ডেস্ক রিপোর্ট: পুতিন ইউক্রেনকে যতটা দুর্বল করার চেষ্টা করছেন, ঠিক ততটাই চেষ্টা করছেন পশ্চিমাদের সঙ্গে দেশটির সম্পর্কে জড়ানোর আকাঙ্ক্ষা ধূলিসাতের। তিনি ইউক্রেনের ততটা ভূখণ্ডই দখলে নেবেন, যতটা নিজের কবজায় ধরে রাখতে পারবেন বলে মনে করবেন। ইউক্রেনের পূর্ব ও দক্ষিণাঞ্চলের ‘নতুন রুশ ভূখণ্ড’ থেকে তিনি খণ্ডিত ইউক্রেন রাষ্ট্রের ওপর ছড়ি ঘোরাতে চাইবেন।

ইতিহাস বলছে, পুতিনের আজকের এই নীতির সমান্তরাল সোভিয়েত জমানার নীতি। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় সোভিয়েত শাসক জোসেফ স্তালিন জার্মান সাম্রাজ্যকে দুর্বল করার পথ বেছে নিয়েছিলেন। এ ব্যাপারে যুক্তরাষ্ট্রের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট ফ্রাঙ্কলিন রুজভেল্ট ও ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী উইনস্টন চার্চিলের সঙ্গে তাঁর একটা সমঝোতা হয়েছিল। জার্মান সাম্রাজ্যের গোড়াপত্তন করেছিলেন অটো ভন বিসমার্ক, সেই ১৮৭১ সালে। বিশাল এই সাম্রাজ্যের বিস্তৃতি ছিল আধুনিক ফ্রান্সের আলজাস লরেন থেকে রাশিয়ার কোনিগসবার্গ (এখন কালিনিনগ্রাদ) পর্যন্ত।

স্তালিনের কাছে ইউরোপের সবচেয়ে বৃহৎ শক্তি জার্মানি শুধু সোভিয়েত ইউনিয়নের জন্য মারাত্মক হুমকিই ছিল না, দেশটিকে (জার্মানি) পুঁজিবাদী বিশ্বের অন্যতম অংশও মনে করতেন তিনি।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধকালীন তেহরান, ইয়ালটা ও পটসডামে বৈঠক করে রাশিয়া, যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্য—এ তিন দেশের নেতারা একমত হন যে জার্মান সাম্রাজ্যকে ভাগ করতে হবে। এতে এর আয়তনে বড় কোপ পড়বে। জার্মানির পূর্বাঞ্চলের বড় অংশ দেওয়া হবে পোল্যান্ড ও সোভিয়েত ইউনিয়নকে। এর আগে পোল্যান্ড তার পূর্বাঞ্চলের ভূখণ্ড হারিয়েছিল। ওডার ও নিহাইস নদী ধরে পোল্যান্ড-জার্মানির নতুন সীমান্ত চিহ্নিত করা হয়।

ফলে পূর্ব ইউরোপে থাকা প্রায় ১ কোটি ২০ লাখ জাতিগত জার্মানকে বিতাড়িত করে খণ্ডিত জার্মান সাম্রাজ্যে পাঠানো হয়। খণ্ডিত এ সাম্রাজ্যের অংশ ছিল জার্মানির পশ্চিম ও মধ্যাঞ্চল।

প্রথম প্রথম স্তালিন আশা করছিলেন, পুরো জার্মানিই কমিউনিস্ট ভাবধারায় বিশ্বাসী হবে ও সোভিয়েত ইউনিয়নের হস্তগত হবে। যখন বুঝলেন, এমনটা হওয়ার নয়, তখন তিনি প্রতিষ্ঠা করলেন পূর্ব জার্মানির, যার পোশাকি নাম দেওয়া হয় জার্মান ডেমোক্রেটিক রিপাবলিক (জিডিআর)। এটা ১৯৪৯ সালের অক্টোবরের ঘটনা। এর পাঁচ মাস আগে পশ্চিমাঞ্চল নিয়ে আত্মপ্রকাশ করে ফেডারেল রিপাবলিক অব জার্মানি।
স্তালিন ও তাঁর উত্তরসূরি সোভিয়েত নেতারা বরাবরই আশা করেছেন, জিডিআরই ফেডারেল রিপাবলিক অব জার্মানির জনগণকে কমিউনিজমের দিকে নিয়ে আসবে।

