Home জাতীয় সাফারি পার্কে এত মৃত্যু, দায় কার

সাফারি পার্কে এত মৃত্যু, দায় কার

31

ডেস্ক রিপোর্ট: গাজীপুরের বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব সাফারি পার্কে হঠাৎ করে অসংখ্য বিদেশি প্রাণীর মৃত্যুর ঘটনায় সবার মাঝে হতাশা বিরাজ করছে। পার্ক প্রতিষ্ঠার পর চলতি বছরই সবচেয়ে বেশি প্রাণীর মৃতু্য ঘটেছে। এতে সরকার পার্ক ব্যবস্হাপনায় পরিবর্তন এনেছে। সরিয়ে দেওয়া হয়েছে পার্কের প্রকল্প পরিচালক, ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা ও চিকিত্সককে। তবে সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এর আগে পার্কে বিভিন্ন প্রাণীর মৃত্যু হলেও কর্তৃপক্ষ কার্যকর ব্যবস্থা না নেওয়ায় এবার বড় ধরনের ক্ষতির মুখে পড়তে হলো।

এমন পরিস্হিতিতে রবিবার (৬ ফেব্রুয়ারি) বিকালে সাফারি পার্ক পরিদর্শন করেন পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন বিষয়ক মন্ত্রী মো. শাহাব উদ্দিন। তিনি বলেন, পার্কে প্রাণী মৃতু্যর ঘটনায় কারো দায়িত্বে কোনো অবহেলা বা কেউ জড়িত থাকলে তাদের বিরুদ্ধে দৃষ্টান্তমূলক ব্যবস্হা নেওয়া হবে। কারো ইন্ধনে এ ঘটনা ঘটে থাকলে তা-ও বের করা হবে।
মন্ত্রী আরো বলেন, গত এক মাসের মধ্যে সাফারি পার্কে যে কয়টি প্রাণী মারা গেছে তার জন্য আমরা গভীরভাবে মর্মাহত ও দুঃখিত। ইতিমধ্যে পাঁচ সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। তদন্ত রিপোর্টে যারা জড়িত থাকবে তাদের বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্হা গ্রহণ করা হবে। কাউকে ছাড় দেওয়া হবে না। এসময় মন্ত্রণালয়ের উপমন্ত্রী হাবিবুন নাহার এমপি, স্থানীয় সংসদ সদস্য ইকবাল হোসেন সবুজ, মন্ত্রণালয়ের সচিব মো. মোস্তফা কামাল প্রমুখ উপস্হিত ছিলেন।

৩২ জেব্রার মৃতু্য
২০১৩ ও ২০১৫ সালে দুই ধাপে দক্ষিণ আফ্রিকা থেকে মোট ২৫টি জেব্রা আনা হয় এ পার্কে। ২০১৫ সালেই ১১টি জেব্রার মৃতু্য হয়। পার্কে প্রথম জেব্রা শাবকের জন্ম হয় ২০১৭ সালের ১৪ মে। সেই থেকে ২০২১ সালের ১৮ অক্টোবর পর্যন্ত মোট ২৫টি শাবকের জন্ম হয়।

এর মধ্যে ২০২১ সাল পর্যন্ত বিভিন্ন কারণে জেব্রা মারা যায় ১০টি। চলতি বছরের ২ জানুয়ারি থেকে ২৯ জানুয়ারি পর্যন্ত আরো ১১টি জেব্রার মৃতু্য হয়। সব মিলিয়ে পার্কে ২৫টি জেব্রা শাবকের জন্ম হলেও মারা গেছে ৩২টি।

তিন জিরাফের মৃতু্য
২০১৭ সালের ১৭ মে পার্কে অজ্ঞাত রোগে আক্রান্ত হয়ে দুটি জিরাফের মৃতু্য হয়। তখন পার্ক কর্তৃপক্ষ ময়নাতদন্ত করে বলেছিল ব্যাকটেরিয়া সংক্রমণেই তারা মারা গেছে। ২০১৯ সালের ১৭ জানুয়ারি পার্কের একমাত্র পুরুষ জিরাফটিও মারা যায় চিকিত্সকের ভুল চিকিত্সায়। যদিও জিরাফের যক্ষ্মা রোগের কথা বলেছিলেন তখনকার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা।

মারা গেছে সিংহ-বাঘও
২০২১ সালের ২৪ সেপ্টেম্বর পার্কের একটি সাদা সিংহ মারা যায়। পার্ক কর্তৃপক্ষের দাবি ছিল, গরমে হিটস্ট্রোকে সেটি মারা গেছে। এছাড়া গত বৃহস্পতিবার পার্কে ফের অসুস্হ হয়ে একটি সিংহীর মৃতু্য হয়। এর আগে গত ১২ জানুয়ারি একটি বাঘের মৃতু্য হয় এই পার্কে। চিকিত্সকদের দাবি ছিল, অ্যানথ্রাক্স রোগে আক্রান্ত হয়ে বাঘটির মৃতু্য হয়। এর পূর্বে আরো একটি বাঘের মৃতু্য হয়। তখন পার্ক কর্তৃপক্ষ দাবি করেছিল গলায় গুইশাপ আটকে তার মৃতু্য হয়েছিল। এছাড়া পার্ক প্রতিষ্ঠার পর দর্শনার্থীদের জন্য বেশ কয়েকটি ক্যাঙ্গারু বিদেশ থেকে আনা হলেও ধারাবাহিক ভাবে মৃতু্যর মধ্য দিয়ে তা এখন শূন্যতে পৌঁছেছে।

