Home বাণিজ্য ও অর্থনীতি সংসারের ব্যয় কমিয়ে টিকে থাকার চেষ্টা

সংসারের ব্যয় কমিয়ে টিকে থাকার চেষ্টা

31

ডেস্ক রিপোর্ট: চাল থেকে ডাল-তেল-চিনি, এমনকি টুথপেস্ট, সাবান কোন পণ্যটির দাম বাড়েনি? এর মধ্যে কোনো কোনো পণ্যের দাম বেড়েছে দ্বিগুণের বেশি। ফলে সংসারে ব্যয় কমিয়ে গত বছর টিকে থাকাটাই ছিল স্বল্পআয়ের মানুষের কাছে সবচেয়ে বড় বিষয়।
বিদায়ী বছরের মাঝামাঝি জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা (এফএও) তাদের প্রতিবেদনে বলেছে, পণ্যসামগ্রীর দাম বেড়ে যাওয়ায় দেশে নতুন করে বিপদে পড়েছে ২৯ শতাংশ মানুষ। যেখানে বছরের শুরুতে দেশের ১৮ শতাংশ মানুষের জীবনমানের ওপর সেই চাপ ছিল। এখন বছর শেষে পণ্যের দাম বাড়ার ফলে বাড়তি চাপ নিঃসন্দেহে আরও বেড়েছে। সরকারের বিপণন সংস্থা ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) তথ্য অনুযায়ী, গত এক বছরের ব্যবধানে প্রতি কেজি খোলা আটার দাম ৭৩ দশমিক ৬১ শতাংশ, প্যাকেট আটা ৭০ দশমিক ৫৯ শতাংশ, খোলা ময়দা ৪৯ দশমিক ৪৭ শতাংশ, প্যাকেট ময়দা ৫৭ দশমিক ১৪ শতাংশ বেড়েছে। এছাড়া সয়াবিন তেলের দাম ২২ শতাংশ, চিনির দাম ৩৫ দশমিক ১৬ শতাংশ, মসুর ডালের দাম মানভেদে ১৫ দশমিক ১৭ থেকে ২৪ দশমিক ৩৭ শতাংশ, অ্যাংকর ডালের দাম ৪৭ দশমিক ৩৭ শতাংশ ও ছোলার দাম ২৫ দশমিক ৯৩ শতাংশ বেড়েছে। অন্যান্য পণ্যের মধ্যে হলুদ, আদা, জিরা, রসুনের দাম ৯ দশমিক ৫২ থেকে ৫০ দশমিক ৮১ শতাংশ পর্যন্ত বেড়েছে। প্যাকেটজাত গুঁড়ো দুধের দাম ২৭ দশমিক ৪৮ থেকে ৪০ দশমিক ১৭ শতাংশ পর্যন্ত বেড়েছে। লবণের দাম বেড়েছে ২৩ শতাংশের বেশি। ডিমের দাম বেড়েছে ৮ দশমিক ৮২ শতাংশ। যদিও তিন মাস আগে প্রতি হালি ফারমের ডিমের দাম ৫০ টাকা ছাড়িয়ে গিয়েছিল। এতে শতাংশের হিসেবে দাম আরও বেড়েছিল।
গত বছর নিত্যপণ্য নিয়ে ভোক্তাদের সবচেয়ে বেশি ভুগিয়েছে সয়াবিন তেল, চিনি ও ডিম। যা সারা দেশে আলোচনার কেন্দ্রে চলে আসে। যদিও দাম বাড়ার এই শতাংশের হিসেব দিয়ে পণ্য তিনটি নিয়ে ভোক্তাদের ভোগান্তি পুরোটা বোঝানো যাবে না। কারণ, গত ঈদের এক দিন আগে বাজার থেকে অনেকটা উধাও হয়ে যায় সয়াবিন তেল। ২০০ টাকা ছাড়িয়ে যায় প্রতি লিটার সয়াবিন তেলের দাম। কিন্তু বাড়তি দাম দিয়েও অনেকেই সয়াবিন তেল কিনতে পারেননি। একই অবস্থা হয় চিনি ও ডিমের ক্ষেত্রেও। বাণিজ্য মন্ত্রণালয় সয়াবিন তেল ও চিনির দাম বেঁধে দিয়েও বাজার নিয়ন্ত্রণ করতে পারেনি। ব্যবসায়ীরা ইচ্ছেমতো দাম বাড়িয়েছে।
এদিকে বছর জুড়ে চালের দামও ছিল চড়া। মোটা চালের কেজি ৫০ টাকা ছাড়িয়ে গেছে। বর্তমানে বাজারে ভালো মানের সরু চাল বিক্রি হচ্ছে ৮২ থেকে ৮৫ টাকা কেজিতে। যদিও এখন আমনের ভরামৌসুম। মিলাররাও ধানচাল ব্যবসায়ীরা জানিয়েছেন, বাজারে ধানের দাম বেশি। এর প্রভাব পড়েছে চালের দামের ওপর। সহসাই চালের দাম কমছে না বলেও তারা জানিয়েছেন। কৃষি মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, দেশে গত কয়েক বছরে টানা চালের উৎপাদন বাড়ছে। গত ২০২১-২২ অর্থবছরে ৩ কোটি ৬৮ লাখ ৫০ হাজার টন চাল উৎপাদন হয়েছে। চলতি আমন মৌসুমে এখন পর্যন্ত উৎপাদনের পুরো হিসেব পাওয়া না গেলেও সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা ছাড়িয়ে যাবে। কিন্তু এর প্রভাব নেই চালের বাজারে। সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, দেশে যথেষ্ট পরিমাণে খাদ্যশস্যের মজুত আছে। কিন্তু একশ্রেণির ব্যবসায়ী অধিক মুনাফা লাভের লোভে বাজারে কারসাজি করছে।