কিন্তু তেমনটা কখনোই হয়নি, বরং ১৯৮৯-৯০ সালে পূর্ব জার্মানির লোকজন কমিউনিস্ট শাসনের ছায়া থেকে বেরিয়ে ফেডারেল রিপাবলিক অব জার্মানিতে একীভূত হওয়ার পক্ষে ভোট দেন।

চলতি বছরের ফেব্রুয়ারিতে ইউক্রেনে হামলা শুরুর সময় ভ্লাদিমির পুতিন আশা করেছিলেন, তাঁর সেনাবাহিনী দ্রুতই দেশটির দখল নেবে; নামকাওয়াস্তে প্রতিরোধের মুখে পড়তে হবে; দেশটির নির্বাচিত সরকার পালিয়ে অন্য দেশে পাড়ি জমাবে। কিন্তু সেই আশার গুড়ে বালি পড়েছে।

পুতিন এখন ইউক্রেনের পূর্বাঞ্চল (স্বঘোষিত দোনেৎস্ক ও লুহানস্ক রিপাবলিক) দখলে নিয়ে দেশটিকে খণ্ডিত করার চেষ্টা করছেন এবং সেখানকার লোকজনের মধ্যে যাঁরা রাশিয়ার অনুগত নন, তাঁদের তাড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে। এ রকম ঘটনাই ঘটেছিল ইউক্রেনের দক্ষিণাঞ্চলের ক্রিমিয়া দখলের পর।

চলতি বছরের ফেব্রুয়ারিতে ইউক্রেনে হামলা শুরুর সময় পুতিন আশা করেছিলেন, তাঁর সেনাবাহিনী দ্রুতই দেশটির দখল নেবে; নামকাওয়াস্তে প্রতিরোধের মুখে পড়তে হবে; দেশটির নির্বাচিত সরকার পালিয়ে অন্য দেশে পাড়ি জমাবে। কিন্তু সেই আশার গুড়ে বালি পড়েছে।

ইউক্রেনের পূর্ব ও দক্ষিণাঞ্চল এখন থেকে রাশিয়ার অংশ—এমন দাবি প্রকাশ্যেই করছেন রুশ সামরিক কমান্ডার ও সরকারি কর্মকর্তারা। রাশিয়ার শিক্ষামন্ত্রী সের্গেই রাভস্টভ সম্প্রতি ঘোষণা দেন, ইউক্রেনের পূর্ব ও দক্ষিণাঞ্চলের শিক্ষাব্যবস্থা এমনভাবে ঢেলে সাজানো হবে, যাতে সেখানে রাশিয়াবিরোধী কোনো মনোভাব উসকে উঠতে না পারে।

রাশিফিকেশন বা জনগণের ওপর রাশিয়ার সংস্কৃতি চাপিয়ে দেওয়ার নীতির বিষয়টি জাতিগত শুদ্ধি অভিযান হিসেবেই প্রতীয়মান হচ্ছে। গত মে মাসে ইউক্রেনের পার্লামেন্টের মানবাধিকারবিষয়ক কমিশনার লিউদমাইলা দেনিসোভা জাতিসংঘের শরণার্থীবিষয়ক হাইকমিশনার ফিলিপ্পো গ্রান্ডিকে জানিয়েছেন, ২ লাখ ২৩ হাজার শিশুসহ ১৩ লাখ ইউক্রেনীয়কে জোরপূর্বক রাশিয়ায় পাঠানো হয়েছে।

ইউক্রেন শুধু ইউক্রেন বলেই রুশ প্রেসিডেন্টের কাছে গুরুত্বপূর্ণ নয়, গুরুত্বপূর্ণ এ কারণে যে দেশটি পশ্চিমা বিশ্বের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত হতে চায়। এই পশ্চিমা বিশ্ব মানে, যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বাধীন ইউরোপীয় দেশগুলোর জোট; পুতিনের ভাষায় যা ‘দ্য ইউরো-আটলান্টিক ওয়ার্ল্ড’।

রুশ কর্তৃত্ববাদ ও পশ্চিমা উদারনীতির মধ্যকার দ্বন্দ্বের গুরুত্বপূর্ণ অংশ ইউক্রেন। রুশ সেনাবাহিনী যতক্ষণ না পুরো ইউক্রেন জয় করতে পারছে, পুতিন ততক্ষণ দেশটির ততটুকু ভূখণ্ডই দখলে নিতে চাইবেন, যতটুকু নিজের দখলে রাখতে পারবেন। পাশাপাশি পশ্চিমাদের কাছে বাকি অংশকে (খণ্ডিত ইউক্রেন) যতটা সম্ভব গুরুত্বহীন করে তুলতে চাইবেন।

