Home কুটনৈতিক ও প্রবাস সন্তানদের পেতে আইনি লড়াই এবার পারিবারিক আদালতে

সন্তানদের পেতে আইনি লড়াই এবার পারিবারিক আদালতে

57

ডেস্ক রিপোর্ট: সন্তান থাকবে কার কাছে! বাবা না মা। এ নিয়ে চলছে আইনি লড়াই। সহসাই এ লড়াই শেষ হওয়ার নয়। দেশের সর্বোচ্চ আদালতে এক ধাপ আইনি লড়াই শেষে এখন দুই শিশু সন্তান কার জিম্মায় থাকবে তার শুনানি হবে ঢাকার পারিবারিক আদালতে। ওই মামলাটি নিষ্পত্তির জন্য সহকারী জজ দ্বিতীয় অতিরিক্ত পারিবারিক আদালতকে সময় বেঁধে দিয়েছে সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ।

আদালত বলেছে, পূর্ণাঙ্গ রায়ের সত্যায়িত অনুলিপি পাওয়ার তিন মাসের মধ্যে মামলাটি নিষ্পত্তি করতে হবে। ইতোমধ্যে বেরিয়েছে আপিল বিভাগের পূর্ণাঙ্গ রায়। সেই রায়ে বলা হয়েছে, পারিবারিক আদালতের মামলা নিষ্পত্তি না হওয়া পর্যন্ত দুই শিশু সন্তান থাকবে তাদের মা ডা. এরিকো নাকানোর কাছে। তবে বাবা ইমরান শরীফ সন্তানদের সঙ্গে সাক্ষাত করতে পারবেন সে কথাও রায়ে বলা হয়েছে।

আইন বিশেষজ্ঞরা বলছেন, পারিবারিক আদালতের রায় এলে জানা যাবে সন্তান কার জিম্মায় থাকবে। তবে কোর্ট বাবা বা মা যার পক্ষেই সিদ্ধান্ত দিক না কেন তাতে সংক্ষুব্ধ পক্ষ আপিলে যাবেন। সেই আপিল জজ আদালত থেকে হাইকোর্ট এবং সর্বশেষ আপিল বিভাগে গড়াবে। তাই সহসাই এই আইনি লড়াই শেষ হবে না।

তবে তারা বলছেন, সন্তানদের সর্বোত্তম স্বার্থের কথা বিবেচনা করেই বাবা-মায়ের উচিত সঠিক সিদ্ধান্তে আসা।

এরিকো নাকানো জাপানের নাগরিক। পেশায় অনকোলজি বিষয়ক চিকিৎসক। বাংলাদেশি বংশোদ্ভুত মার্কিন নাগরিক ইমরান শরীফ একজন প্রকৌশলী। ২০০৮ সালের ১১ জুলাই তারা বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। দুজনের ধর্মীয় রীতি অনুযায়ী বিয়ের আনুষ্ঠানিকতা সম্পন্ন হয়। বসবাস করতেন টোকিওতে। এক যুগের দাম্পত্য জীবনে তাদের তিন সন্তান। এদের বয়স যথাক্রমে ১১, ৯ ও ৭ বছর। দু’জনের মধ্যে বনিবনা না হওয়ায় গত বছর বিবাহ বিচ্ছেদের আবেদন করেন এরিকো। তবে সেই বিচ্ছেদ এখনো হয়নি।

ওই বছরের ২১ জানুয়ারি স্কুল থেকে ফেরার পথে বড় দুই শিশু সন্তানকে ভাড়া বাসায় নিয়ে যান ইমরান শরীফ। ২৮ জানুয়ারি এরিকো টোকিওর পারিবারিক আদালতে ওই দুই সন্তানকে নিজের জিম্মায় নিতে মামলা করেন। ওই বছরের ৯ ফেব্রুয়ারি ইমরান মেয়েদের জন্য নতুন পাসপোর্টের আবেদন করেন। ১৭ ফেব্রুয়ারি নতুন পাসপোর্ট গ্রহণ করার পর ২১ ফেব্রুয়ারি দুই মেয়েকে নিয়ে দুবাই হয়ে বাংলাদেশে চলে আসেন তিনি।

