Home মতামত সমাজ তথা দেশের জন্যেও ভাবতে হবে।

সমাজ তথা দেশের জন্যেও ভাবতে হবে।

39

সরদার মোঃ শাহীন:
“প্রত্যেকে আমরা পরের তরে”কথাটার মর্মার্থ শেখার সুযোগ হয়েছিল আমাদের ছেলেবেলায়। ছন্দের তালে তালে শিখেছিলাম। যদিও ভাবার্থ এতটুকুনও বুঝিনি তখন। ছেলেবেলার প্রথম পাঠ বাল্যশিক্ষা বইটিতে কবি কামিনী রায়ের লেখা এই কবিতাটি অর্ন্তভুক্ত ছিল। শিশুদের মনে স্থায়ী ভাবে গেঁথে দেবার কি চমৎকার উদ্যোগ! কী কঠিন জীবনবোধের পরামর্শ। যেন বড় হয়ে বিষয়টির গুরুত্ব অনুধাবন করে প্রত্যেকেই নিজ নিজ সামাজিক জীবনে এর অনুশীলনও করতে পারে।
যদিও আমাদের দেশে এর অনুশীলনের ছিটেফোঁটাও নেই। থাকলেও উল্লেখ করার মত নয়। অথচ গভীর অনুশীলনের মাধ্যমে বিষয়টি অন্তরে লালন করতে দেখেছি জাপানীজদের সামাজিক জীবনে।
সবে মাত্র জাপান গিয়েছি। ওদেরকে, ওদের সমাজকে বোঝবো তো ভালো; বোঝাটা শুরুও করিনি তখনও। ভাষাটা শেখা শুরু করেছি কেবল। জটিল ভাষা। ভেঙে ভেঙেও বলতে পারি না। রপ্ত করার তো প্রশ্নই ওঠে না। সুপারভাইজিং প্রফেসরের সাথে কথাবার্তা যা হবার ইংরেজিতেই হতো।
তবে তিনি চাইতেন ভাষাটা যেন অতি তাড়াতাড়ি শিখে ফেলি। শেখার জন্যে তাঁর সাথেও বসতাম। সপ্তাহে অন্তত দু’দিন বসা হতো। কথা হতো। গবেষণার বাইরে যতটুকু কথা হতো, পুরোটাই জাপান নিয়ে। জাপানীজদের নিয়ে। জাপানের সামাজিক জীবন ব্যবস্থা নিয়েও কথা হতো। তিনি চাইতেন যেন আমি জাপানীজদের সাথে মিশি। জাপানকে ভাল করে চেনা জানার জন্যে এর বিকল্প নেই।
তিনি বলতেন, “যদি এদেশে স্থায়ীভাবে বাস করতে চাও, ক্যারিয়ার গড়তে চাও; তাহলে প্রথমত জাপানীজদের মনটাকে পড়তে শেখো। বুঝতে শেখো। দেশটাকে আগে ভাল করে জানা দরকার। বিশেষ করে জানতে হবে জাপানী সমাজ ব্যবস্থাকে। জাপানীজ সোসাইটি যদি তুমি না বোঝ, জাপানীজদের ঐতিহ্য এবং রীতিনীতি যদি শিখতে না পারো, তাহলে এদেশে তুমি টিকবে না। ভাল ক্যারিয়ার গড়তে পারবে না।”
একদিন তিনি বিশেষ একটি ছুটির দিনের কথা বললেন। জুলাইয়ের ৩য় রোববার। সমুদ্র দিবস; জাতীয় ছুটির দিন। প্রতি বছর দিবসটি পালিত হয় পুরো জাপান জুড়ে। জানতে চাইলাম সমুদ্র দিবস নিয়ে। তিনি খুব সুন্দর করে বললেন। বললেন, “দিনটিকে সমুদ্র দিবস বলা হয় সমুদ্রকে বছরে একটা দিন জাতীয় ভাবে ঘটা করে ধন্যবাদ দেবার জন্যে। সমুদ্রের দানশীলতায় আমরা জাপানী জনগণ খেয়ে-পড়ে বেঁচে আছি। সমুদ্র উদারভাবে ফলন দেয় বলেই আমরা বছরব্যাপী আমাদের প্রয়োজনীয় খাবার এখান থেকে সংগ্রহ করতে পারি। দিবসটি হলো সমুদ্রের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানানোর দিবস।”