নিত্যপণ্যের বাজারে অস্থিরতা সৃষ্টির অভিযোগে বিদায়ি বছরের সেপ্টেম্বরে দেশের কয়েকটি শীর্ষস্থানীয় শিল্পগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে মামলা করেছে বাংলাদেশ প্রতিযোগিতা কমিশন। এসব কোম্পানি ও ব্যবসায়ীর বিরুদ্ধে বাজারে চাল, আটা, ময়দা, ডিম, বয়লার মুরগি ও টয়লেট্রিজ পণ্যের অস্বাভাবিক দাম বাড়া ও কৃত্রিম সংকট তৈরির মাধ্যমে অস্থিরতা সৃষ্টির অভিযোগ এনেছে প্রতিযোগিতা কমিশন।
এদিকে নিত্যপ্রয়োজনীয় খাদ্যপণ্যের পাশাপাশি নিত্যব্যবহার্য কোনো কোনো পণ্যের দাম বেড়েছে দ্বিগুণেরও বেশি। টুথপেস্ট থেকে শুরু করে সাবান, ডিটারজেন্ট পাউডারসহ অন্যান্য ব্যবহার্য পণ্যের দাম এখন স্বল্পআয়ের মানুষের অনেকটা নাগালের বাইরে চলে গেছে। ফলে গত বছর জুড়েই দেশে দাম বাড়া ছিল আলোচিত বিষয়। গত বছরের আগস্টে দেশে দাম বাড়ে হয় ৯ দশমিক ৫২ শতাংশ। যা ১১ বছর ৩ মাসের মধ্যে সর্বোচ্চ। এর আগে ২০১১ সালের মে মাসে সর্বোচ্চ ১০ দশমিক ২০ শতাংশ দাম বেড়ে যায়। আগস্টের পরে অবশ্য দাম কিছুটা কমে আসে। সেপ্টেম্বর দাম বেড়ে হয় ৯ দশমিক ১০ শতাংশ। অক্টোবর মাসে তা কিছুটা কমে ৮ দশমিক ৯১ শতাংশে নেমেছে।

সার্বিক অর্থনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে বিদায়ি বছরের অক্টোবরে বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি) এক সংবাদ সম্মেলনে জানান, উচ্চ দামের কারণে জীবনযাত্রার খরচ বেড়ে যাচ্ছে। শুধু আমদানি পণ্যের দাম বেশি নয়। দেশের অভ্যন্তরে উৎপাদিত জিনিসপত্রের দামও বাড়ছে। সিপিডি জানিয়েছে, মাছ-মাংস না খেয়েও ঢাকা শহরের চার সদস্যের এক পরিবারকে এখন খাবার কিনতে মাসে গড়ে ৯ হাজার ৫৯ টাকা খরচ করতে হয়। মাছ-মাংস খেলে ঐ পরিবারের খাবারে খরচ হয় ২২ হাজার ৪২১ টাকা।

দাম বাড়ার চাপে নিম্ন আয়ের মানুষ বেশি ভুগছে বলে মনে করে সিপিডি। কারণ, দাম বাড়ার তুলনায় নিম্ন আয়ের মানুষের মজুরি বৃদ্ধির হার কম। সংস্থাটি আরও বলেছে, ভবিষ্যতে আন্তর্জাতিক বাজার থেকে খাদ্যপণ্য কেনায় সমস্যা তৈরি হতে পারে। কারণ, নিজের মজুত নিশ্চিত না করে কোনো দেশ পণ্য রপ্তানি করতে চাইবে না।

কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সভাপতি গোলাম রহমান বলেন, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধসহ বিভিন্ন কারণে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম বাড়ায় গত বছর স্বল্পআয়ের মানুষের কষ্ট বেড়েছে। দেশে জ্বালানি তেলের দাম বাড়ার ফলে নিত্যপণ্যের বাজারে অস্থিরতা কাজ করেছে। মানুষের ওপর চাপ বেড়েছে। ক্যাব সভাপতি বলেন, একশ্রেণির ব্যবসায়ী বাজারে বিভিন্ন পরিস্থিতির সুযোগ নিয়ে কারসাজি করে পণ্যের দাম বাড়িয়েছে। এদের ব্যাপারে সরকারকে কঠোর ব্যবস্থা নিতে হবে।
ইত্তেফাক