Home মতামত সভ্যতা পাল্টে দেয়া জীববিজ্ঞানী চার্লস ডারউইনের ১৪১তম জন্মবার্ষিকী আজ

সভ্যতা পাল্টে দেয়া জীববিজ্ঞানী চার্লস ডারউইনের ১৪১তম জন্মবার্ষিকী আজ

28

সৈয়দ আমিরুজ্জামান |

সভ্যতা পাল্টে দেয়া জীববিজ্ঞানী ও বিবর্তনবাদের প্রবক্তা চার্লস ডারউইনের ১৪১তম মৃত্যুবার্ষিকী আজ।
চার্লস ডারউইনই প্রথম প্রত্যক্ষ পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে বিবর্তনবাদের ধারণা দেন। তিনি অনুধাবন করেন যে সকল প্রকার প্রজাতিই কিছু সাধারণ পূর্বপুরুষ হতে উদ্ভূত হয়েছে এবং তার এ পর্যবেক্ষণটি সাক্ষ্য-প্রমাণ দিয়ে প্রতিষ্ঠা করেন। বিবর্তনের এই নানান শাখা-প্রশাখায় ভাগ হবার বিন্যাসকে তিনি প্রাকৃতিক নির্বাচন হিসাবে অভিহিত করেন। তার জীবদ্দশাতেই বিবর্তনবাদ একটি তত্ত্ব হিসাবে বিজ্ঞানী সমাজ ও অধিকাংশ সাধারণ মানুষের কাছে স্বীকৃতি লাভ করে। তবে ১৯৩০ থেকে ১৯৫০-এর মধ্যে বিকশিত আধুনিক বিবর্তনিক সংশ্লেষের মাধ্যমে বিবর্তন প্রক্রিয়ায় প্রাকৃতিক নির্বাচনের গুরুত্ব পূর্ণরূপে অনুধাবন করা সম্ভব হয়। পরিবর্তিত রূপে ডারউইনের বৈজ্ঞানিক আবিষ্কার ছিল জীববিজ্ঞানের একত্রীকরণ তত্ত্ব, যা জীববৈচিত্রের ব্যাখ্যা প্রদান করে।
চার্লস রবার্ট ডারউইন তাঁর পরিবারিক বাড়ি, দ্য মাউন্টে ১৮০৯ সালের ১২ ফেব্রুয়ারি ইংল্যান্ডের এক ধনী ও প্রভাবশালী পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন।