কী চমৎকার ভাবনা! রাষ্ট্রীয় ভাবনা। রাষ্ট্রীয়ভাবে কৃতজ্ঞতা প্রকাশের ভাবনা। এবার তিনি ভাবনার ভেতরে গেলেন। অর্থাৎ বিশদ আলোচনায় গেলেন। বলা যায় অনেকটা একাডেমিক আলোচনা। প্রথমেই বললেন, জাপানীরা বদ্ধ পানির মাছ, মানে পুকুর বা ছোটখাটো জলাশয়ের কোন মাছই খায় না। এমনকি নদীর মাছও না। বদ্ধ পানির মাছ আশেপাশে থাকা গাছগাছালির পোকামাকর খায়। গাছের পোকা মরে বাতাসে উড়ে জলাশয়ের পানিতেই পড়ে। এছাড়াও শরীরের জন্যে ভাল নয় এমন নানা কিছুও খায়। তাই সুস্থ্য থাকার জন্যে জাপানীরা এসব খাবার ভুলেও খায় না।
আমরা বাংলাদেশীরা খাই। পুকুর তো ভাল, ময়লা ড্রেনের মাছও আমরা খাই। কোনটাই ছাড়ি না। আমরা একদিকে যেমনি সমুদ্রের মাছ খাই, অন্যদিকে নদীরও। নদীর মাছ আমাদের সবচেয়ে প্রিয়। সবচেয়ে স্বাদের। ইলিশ হলে তো কথাই নেই। সাথে আছে বাঘাআইড়, কাতল, বোয়াল আর রুই। অন্যদিকে কই, টাকি কিংবা শৌল; জিয়াল প্রজাতির মাছ। ভীষণ প্রিয়। বিল, জলাশয় কিংবা পুকুর আর ডোবার মাছ। পঁচা না হলেই হলো। কোন বাছবিচার নেই। গোগ্রাসে সব গিলি।
ভাবখানা এমন যে, মাছ যত কম পানির হবে, কিংবা কর্দমাক্ত পানির হবে, ততই যেন মজা। দুঃখজনক হলো, পঁচা পানির ড্রেন কিংবা বিষ্টামাখা পানির মাছও আমরা খাই। কেউ কেউ জেনে খাই, আবার অনেকে না জেনেও খাই। কিছু মানুষ আছে যারা অবলীলায় ওসব বাজে জায়গা থেকে মাছ ধরে এনে বাজারজাত করে। দুর্ভাগ্যজনক হলো, এসব বোঝার যেমনি কেউ নেই দেশে, তেমনি দেখারও কেউ নেই। তাই বুঝেশুনে বাছবিচার করে খাবার সুযোগও নেই আমাদের দেশে।
জাপানে সব আছে। ওরা নিশ্চিন্তে বুঝেশুনেই সব খেতে পারে। শরীরের জন্যে কোনটা ভালো আর কোনটা খারাপ তা বুঝেশুনেই খায়। ভালো এবং স্বাস্থ্যসম্মত বলে সারা বছর ওরা সমুদ্রের মাছই খায়। সমুদ্রবেষ্টিত দ্বীপরাষ্ট্র জাপানের সমুদ্রে মাছের অভাব নেই। লবনাক্ত জলের স্তরে স্তরে হাজারো লক্ষ পদের মাছ। জাল ফেললেই মাছ। বড়শি ফেললেই মাছের কাড়ি। রাশিরাশি মাছের ঝাঁক বয়ে বেড়ায় সমুদ্র জুড়ে।
অথচ সেই সমুদ্রেই ওরা মাছের পোনা ছাড়ে। কোটি কোটি পোনা ছাড়ে। বছরে একদিন ঘটা করে সমুদ্র দিবস উদযাপনের নামে দলবেঁধে পোনা ছাড়ে। লক্ষ কোটি পোনা। সবাই নিজের গাটের টাকায় পোনা কিনে এনে সমুদ্রে ছেড়ে দেয়। দিবসের শুরু করে সন্ধ্যা অবধি ছাড়ে। যে যত পারে ছাড়ে। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থী আর শিক্ষকগণ, এনজিও কর্মী, স্বেচ্ছাসেবীর দল, কেউ বাদ থাকে না।
সবাই দলবেঁধে স্বতস্ফূর্তভাবে এসব করার একটাই কারণ সমুদ্রে যেন মাছের কমতি না হয় কখনো। ১২ কোটি জাপানীদের জন্যে জেলেদের দল প্রতিদিন লক্ষ লক্ষ মাছ আহরণ করে। এভাবে বছরভর করে। যে সমুদ্র থেকে প্রতিদিন এত এত মাছ আহরিত হয়, সেই সমুদ্রে যদি অন্তত একটি দিন মাছ ছাড়া না হয়, তাহলে কি হয়? মাছ চাষ না করলে সমুদ্রে ধরার মত এত্ত এত্ত মাছ কোথায় পাবে ওরা!
