরেক টাইটান।
তাহলে টাইটান নামটিই কী অভিশপ্ত?
আশ্চর্যের বিষয় এই যে টাইটান গত ১৮ জুন যাত্রা করেছিল সেন্ট জোনসের যে ঘাট থেকে সেই হারবার সাইড পার্কে আমরা বেড়াতে গিয়েছিলাম ১৭ জুনে। এর পরদিন টাইটান ছেড়ে গেল এই ঘাট থেকেই। দুদিন পর অর্থাৎ ২০ জুন ডুবেও গেল এখান থেকে ছেড়ে গিয়ে চারশো কিমি. দূরে আটলান্টিক মহাসাগরে।
শুনলাম পোলার প্রিন্স নামের যে গবেষণা জাহাজ টাইটানকে মনিটর করছিল সেটিও ফিরে এসেছিল সেন্ট জোনসের এই হারবারে। কিন্তু আমরা যাবার আগেই সেটি চলে গেছে ঘাট ছেড়ে। যে জাহাজটি ডুবন্ত টাইটানের ধ্বংসবশেষ সংগ্রহ করে নিয়ে এসেছে তার নাম হরাইজন আর্কটিক। এটি কানাডার পতাকাবাহী জাহাজ। জাহাজটিতে করে দুর্ঘটনায় কবলিত জাহাজের সামনের, পেছনের এবং জাহাজে উঠার সিড়ির কিছু অংশ নিয়ে আসা হয়েছে।
এখন আমেরিকান কোস্ট গার্ড,আমেরিকা ও কানাডার ফরেনসিক ডিপার্টমেন্ট এবং সংশ্লিষ্ট আরোও কয়েকটি ডিপার্টমেন্ট মিলে যৌথভাবে গবেষণা করে জাহাজটি সাগরের তলদেশে বিস্ফোরণের প্রকৃত করানসহ উদ্ধারকৃত ধ্বংসাবশেষে হতভাগ্য পাঁচজন আরোহীর দেহের অংশবিশেষ আছে কিনা তা পরীক্ষা করে দেখবে। কোস্ট গার্ড জানিয়েছে এটা একটি দীর্ঘ ও জটিল ও সময়সাপেক্ষ পরীক্ষা ফলে এতে বেশ সময় লাগতে পারে।
ওশান গেইটের সিইও বলেছিলেন তিনি কার্বন ফাইবার ও টাইটেনিয়াম ধাতুর সংমিশ্রণে এই সাবমার্সিবল জাহাজটি তৈরি করেছিলেন আন্তর্জাতিক রীতিনীতি না মেনে। তবে তিনি আরোও নাকি বলেছিলেন এই জাহাজ তৈরিতে আন্তর্জাতিক রীতিনীতি মানা না হলেও এটির পরীক্ষামূলক তৈরীতে যথেষ্ট যুক্তি রয়েছে। যেভাবে এটি তৈরি করা হয়েছে তা পাথরের মত শক্ত ।
টাইটানিক বানিয়েও নির্মাতারা বলেছিল টাইটানিকের লোহায় যে কার্বনের অনুপাত দেয়া হয়েছে তা জাহাজটিকে অতিরিক্ত স্হায়ীত্ব দেবে।
অর্থাৎ দুটো জাহাজই অনেকটা নিয়মভেঙেই বানানো হয়েছিল অতিরিক্ত নিরাপদে সমুদ্রে ( Sea worthiness) চলার ধারনাকে মাথায় রেখে।
পর্যটন সংস্থা ওশান গেইট এর পরীক্ষামূলক জাহাজ টাইটান সাবমার্সিবল পাঁচজন যাত্রী নিয়ে আটলান্টিক মহাসাগরের তলদেশে ডুবে থাকা টাইটানিককে দেখতে গিয়ে বিস্ফারিত হয়ে ধ্বংস হয়ে গেছে। দু:খজনকভাবে মারা গেছেন এর প্রধান নির্বাহী মি. রাশও। কিন্তু তারপরও পর্যটন সংস্থা ওশান গেইট থাকবে। চালাবে এ ধরনের ব্যবসা। সেই কারনেই কী এখন টাইটানের দুর্ঘটনার সকল দায়দায়িত্ব রাশের উপর চাপিয়ে নিজেরা দায়মুক্তি পেতে চাচ্ছেন? একটি জাহাজ কী শুধু একজনের পরিকল্পনায় বা হাতে তৈরি হয়? নাকি নেভাল আর্কিটেক্ট সহ নেভাল ইন্জিনিয়ার এবং অনেক কর্মকর্তা কর্মচারী ও শ্রমিকের যৌথপ্রচেষ্টায়, সর্বোপরি একটি কোম্পানির নির্দেশনায় তৈরি হয় এরকম একটি জাহাজ?
এখন বলা হচ্ছে ওশান গেইট পর্যটন কোম্পানির সিইও কোন নিয়মকানুন না মেনে এই জাহাজ বানিয়েছেন। তিনি নাকি কোন এক সাক্ষাৎকারে স্বীকারও করেছেন যে ধাতব বস্তু দিয়ে টাইটান তৈরি করা হয়েছে তা গভীর মহাসগরে ডুব দেওয়ার মত স্টান্ডার্ডের না। তা যদি সত্যি হয় তাহলে কোম্পানি কেন এই জাহাজটিকে দিয়ে এই ভয়েজ করালো। তা কী শুধু রাশেরই একক সিদ্ধান্তে?
নাকি এখন রাশ আর জীবিত নেই, তাই তার উপর যত রকমভাবে পারা যায় দোষ চাপিয়ে দিয়ে, কোম্পানি ধোয়া তুলসীপাতা হয়ে নির্বিঘ্নে তাদের ব্যবসা পরিচালনা করতে চান? তার জন্য সব অপপ্রচার চালানো হচ্ছে রাশের উপর?
সময়ই সব বলে দেবে। আমেরিকান – কানাডিয়ান সংস্হা তদন্ত করে দেখছে সব। আমেরিকান কোস্টগার্ড বলেছে তারা জাহাজটি দুর্ঘটনার কারন ও জাহাজের উদ্বারকৃত ধ্বংসাবশেষে নিহত যাত্রীদের লাশের অংশ আছে কি না ইত্যাদি বিস্তারিত সব কিছুই পরীক্ষা নিরীক্ষা করে বের করবে।
আমরা ততদিন না হয় তার অপেক্ষায়ই থাকলাম।

-লেখক: মানিক চন্দ্র দে, সাবেক অতিরিক্ত সচিব এবং প্রফেশনাল শিপিং বিষয়ে নরওয়েতে বিশেষ প্রশিক্ষণ প্রাপ্ত