তবে গত ৩১ মে টোকিওর পারিবারিক আদালত ইমরানের শরীফের জিম্মায় থাকা দুই সন্তানকে এরিকোর জিম্মায় দেওয়ার নির্দেশ দেয়। কিন্তু দুই সন্তানকে নিয়ে বাংলাদেশে চলে আসায় টোকিও আদালতের সেই আদেশ আর বাস্তবায়িত হয়নি।

২১ জুলাই বাংলাদেশে আসেন ডা. এরিকো। দুই সন্তানকে উদ্ধারে হাইকোর্টে হেবিয়াস কর্পাস রিট করেন তিনি। ওই রিট বিচারাধীন থাকাবস্থায় বাবা ও মাকে সমঝোতায় আসতে একাধিকবার সময় দেয় আদালত। কিন্তু এরিকো ও ইমরান সমঝোতায় পৌঁছাতে ব্যর্থ হন।

এরপরই শুনানি শেষে গত ২১ নভেম্বর রিটের রায়ে হাইকোর্ট দুই শিশু সন্তানকে ইমরান শরীফের কাছে রাখার আদেশ দেয়। তবে প্রতিবছর তিনবার করে (প্রতিবারে দশদিন) সন্তানদের সঙ্গে বাংলাদেশে এসে একান্তে সময় কাটানোর সুযোগ দেওয়া হয় ডা. নাকানোকে। এ ক্ষেত্রে বছরে তিনবার বাংলাদেশে যাওয়া আসাসহ দশদিন অবস্থানের যাবতীয় খরচ শরীফ ইমরানকে বহনের নির্দেশ দেয় আদালত। এর বাইরে যাওয়া আসার খরচ ওই জাপানি নারী বহন করবেন। এছাড়া মাসে অন্তত দুইবার শিশুদের সঙ্গে ভিডিও কলে মাকে কথা বলিয়ে দেওয়ার কথা রায়ে বলা হয়।

এই রায়ের বিরুদ্ধে আপিল বিভাগে যান এরিকো। দীর্ঘ শুনানি শেষে আপিল বিভাগ তার রায়ে বলে, দুই শিশুকে জাপান থেকে বাংলাদেশে এনে ইমরান শরীফ যে তার জিম্মায় রেখেছিলেন তা বেআইনি ও আইনগত কর্তৃত্ববহিভূত। সন্তানদের নিজ হেফাজতে রাখার লক্ষ্যে ঢাকার পারিবারিক আদালতে করা মামলাটি নিষ্পত্তি না হওয়া পর্যন্ত সন্তানরা মায়ের কাছে থাকবে। তবে আদালতের অনুমতি ছাড়া তারা বাংলাদেশ ত্যাগ করতে পারবেন না।

এছাড়া সন্তানদের সঙ্গে বাবা সাক্ষাত করতে পারবেন। তবে সেটা হতে হবে আলোচনা সাপেক্ষে নির্ধারিত সময় ও স্থানে।

গত ১৩ ফেব্রুয়ারি দেওয়া ওই রায়ের পর থেকেই সন্তানরা বারিধারার একটি বাসায় মায়ের সঙ্গে অবস্থান করছেন। গত ১২ এপ্রিল এই রায়ের পূর্ণাঙ্গ অনুলিপি প্রকাশ পায়। রায়টি এখন ঢাকার পারিবারিক আদালতে যাবে। চলতি মাসের শেষ সপ্তাহে মামলাটি শুনানির জন্য রয়েছে বলে জানান ইমরান শরীফ।

ছোট মেয়ের সাক্ষাত পাচ্ছেন না ইমরান

জাপানে থাকা এই দম্পতির ছোট সন্তানের সাক্ষাত পাচ্ছেন না বলে দাবি করেছেন ইমরান শরীফ। তিনি ইত্তেফাককে বলেন, এক বছর হয়ে গেলো সন্তানের মুখটি দেখতে পারছি না। নানাভাবে চেষ্টা করেও পাচ্ছি না। ইচ্ছে করলে এরিকো সন্তানের সঙ্গে ভিডিও কলে সাক্ষাতের সুযোগ করে দিতে পারেন। কিন্তু সেটা করা হচ্ছে না।

