ডেস্ক রিপোর্ট: গোটা ইউরোপ ও চীনের কিছু অংশে এবারের গ্রীষ্মে তাপমাত্রার সর্বোচ্চ রেকর্ড হয়েছে। খরার কারণে আফ্রিকায় লাখ লাখ লোক খাদ্য ঝুঁকিতে পড়েছে। আমেরিকার পশ্চিমাঞ্চলে বৃষ্টি হচ্ছেই না বললেই চলে। বিজ্ঞানীরা বলছেন, এবার উষ্ণ ও শুষ্ক ঋতু রেকর্ড করতে পারে, কিন্তু গত কয়েক মাস কি রেকর্ড পরিমাণে শুষ্ক আবহাওয়া ছিল? বা পৃথিবী আসলে কতটা শুষ্ক? এসব বিষয় নিয়ে এক ধরনের উৎকণ্ঠা বিরাজ করছে। বিজ্ঞানীদের খরা পরিস্থিতির একটি পরিমাপ মাটির আর্দ্রতার স্তরের উপর ভিত্তি করে করা হয়। স্যাটেলাইটের মাধ্যমেও খরার চিত্র ফুটে উঠে।

সম্প্রতি আবহাওয়ার ধরণ কতটা চরম হয়েছে তার একটি চিত্র তৈরি করতে গত তিন মাসের এই শুষ্ক অবস্থাকে এই শতাব্দীর শুরু থেকে গড় অবস্থার সঙ্গে তুলনা করা হয়। যেখানে মাটির অবস্থা ও তাপমাত্রার তথ্য-উপাত্ত উভয়ের ওপর ভিত্তি করে মাটির আর্দ্রতার অসঙ্গতি তথ্য তুলে ধরা হয়। দেখা যাচ্ছে যে, বেশিরভাগ ইউরোপ এই গ্রীষ্মে ২০০১ সাল থেকে ২০১৬ সালের এই সময়ে গড় আবহাওয়ার তুলনায় অনেক বেশি শুষ্ক ছিল। অন্যত্র, চীনের পশ্চিমে আবহাওয়া খুব শুষ্ক হয়েছে, অনেক অঞ্চল আবার চরম খরার সম্মুখীন হয়েছে। সাব-সাহারান আফ্রিকা ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বেশ কিছু অংশেও শুষ্ক অবস্থা বিরাজমান ছিল। ইউরোপীয় ইউনিয়নের পরিবেশবিষয়ক কর্মসূচির তথ্য অনুযায়ী, ইউরোপে ৫০০ বছরে খরার সর্বোচ্চ রেকর্ড হয়েছে এবার। আগস্টের শেষের দিকে ইউরোপের প্রায় অর্ধেকে চরম শুষ্কতা দেখা দেয়।

বিজ্ঞানীরা বলছেন জলবায়ু পরিবর্তন মানে ইউরোপ আরও ঘন ঘন ও ক্রমাগত খরার মুখে পড়তে থাকবে। এ বছরের শুষ্ক পরিস্থিতি এরই মধ্যে কৃষি, পরিবহন ও জ্বালানি উৎপাদনকে ব্যাহত করছে। রাইন, একটি প্রধান নদী ও কার্গো রুট। এবারের গ্রীষ্মে নদীটির পানি নিম্নস্তরে নেমে গেছে, যার ফলে শিপিং কার্যক্রম ব্যাহত হচ্ছে। গত জুন থেকে আগস্টের মধ্যে সময়কাল ছিল রেকর্ডে সর্বোচ্চ উষ্ণতম। আগস্টে ইইউর একটি প্রতিবেদনে আরও অন্তত তিন মাস ‘উষ্ণ ও শুষ্ক’ অবস্থার পূর্বাভাস দেওয়া হয়। ইউরোপে অতীতেও খরার সর্বোচ্চ রেকর্ড হয়েছে। কিন্তু সম্প্রতি কয়েক বছর ধরে উচ্চ তাপমাত্রার রেকর্ড হচ্ছে, যেটি সংকটকে আরও ঘনীভূত করছে। রাইনে খরার কারণে ৩০ সেন্টিমিটার পানি শুকাতে বাকি আছে মাত্র। পটসডাম ইনস্টিটিউট ফর ক্লাইমেট ইমপ্যাক্ট রিসার্চের গবেষক ড. ফ্রেড হ্যাটারম্যান বলেছেন, ‘আমরা গত পাঁচ বছর ধরে একটানা খরার সম্মুখীন হচ্ছি এবং এ বছরে শত শত বছরের মধ্যে সবচেয়ে খারাপ পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়। বিষয়টি শুধু কম বৃষ্টি হওয়া নয়, আরও বেশি উষ্ণ পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে, তাই সামগ্রিক মাটির আর্দ্রতা হ্রাস পেয়েছে’।