দায়সারা তদন্ত
পার্ক প্রতিষ্ঠার পর থেকেই একের পর এক প্রাণীর মৃতু্য হলেও দায়সারা তদন্ত করেই ক্ষান্ত ছিল পার্ক কর্তৃপক্ষ। প্রতিটি প্রাণীর মৃতু্যর সঠিক কারণ উদ্ঘাটন ও মৃতু্যরোধে কার্যকর ব্যবস্হা নেওয়ার উদ্যোগের অভাব ছিল তাদের মধ্যে। সদ্য পার্ক থেকে প্রত্যাহার করে নেওয়া ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা তবিবুর রহমান বলেন, তার মেয়াদে এই প্রথম বড় ধরনের প্রাণীর মৃতু্য হয়েছে চলতি বছরের জানুয়ারি মাসে। নিয়ম অনুযায়ী এসব মৃতু্যর ময়নাতদন্ত করা হয়। এ সংক্রান্ত রিপোর্ট পাঠিয়ে দেওয়া হয় সংশ্লিষ্ট বিভাগে। সেখানেই পরবর্তী ব্যবস্হা নেওয়ার কথা।

প্রাণী ব্যবস্হাপনায় অনিয়মের অভিযোগ
এদিকে সাফারি পার্ক সংশ্লিষ্ট নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক কর্মকর্তা জানান, এই পার্কে বিদেশি প্রাণী ব্যবস্হাপনায় চরম অনিয়ম রয়েছে। জেব্রা যেখানে বসবাস করে সেখানে রয়েছে বিশাল শালবন। সেখানে জেব্রার খাবারের অনুপযোগী উদ্ভিদ ও লতাপাতা রয়েছে। রয়েছে বদ্ধ নালা। সেখানে জমে থাকা পানি রয়েছে। জেব্রার বসবাসের জন্য অনেকটা অনুপযুক্ত এই এলাকা।

এই কর্মকর্তার ধারণা, খাবার থেকেই এবার জেব্রা ব্যাকটেরিয়ায় আক্রান্ত হয়েছে। এছাড়া জেব্রার সঙ্গেই বিচরণ রয়েছে জিরাফ, ওয়াইল্ড বিস্ট ও কমন ইল্যান্ড। সঙ্গে রয়েছে শত শত বানর। পার্কের খাবার পরিবেশন করেন বিভিন্ন ঠিকাদাররা। এসব খাবার পরীক্ষা- নিরীক্ষারও কোনো ভালো ব্যবস্হা নেই। এছাড়াও বিদেশি প্রাণীর বিষয়ে তেমন অভিজ্ঞতা নেই পার্কের অনেকেরই। এ বিষয়ে প্রশিক্ষণের জন্য আমাদের দেশেও তেমন ব্যবস্হা এখনো গড়ে ওঠেনি। তাই বিদেশি প্রাণী ব্যবস্হাপনায় নজর না দিলে ভবিষ্যতে আরো বড় ধরনের বিপর্যয় হতে পারে।

বিশেষজ্ঞরা যা বলেন
এ বিষয়ে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক মঞ্জুরুল কিবরিয়া বলেন, ‘দেশীয় ও বিদেশি প্রাণী ব্যবস্হাপনায় বিস্তর ফারাক রয়েছে। তাই বিদেশি প্রাণীর দিকে বিশেষ নজর দেওয়া প্রয়োজন। প্রতিটি বিদেশি প্রাণীর ব্যবস্হাপনা ও রোগ সম্পর্কে ধারণা রাখতে হবে। সঙ্গে তাদের উপযোগী বাসস্হান, বিচরণ ভূমি, খাবার ও রোগ অনুযায়ী চিকিত্সা নিশ্চিত করতে হবে। রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্হা গড়ে তুলতে টিকার আওতায় আনতে হবে এসব প্রাণীদের। কোনো মতেই অবহেলা করা যাবে না। একটি প্রাণীর মৃতু্যর পর দ্রুত এর কারণ উদ্ঘাটন করে পরবর্তী প্রাণীর মৃতু্যরোধের উদ্যোগ নিতে হবে।’

জাতীয় চিড়িয়াখানার সাবেক কিউরেটর ড. এ বি এম শহিদুল্লাহ বলেন, ‘কয়েক দিনের ব্যবধানে যেভাবে প্রাণীগুলোর মৃতু্য হয়েছে তা সত্যিই হতাশাজনক। প্রাথমিক অবস্হায় আমরা ব্যাকটেরিয়া সংক্রমণকে দায়ী করছি। এছাড়া আরো বেশ কিছু গবেষণাগারের ফলাফল এখনো পাইনি। সবমিলিয়ে তদন্ত হচ্ছে। তিনি বলেন, জেব্রার মৃতু্যরোধে বিশেষজ্ঞদের নিয়ে গঠিত প্যানেল ১০ দফা নির্দেশনা দিয়েছে। তদন্েতর পর আমরা আরো পর্যবেক্ষণ দেব।’

সাফারি পার্কের নতুন দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রকল্প পরিচালক মোল্লা রেজাউল করিম বলেন, ‘এটি দক্ষিণ এশিয়ার অন্যতম বৃহত্তম একটি সাফারি পার্ক। এখানে বিদেশি নানা ধরনের বন্যপ্রাণী রয়েছে। আমাদের এখানে অনেকেই রয়েছেন বিদেশি বন্যপ্রাণীর ব্যবস্হাপনা সম্পর্কে তেমন কোনো অভিজ্ঞতা নেই। এ বিষয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্হা গ্রহণের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।’-ইত্তেফাক