তিনি অভিযোগ করে বলেন, ডা. এরিকো দশ মাস ধরে বাংলাদেশে অবস্থান করছেন। তিনি তো ওই সন্তানের দেখভাল করতে পারছেন না। তার বাবা-মা বয়স্ক।

তারা কীভাবে এ বাচ্চার দেখভাল করবেন। ইমরান শরীফ বলেন, ফিলিপিনো এক নারী গৃহকর্মী ওই সন্তানের দেখভাল করছেন।

ইমরান অভিযোগ করে বলেন, জাপানের পারিবারিক আইনে বাবাকে সন্তানের জীবন থেকে পুরোপুরি বিচ্ছিন্ন করে দেয়া হয়। আমার সন্তানরা জন্মসূত্রে বাংলাদেশের নাগরিক। অর্থাৎ জাপানের যেসব সন্তানের বাবা বা মা ভিনদেশি তাদেরকে ‘হাফ ব্রিড’ বলা হয়ে থাকে। এদেরকে নিম্ন লেভেলে দেখা হয়ে থাকে।

তিনি বলেন, মা-বাবার মধ্যে মনোমালিণ্য বা বিচ্ছেদ হলে জাপানের পারিবারিক আইনের ৮৬১ ধারায় সন্তানদেরকে দু’জনের একজনের জিম্মায় দেওয়া হয়। তবে এক্ষেত্রে অধিকাংশ সিদ্ধান্তই যায় মায়ের পক্ষে। বর্তমানে ৮০ ভাগ মামলায় সন্তানের জিম্মা পান মা। আর বাবা ভিনদেশি হলে তার অধিকার অনেকটাই খর্ব হয় বলে দাবি করেন তিনি।

তবে এরিকোর কৌসুলি শিশির মনির বলেন, জাপানি কোর্টে এরিকোর মামলাটি অপেক্ষমান থাকাবস্থায় ইমরান শরীফ বাংলাদেশে চলে আসেন সন্তানদের নিয়ে। সে দেশের আদালতের আদেশ যাহা হউক না কেন তা কার্যকর করার সুযোগ দেয়া হয়নি। এভাবে সন্তানদের নিয়ে সেদেশ থেকে বাংলাদেশে চলে আসা আইনের দৃষ্টিতে কোনভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। শুধু জাপানি আইনে নয় সভ্য জগতের নূন্যতম আইনগত প্রথা ইমরান শরীফ লঙ্ঘন করেছেন।

তিনি বলেন, জাপানি কোর্টের রায়ে দুই সন্তানের জিম্মা দেওয়া হয় মাকে। তবে বাবা সন্তানদের সঙ্গে সাক্ষাত করতে পারবেন সেই কথাও রায়ে বলা হয়। তাহলে উনি যে অভিযোগ করেছেন যে বাবাকে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন করে ফেলা হয় সেটাও সঠিক নয়। ছোট সন্তানের সঙ্গে সাক্ষাত না করা প্রসঙ্গে এই আইনজীবী বলেন, ওই সন্তানটিকে দেখভাল করছেন এরিকোর মা। ফিলিপিনো গৃহকর্মীর দেখভাল করছেন এমন দাবি সত্য নয়।

এদিকে, জাপানের আইন অনুযায়ী দেশটিতে সন্তানসহ প্রবেশ বা বের হওয়ার সময় বাবা বা মায়ের মধ্যে কোন একজনের অনুমতি নেওয়ার প্রয়োজন হয় না। আর এই অনুমতিপত্র হচ্ছে সন্তান নিয়ে দেশে প্রবেশ বা বের হওয়ার সময় একজন কর্তৃক আরেকজনের অনুমতি নেওয়ার নথি। যদিও কিছু দেশে নিজের সন্তান নিয়েও প্রবেশ বা বের হওয়ার সময় বাবা মায়ের মধ্যে একে অপরের অনুমতি নিতে হয়। এই অনুমতি না নিলে সেটা অপহরণ হিসাবে গণ্য হয়ে থাকে।

আদালত অবমাননার মামলা

আপিল বিভাগের রায়ে বলা হয়েছে, পারস্পারিক আলোচনার ভিত্তিতে সময় ও স্থান নির্ধারণ করে সন্তানদের সঙ্গে সাক্ষাত করতে পারবেন ইমরান শরীফ। কিন্তু এই সময় ও স্থান নির্ধারণ না করেই সন্তানদের সঙ্গে দেখা ও সাক্ষাত করছেন তিনি-এমন অভিযোগে তার বিরুদ্ধে আদালত অবমাননার মামলা করেছেন ডা. এরিকো নাকানো।