পাবে না বলেই কাজটি ওরা হিসেব কষেই করে। একদিন মাছের পোনা ছাড়ে আর খায় বছর ধরে। এমনভাবে ছাড়ে যেন জেলেদের দল মাছ ধরতে যেয়ে কোনদিন খালি হাতে না ফেরে। তাই মোটামুটিভাবে সারাবছর যা খায়, চেষ্টা করে একদিনে তা ছেড়ে আসতে। এটা প্রতিকী অর্থেই করে। সামাজিক দায়িত্ববোধ থেকেই করে। ওরা খুব ভালো করেই বিশ্বাস করে, ভবিষ্যত প্রজন্মের জন্যে একটি সুন্দর পৃথিবী বর্তমান প্রজন্মকেই রেখে যেতে হবে। রেখে যেতে হবে একটি ভারসাম্যময় সুন্দর পৃথিবী। এমন কিছু করা যাবে না যাতে করে প্রকৃতি ভারসাম্যহীন হয়ে পড়ে।
সমুদ্র দিবস উদযাপন করা তেমনই একটি রাষ্ট্রীয় উদ্যোগ। সমুদ্র দিবস নিয়ে সেদিনের আলাপচারিতা বেশ উপভোগ্য ছিল। আলাপচারিতার শেষে প্রফেসর ইয়ামাশিরো বললেন, “জাপানকে টেকসই করতে হবে। এবং এই কাজে আমরা বর্তমান প্রজন্ম যদি ভূমিকা না রাখি, তাহলে আজকের জাপানকে ধরে রাখা যাবে না। সমুদ্রভর্তি মাছ। আমরা না ছাড়লেও এই প্রজন্মের মাছের অভাব হবে না। কিন্তু পরবর্তী প্রজন্মের হয়ত হবে? ওরা তো মাছ নাও পেতে পারে! তাই বর্তমানে খাচ্ছি আমরা, কিন্তু ছেড়ে যাচ্ছি ভবিষ্যত প্রজন্মের জন্যে।”
তিনি আরো বললেন, “আমরা ইনভেষ্ট বা বিনিয়োগ করছি প্রকৃতিতে। ভবিষ্যতের জন্যে করছি। এবং খুবই নিশ্চিন্তে করছি। একমাত্র প্রকৃতিই হলো নিশ্চিন্ত মনে বিনিয়োগের জায়গা। যেখান থেকে লাভসহ রিটার্নের সম্ভাবনা শতভাগ। বিনিয়োগের এমন সম্ভাবনাময় জায়গা আর কোথায়ও নেই। তুমি ব্যবসায় বিনিয়োগ করবে? করতে পারো। কিন্তু রিটার্নের শতভাগ গ্যারান্টি নেই। তুমি পরিচিত কারো কাছে বিনিয়োগ করবে? এখানেও রিটার্নের শতভাগ সম্ভাবনা নেই। একমাত্র প্রকৃতিই হলো সেই জায়গা। মানুষ বেইমানী করে; কিন্তু প্রকৃতি কখনোই বেইমানী করে না।”
আমি মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে স্যারের কথাগুলো শুনছিলাম। কথা নয়, যেন সামজিক শিক্ষার একটি কঠিন পাঠ রপ্ত করছিলাম। সমাজের জীব হয়ে এই সমাজের প্রতি যে কত দায়িত্ব আমাদের তা প্রফেসর ইয়ামাশিরো আমাকে চোখে আঙুল দিয়ে বুঝিয়ে দিলেন।
এই পৃথিবীতে জন্মেছি কেবল নিজের জন্যে নয়। সমাজের প্রতি বিশাল দায়িত্ব এবং দায়বদ্ধতা নিয়েই জন্মেছি। যে সমাজে আমার জন্ম, সেই সমাজের প্রতি আমি উদাসীন থাকতে পারি না। সুন্দর সমাজ গঠনে আমার সার্বিক সহযোগীতা এবং উল্লেখ করার মত অবদান থাকতে হবে। কেবল নিজের এবং নিজ পরিবারের জন্যেই ভাবলে হবে না, সমাজ তথা দেশের জন্যেও ভাবতে হবে।

-লেখক: উপদেষ্টা সম্পাদক, যুগবার্তা ডট কম।