বিবর্তন নিয়ে কুতর্কের হোক অবসান। শুরুটা করেছিল ‘দ্যা হরনেট’ ম্যাগাজিন। ১৮৭১ সালে। তারা একটি ওরাং ওটাং এর মুখের স্থানে ডারউইনের মুখ বসিয়ে কার্টুন ছেপে দিলো। অার তখন থেকেই বিবর্তন নিয়ে হাসাহাসি শুরু। পশ্চাদপদ কিছু মানুষ মনে করে বিবর্তন মানেই হলো বানর থেকে মানুষ হয়ে যাওয়া। তারা অনেকেই ভাবে অন্য কোন প্রাণীর কোন বিবর্তন হয়নি, শুধুমাত্র বানর যে মানুষ হয়েছে এটাই বিবর্তন। এই অল্পবিদ্যার মানুষগুলো বিবর্তনকে ‘বানর থেকে মানুষ’ হওয়া বলে ঠাট্টা করতে লাগলো।
তারা আসলে কী ভাবে? তারা কি মনে করে দুটো বানর রাতে গভীর ঘুমে ছিলো। সকালে উঠে দেখলো তাদের লেজ খসে পড়েছে, তাদের গায়ের লোম সব ঝরে গেছে। তাদের পা লম্বা হয়ে গেছে। তারা দুই পায়ে হাটা শিখে গেছে। শুধু তাই নয় তারা মাংস খাওয়াও শিখে গেছে। তাদের মন মানসিকতার পরিবর্তন ঘটে গেছে। তাদের আর এ গাছে ও গাছে লাফাতে, ভেংচি কাটতে ভালো লাগছেনা! তারা কথা বলা শিখে গেছে! তারা আগুন জ্বালানো শিখে গেছে! তারা রান্না করা শিখে গেছে! আর এ সবই ঘটে গেছে এক রাতের ভেতর!
বিবর্তনবাদ বলতে এমনটাই মনে করে তারা। আপনি যদি ন্যুনতম যুক্তিবোধ সম্পন্ন মানুষ হন তাহলে হয়তো এসব শুনে আপনার হাসি আসবে। কিন্তু তারা এমন সব অলৌকিক ঘটনায় বিশ্বাস করে অভ্যস্ত। তাই তাদের দ্বারা এমনটা ভাবা খুবই সম্ভব। তাই তাচ্ছিল্যের হাসি হেসে তারা মাঝে মাঝেই বলে “এখনকার বানরগুলো মানুষ কেন হচ্ছেনা? কোনদিন তো দেখলাম না কোন বানরকে মানুষ হতে।” অকাট্য যুক্তি বটে। এখনকার বানরগুলো রাতে ঘুমিয়ে সকালে উঠে কেনো তারা মানুষ হয়ে যাচ্ছেনা? এখনকার মুরগীগুলো কেন হাতি হচ্ছেনা? এখনকার টিকটিকিগুলো কেন তিমি মাছ হচ্ছেনা? কিংবা ছাগলগুলো কেন তেলাপোকা হচ্ছেনা? তার মানে বিবর্তনবাদ মিথ্যা।
কিন্তু বিবর্তন তত্ত্ব এগুলোর কিছুই দাবি করে না। বিবর্তন কোটি বছরের ফসল, হাজার বছরের না। বিবর্তন তত্ত্ব ছাড়া পৃথিবীর জীববিজ্ঞানের ধারা অচল এটা তারা জানেই না। বিবর্তন শুধুই একটি থিওরি বা তত্ত্ব নয়। এটি পর্যবেক্ষণযোগ্য প্রাকৃতিক ঘটনা। বিবর্তন বলতে জীবজগতের উন্নতি বোঝায় না; বিবর্তন হচ্ছে পরিবর্তন, সাধারণ পরিবর্তন নয়, ডারউইনের ভাষ্যমতে এটি “পরিবর্তন সংবলিত উদ্ভব”। এই পরিবর্তন ইতিবাচক, নেতিবাচক কিংবা নিরপেক্ষ হতে পারে। এটি নির্ভর করে পারিপার্শ্বিক অবস্থা বা পরিবেশের উপর।
বিবর্তনের কোন সুনির্দিষ্ট্য লক্ষ্য নেই। ‘বিপরীতমুখীন’ কিংবা ‘পশ্চাৎ বিবর্তন’ (Backward Evolution অথবা De-evolution) বলেও কোন জিনিস নেই; একইভাবে নেই ‘সম্মুখ বিবর্তন’-এর মত কোন জিনিসও। অর্থাৎ বিবর্তন কোন নির্দিষ্ট দিকে চালিত হয় না। বিবর্তন কোন তাৎক্ষণিক প্রক্রিয়া নয়। বিবর্তন নিরবচ্ছিন্নভাবে চলমান প্রক্রিয়া। এটি একটি অত্যন্ত ধীর প্রক্রিয়া। একটি দৃশ্যমান বা চোখে পড়ার মত বড় ধরনের পরিবর্তনের জন্য সাধারণত লক্ষ লক্ষ বছর লেগে যায়। একটি উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন সাধিত হওয়ার জন্য একটি জীবগোষ্ঠীকে হাজার হাজার অন্তর্বতী অবস্থা (Transitional Forms) পার করতে হয়।