তার কৌসুলি শিশির মনির বলেন, আমরা নানাভাবে চেষ্টা করছি সন্তানদের সঙ্গে কখন কোথায় ইমরান শরীফ সাক্ষাত করবেন সেই সময় নির্ধারণের। কিন্তু তার বা তার আইনজীবীদের পক্ষ থেকে আমরা কোন সাড়া পাইনি। তবে সাড়া না পলেও ইমরান শরীফ আপিল বিভাগের আদেশ লঙ্ঘন করে স্কুল থেকে ফেরার পথে তিনি দুই সন্তানকে নিজের গাড়িতে তুলে নেন। আবার কোন ধরনের আলোচনা না করেই উনি বারিধারার বাসায় হাজির হয়ে যান। আমরা বারবার এ ধরনের কাজ থেকে তাকে বিরত থাকতে লিগ্যাল নোটিশ দিয়েছি। কিন্তু উনি তাতে কোন কর্ণপাত করেন নাই। এ কারণে তার বিরুদ্ধে আদালত অবমাননার অভিযোগে মামলা করেছি।

তবে ইমরানের আইনজীবী মুশতাক আহমেদ বলেন, যখন আমরা দেখা সাক্ষাতের বিষয়ে আলাপ করতে বসি তখন এমন সব শর্ত জুড়ে দেওয়া হয় তখন আর আলোচনার পরিবেশ থাকে না। নানাভাবে গড়িমসি করতে থাকে। ফলে সন্তানদের সঙ্গে তার সেভাবে সাক্ষাতের সুযোগ হয়ে উঠে না।

শিশির মনির বলেন, ইমরান শরীফ প্রস্তাব দিক কোথায় বসতে চান আমরা সেই স্থানে বসে সাক্ষাতের সময় নির্ধারণ করব।

উভয় পক্ষের আইনজীবীরা জানান, আগামী ১৬ মে প্রধান বিচারপতি হাসান ফয়েজ সিদ্দিকীর নেতৃত্বাধীন বেঞ্চে এই মামলার শুনানির জন্য দিন ধার্য রয়েছে। সেখানে দুই পক্ষের কৌসুলিরাই তাদের বক্তব্য তুলে ধরবেন। এর আগে মামলাটি শুনানির জন্য চেম্বার আদালতে উপস্থাপন করা হয়। তখন চেম্বার আদালতের বিচারপতি এম. ইনায়েতুর রহিম শুনানির জন্য প্রধান বিচারপতির বেঞ্চে পাঠিয়ে দেন।

পারিবারিক আদালতের মামলা:

জাপান থেকে দুই সন্তানকে নিয়ে দেশে ফেরার পর তাদের জিম্মায় চেয়ে ঢাকার দ্বিতীয় অতিরিক্ত পারিবারিক আদালতে মামলা করেন ইমরান শরীফ। গত বছরের ২৮ ফেব্রুয়ারি করা এই মামলা এখন নিষ্পত্তির নির্দেশ দিয়েছে আপিল বিভাগ। বেঁধে দিয়েছেন তিন মাসের সময়। এই মামলার রায় ঘোষণা হলেই জানা যাবে সন্তান কার জিম্মায় যাচ্ছেন। যদিও মামলাটি নিষ্পত্তি না হওয়া পর্যন্ত সন্তানরা মায়ের জিম্মায় রাখার আদেশ দিয়েছেন দেশের সর্বোচ্চ আদালত।

২০২১ সালের ২৩ ডিসেম্বর ইমরান শরিফের বিরুদ্ধে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলা করেছিলেন এরিকো নাকানো। এছাড়া চলতি বছরের জানুয়ারিতে ইমরান শরিফের বিরুদ্ধে আদালত অবমাননার আরও দুটো মামলা করেছিলেন তিনি। আদালত অবমাননার মামলা দু’টিই খারিজ করা হয়ে গেছে বলে জানান ইমরান শরিফ।-ইত্তেফাক