চীনে খরা আবার বন্যা দুই ধরনের পরিস্থিতি তৈরি হয় এবার। এই গ্রীষ্মে, চীনে উচ্চ তাপমাত্রার রেকর্ড হয়েছে। এমন পরিস্থিতি দুই মাসেরও বেশি সময় স্থায়ী হয়। ৬০-র দশকে রেকর্ড শুরু হওয়ার পর থেকে এটির স্থায়ীত্ব বেশি বলছে, চীনের আবহাওয়াবিষয়ক প্রশাসন। চরম তাপমাত্রা ও বৃষ্টিপাতের অভাবে চীনের বৃহত্তম নদী ইয়াংজি সংকুচিত হয়ে গেছে। চীনের সরকারি তথ্য অনুযায়ী, আগস্ট মাসে নদী সংলগ্ন এলাকায় ৬০ শতাংশ কম বৃষ্টিপাত হয়েছে। দক্ষিণ চীনের বিশাল এলাকা খরার সঙ্গে লড়াই করলেও, উত্তরাঞ্চলে ভারি বৃষ্টিপাতের ফলে বন্যা দেখা দিয়েছে। উত্তর চীনের লিয়াও নদী ১৯৬১ সাল থেকে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ রেকর্ড করেছে জল নিচে নামার দিক থেকে।

চীনের বার্ষিক জলবায়ু পরিবর্তন সমীক্ষা বলছে, দেশজুড়ে ২০১২ সাল থেকে বৃষ্টিপাত ক্রমাগত বৃদ্ধি পেয়েছে। গত জুলাই মাসে, চীন সরকার ৮টি খরা সতর্কতা এবং ১৩ হাজার ভারি বৃষ্টির সতর্কতা জারি করে। ২০১৯ সালের একই সময়ে ২৮টির বেশি খরা সতর্কতা এবং ১০ হাজার ভারি বৃষ্টির সতর্কতা জারি ছিল দেশটিতে।চরম ভেজা ও শুষ্ক উভয় অবস্থাই বিশ্বজুড়ে জলবায়ু পরিবর্তনের একটি বিশেষ বৈশিষ্ট্য বলে লক্ষ্য করা যাচ্ছে।

ইউএস ন্যাশনাল একাডেমি অব সায়েন্সেস-এর জল বিশেষজ্ঞ পিটার গ্লিক বলেছেন,‘সাইবেরিয়া ও পশ্চিম মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মতো যখন খরার অঞ্চল বৃদ্ধি পায়, তখন সেই জল একটি ছোট এলাকায় অন্যত্র পড়ে, বন্যার মতো অবস্থা সৃষ্টি করে’। আফ্রিকায় দুর্ভিক্ষের আশঙ্কা করা হচ্ছে। পূর্ব ইথিওপিয়া, উত্তর কেনিয়া ও সোমালিয়ায় খরা পরিস্থিতির কারণে জাতিসংঘ সতর্ক করেছে, প্রায় ২ কোটি ২০ লাখ মানুষ খাদ্য ঝুঁকিতে পড়তে পারে।

অক্সফাম বলছে, ‘আমরা এখন মহাদেশের সেই অংশে উচ্চ তাপমাত্রাসহ খুব কম বৃষ্টিপাতের তৃতীয় বছরে আছি’। সোমালিয়ায় গত মার্চ থেকে মে মাস পর্যন্ত এই মৌসুমে বৃষ্টিপাত গত ছয় দশকের মধ্যে সবচেয়ে কম হয়েছে। কঙ্গো ও উগান্ডার বড় অংশ গড়ে বেশি শুষ্ক অবস্থার সম্মুখীন হয়েছে। কিন্তু দক্ষিণ সুদান, মৌরিতানিয়া ও সেনেগালের মতো কিছু দেশে কীভাবে ভয়াবহ বন্যা হয়েছে এবার। দক্ষিণ আফ্রিকার অনেক অংশে স্বাভাবিক মাত্রার চেয়ে অনেক বেশি বৃষ্টিপাত হয়েছে।

২০২১ সালে বিশ্বব্যাংকের একটি প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, সামগ্রিকভাবে ‘১৯৭০-৭৯ সালের তুলনায়, খরা ও বন্যার সংখ্যা ২০১০-১৯ সালের মধ্যে যথাক্রমে প্রায় তিনগুণ এবং দশগুণ বেড়েছে। যুক্তরাষ্ট্রে খরা পরিস্থিতিও প্রকট আকার ধারণ করে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পশ্চিমে খরা পরিস্থিতি স্বাভাবিক ঘটনা হয়ে দাঁড়িয়েছে। এই অঞ্চলে বছরের পর বছর শুষ্ক ও উত্তপ্ত আবহাওয়া বিরাজ করছে। গত ফেব্রুয়ারিতে প্রকাশিত একটি প্রতিবেদনে, বিজ্ঞানীরা বলেন আমেরিকার পশ্চিমে গত দুই দশকে ১২শ বছরের মধ্যে সবচেয়ে চরম খরা পরিস্থিতি দেখা গেছে। এই গ্রীষ্মে, গরম ও শুষ্ক আবহাওয়র কারণে বেশ কয়েকটি রাজ্যে বনে আগুন লেগেছে এবং জল সঞ্চয়ের মাত্রা কমে গেছে। নাসার তথ্য বলছে, লেক পাওয়েল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের দ্বিতীয় বৃহত্তম জলাধার যা অ্যারিজোনা ও উটাহকে ঘিরে রয়েছে। এটি ৬০ এর দশকের পর থেকে সর্বনিম্ন স্তরে রয়েছে। জলবায়ু মডেলগুলো আভাস দেয় যে আগামী দশকগুলোতেও এই অঞ্চলে গড় হিসাব থেকে অনেক কম বৃষ্টিপাত হবে।
ইত্তেফাক