গত শতকের চল্লিশের দশকের শেষ দিকে জার্মানি নিয়ে একই ধরনের নীতি গ্রহণ করেছিলেন জোসেফ স্তালিন। তিনি পুরো জার্মানির ওপর কমিউনিস্ট নিয়ন্ত্রণ বলবৎ করতে আগ্রহী হয়ে উঠেছিলেন। কিন্তু মার্শাল প্ল্যানের অংশ হিসেবে পশ্চিম জার্মানির অর্থনীতির পুনরুজ্জীবনে নতুন মুদ্রাসহ অন্যান্য পদক্ষেপ নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র স্তালিনকে পরিষ্কারভাবে বুঝিয়ে দেয়, তেমন চেষ্টা প্রতিহত করা হবে। এ পটভূমিতে স্তালিন জার্মানির একাংশের ওপর তাঁর নিয়ন্ত্রণ আরও পোক্ত করেন।

১৯৪৯ থেকে ১৯৯০ সাল—ফেডারেল রিপাবলিক অব জার্মানির মোট ৪১ বছর সময় লাগে পূর্ব জার্মানিকে ফিরে পেতে। তবে তারা তাদের হারানো সিলেসিয়া, পোমেরানিয়া ও পূর্ব প্রুসিয়া ফিরে পায়নি, হয়তো কখনো পাবেও না।

এ দুই ক্ষেত্রেই হারানো ভূখণ্ড তখনই উদ্ধার সম্ভব হয়েছে, যখন সেটির নিয়ন্ত্রণে থাকা শাসকের হাত থেকে ক্ষমতা ফসকে গেছে; অর্থাৎ ইউক্রেন হয়তো কেবল তখনই তার পূর্ব ও দক্ষিণাঞ্চল ফিরে পাবে, যখন পুতিনের কর্তৃত্বের অবসান হবে। যেভাবে ১৯১৮ সালের নভেম্বরে জার্মানির হোয়েনজোলার্ন রাজবংশের পতন হয়েছিল এবং ১৯৮৯ সালের নভেম্বর-ডিসেম্বরে সোভিয়েত-সমর্থিত জিডিআরের শাসকগোষ্ঠী ক্ষমতা হারিয়েছিল।

স্তালিন ও তাঁর উত্তরসূরিদের মতো পুতিনের নীতিও কেবল তখনই মুখ থুবড়ে পড়বে, যখন তাঁকে পরাস্ত করার মতো চূড়ান্ত সামর্থ্য ও নিজেদের মধ্যকার ইস্পাতদৃঢ় ঐক্য তুলে ধরতে পারবে পশ্চিমারা।

নিজেদের পূর্ব ও দক্ষিণাঞ্চল ফিরে পেতে ইউক্রেনীয়দের কেবল দীর্ঘ মেয়াদে লড়াই জারিই রাখতে হবে না, ইউরোপের কাছ থেকে বিপুল পরিমাণে সামরিক ও আর্থিক সহায়তাও পেতে হবে।

এখন পর্যন্ত যতটা করেছে যুক্তরাষ্ট্র, তাতে ধারণা করা চলে, ইউক্রেনকে দেওয়া সহযোগিতার বড় হিস্যা তারা হবে না। এ ক্ষেত্রে ইউরোপীয় রাষ্ট্রগুলোকে একে অপরের সঙ্গে ও ইউক্রেনের সঙ্গে—উভয় ক্ষেত্রেই নজিরবিহীন মাত্রার সংহতির বিষয়টি তুলে ধরতে হবে।

তুরুপের তাস হিসেবে অবশ্যই টেবিলে রাখতে হবে ইউক্রেনের ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) পূর্ণাঙ্গ সদস্যপদ; দেশটিকে শক্তিশালী করার অন্যতমও উপায় এটি। যদিও ইইউ নেতারা এরই মধ্যে বিষয়টির ইঙ্গিতও দিয়েছেন, তবে এর প্রক্রিয়া ধীর বলেই পরিলক্ষিত হচ্ছে।
প্রথমআলো