বিবর্তনের পক্ষে সাক্ষ্যপ্রমাণ অফুরন্ত বলে মনে করা হয়। বিবর্তন বা জৈব অভিব্যক্তির পক্ষে যে সমস্ত সাক্ষ্য হাজির করা যায় তা হলো:- প্রাণ রাসায়নিক প্রমাণ, কোষবিদ্যা বিষয়ক প্রমাণ, শরীরবৃত্তীয় প্রমাণ, জীবাশ্ম বা ফসিলের প্রমাণ, সংযোগকারী জীবের (Connecting Link) প্রমাণ, ভৌগোলিক বিস্তারের (Geographical Distribution) প্রমাণ, তুলনামূলক অঙ্গসংস্থানের প্রমাণ, শ্রেনীকরণ সংক্রান্ত প্রমাণ, নিষ্ক্রিয় বা বিলুপ্তপ্রায় অঙ্গের প্রমাণ ইত্যাদি। এছাড়াও ১৯৫০ সালের পর থেকে বিবর্তনের সপক্ষে সবচেয়ে জোরালো এবং গুরুত্বপূর্ণ প্রমাণ পাওয়া গেছে ‘আণবিক জীববিদ্যা’ (Molecular Biology) এবং সাইটোজেনেটিক্স (Cytogenetics) থেকে। আধুনিক জীববিজ্ঞান, প্রত্নতত্ত্ববিজ্ঞান, জেনেটিক্স, জিনোমিক্স এবং আণবিক জীববিদ্যার সকল শাখাতেই বিবর্তনের পক্ষে জোরালো প্রমাণ পাওয়া গেছে।
বিবিসি সংবাদ মাধ্যমে জানা যায় ডারউইনের জন্মের ১০০০ বছর আগে বিবর্তনবাদের তত্ত্ব দিয়েছিলেন একজন মুসলিম দার্শনিক।
চার্লস ডারউইনের জন্মের প্রায় এক হাজার বছর আগে ইরাকে একজন মুসলিম দার্শনিক জন্মেছিলেন যিনি প্রাকৃতিক নিয়মে প্রাণীকুলের মধ্যে কী ধরনের পরিবর্তন ঘটে তার উপর একটি বই লিখেছিলেন। এই দার্শনিকের নাম ছিল আল-জাহিজ। যে পদ্ধতিতে এই পরিবর্তন ঘটে তিনি তার নাম দিয়েছিলেন প্রাকৃতিক নির্বাচন।
তিনি বিখ্যাত হয়ে আছেন তারই লেখা প্রজনন সংক্রান্ত একটি বই-এর কারণে। গ্রন্থটির নাম ‘কিতাব আল-হায়ওয়ান’ অর্থাৎ প্রাণীদের বিষয়ে বই। তার জন্ম হয়েছিল ৭৭৬ সালে, দক্ষিণ ইরাকের বসরা শহরে, মুতাজিলাহ আন্দোলনের সময়। এসময় ধর্মতাত্ত্বিক কিছু মতবাদ জনপ্রিয় হচ্ছিল যেখানে মানুষের যুক্তির চর্চার উপর জোর দেওয়া হচ্ছিল। তখন ছিল আব্বাসীয় খেলাফত বা শাসনের চরম সময়। সেসময় জ্ঞান বিজ্ঞানের অনেক বই গ্রীক ভাষা থেকে আরবি ভাষায় অনুবাদ করা হতো। জোরালো বিতর্ক হতো ধর্ম, বিজ্ঞান এবং দর্শন বিষয়ে। এসবের কেন্দ্র ছিল বসরা শহর। এসব আলোচনা থেকেই ধীরে ধীরে গড়ে উঠছিল আল-জাহিজের চিন্তাধারা। আল-জাহিজ তার বইতে লিখেছেন, “টিকে থাকার জন্যে প্রাণীদেরকে লড়াই করতে হয়। লড়াই করতে হয় তাদের খাদ্যের জন্যেও এবং তারা নিজেরাই যাতে অপরের খাদ্য না হয়ে যায় সেটা নিশ্চিত করার জন্যে। এমনকি, প্রজননের জন্যেও তাদেরকে সংগ্রাম করতে হয়।”
“নিজেদের বেঁচে থাকা নিশ্চিত করতে গিয়ে পরিবেশের নানা কারণে প্রাণীরা নতুন নতুন বৈশিষ্ট্য ধারণ করে এবং এভাবেই তারা নতুন নতুন প্রজাতিতে রূপান্তরিত হয়।”
ডারউইনের বিবর্তনবাদের সাথে মিলে যায় আল জাহিজের তত্ত্ব। বিবর্তনতত্ত্ব আর সৃষ্টিতত্ত্ব সর্বদাই সাংঘর্ষিক।
১৮৮২ সালের ১৯ এপ্রিল সন্ধ্যায় ইংল্যান্ডে ৭৩ বছর বয়সে মৃত্যুবরণ করেন তিনি। সভ্যতা পাল্টে দেয়া জীববিজ্ঞানী চার্লস ডারউইনের মৃত্যুবার্ষিকীতে বিনম্র শ্রদ্ধা ও অভিবাদন!

-লেখক: মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক গবেষক, সাংবাদিক ও কলামিস্ট।