Home মতামত সংযমের মাসে কতটা সংযমী আমরা!!!

সংযমের মাসে কতটা সংযমী আমরা!!!

42

সরদার মোঃ শাহীন:

শান্তি আর সম্প্রীতির ধর্ম; ঐক্য আর সাম্যের ধর্ম ইসলাম। ১,৪৪৪ বছরেরও কিছুটা বেশি সময় আগে এই পৃথিবীতে এর আগমন। পাঁচ’শ কিংবা হাজার বছর নয়; দেড় হাজার বছর। একটা বিশাল দীর্ঘ সময়। যদিও বঙ্গদেশে ইসলামের আগমন ঠিক তখন থেকেই নয়। এরও অনেক অনেক পর থেকে। এদেশে ইসলাম এসেছে বড়জোড় চার বা পাঁচশত বছর আগে। সেটাও বা কম কিসের! ভারত মহাদেশে ইসলাম পাঁচশত বছর আগে এসেছে, এটাও তো বিশাল কিছু।
এত বিশালত্বের মধ্যে যেমনি আছে মহিমান্বিত সুবিশাল মুক্তির পথ, তেমনি মানুষসৃষ্ট অপ্রয়োজনীয় এবং বিব্রতকর ছোটখাট অমীমাংসিত বিষয়েরও কিন্তু অভাব নেই। এসব বিষয় মুক্তির সহজ এই পথকে কোন কোন ক্ষেত্রে জটিল করে দিয়েছে। আল্লাহপাক তাঁর রাসুলের মাধ্যমে জাগতিক এবং পারলৌকিক মুক্তির সহজ পথ দিতে ইসলাম পাঠিয়েছেন। আর পরবর্তী কালে অতি পন্ডিতদের অতি আতলামিতে সে পথ হয়েছে জটিল। কোন কোন ছোটখাটো ইস্যু নিয়ে ইসলামের অনুসারীদের মধ্যে মতের ভিন্নতা সামান্য হলেও পথের ভিন্নতা হয়েছে ভয়াবহ রকমের জটিল।
কেন এই জটিলতা? এত বছর পরও কেন এই জটিলতা থাকবে? জটিলতা যেমনি তত্ত্বে আছে, তেমনি শব্দেও আছে। তত্ত্বকথা তথা মর্মবাণী রুহানী এবং জটিল বিষয়। এসবের ব্যাখ্যায় কিছুটা ভিন্নতা থাকতেই পারে। থাকতে পারে মতের পার্থক্যও। কিন্তু তাই বলে সাধারণ শব্দমালায়ও? এই পাঁচ’শ বছরেও কেন ইসলামের প্রকৃত পরিশুদ্ধ শব্দমালা এখনো আমাদের কাছে পৌঁছায়নি! বহুল প্রচলিত শব্দগুলোকেও কেন আমরা বিতর্কের উর্ধ্বে রাখতে পারছি না?
যুগে যুগে যুগ বদলেছে আর আমরা বদলেছি শব্দ। সময়ের বিবর্তনে আমরা বিবর্তিত হয়েছি, আর সাথে বিবর্তিত হয়েছে আমাদের ধর্মীয় শব্দমালা। এটাই তো স্বাভাবিক। এটাই তো ভাষার ধর্ম। ভাষার চলমান গতিধারা কিংবা বিউটি। ভাষা কখনোই এক জায়গায় এক রূপে থাকে না। বারবার বদলায়। নতুন রূপে আবির্ভূত হয়। কোরআন বদলায়নি। কিন্তু কোরআনের ভাষা বদলেছে। কোরআনের আরবী আর আজকের আরবী এক নয়। দেড় হাজার বছরের আগের আরবী আর আজকের আরবী ভাষা এক হতে পারে না। এটাকে সহজভাবে মেনে নিলেই হয়। কিন্তু না! সহজভাবে মেনে নেয়ার প্রশ্নই ওঠে না। যেন মেনে নিলে ধর্ম যাবে, ইসলাম যাবে। অথচ ধর্ম আর ভাষা এক নয়। ধর্ম অবিনশ্বর, অপরিবর্তনশীল। কিন্তু ভাষা পরিবর্তনশীল। আল্লাহ, খোদা, কোরআন শরীফ, নামাজ এবং রমজান। ইসলামে এর চেয়ে দামী শব্দ আর কী আছে? অথচ প্রতিটি শব্দ নিয়েই মতপার্থক্য আছে। আছে মতবিভেদ। কারো সাথে কারো ঐক্য নেই। আছে শুধু বিভেদ আর বিভেদ। গোত্রে গোত্রে বিভেদ। ঐক্য আর সাম্যের বাণী নিয়ে যে ইসলাম এসেছিল, সেই ইসলামেই এখন বিভেদ আর বিভক্তি।
ছোট বেলা থেকে খোদা শব্দটি ছিল বহুল প্রচলিত। আল্লাহ শব্দের প্রতিশব্দ। এ শব্দ দিয়েই রচিত হয়েছে শতশত সাহিত্য আর কাব্য। অথচ সেদিন একজনের সাথে চ্যাটিং এর শেষে খোদা হাফেজ লেখায়, বলা নেই কওয়া নেই, চট করে ক্ষেপে গেল। মোটামুটি মাঝারো মানের ক্ষ্যাপা। তাঁর ক্ষেপে যাবার একটাই কারণ; খোদা হাফেজ বলা যাবে না। বললে আল্লাহ হাফেজই বলতে হবে। বিদ্রোহী কবি নজরুল এখন বেঁচে থাকলে তাঁর অমর গজলখানি নিয়ে কী করতেন কে জানে! কত সুন্দর সে গজল! এখনও মাঝে মাঝে শুনি; এই সুন্দর ফুল, সুন্দর ফল, মিঠা নদীর পানি! খোদা তোমার মেহেরবাণী!!
খোদার মেহেরবাণীর কোরআনকে কোরআন শরীফ অথবা কোরআন মজিদ জেনে এসেছি জন্মলগ্ন থেকে। শুধু কোরআন বললে মুখে আড়ষ্ঠতা আসে। মনে হয়, হয়ত কোরআনের সম্মানহানী করে ফেললাম। অথচ এখন শুনছি কোরআন শরীফ বলাই যাবে না। এটাও বেদআত। বলতে হবে কোরআন মজিদ। ঠিক আছে, মানলাম। বেদআত হলে বলবো না। কিন্তু জানতে ইচ্ছে করে, এটাকে এতদিন কোরআন শরীফ কারা শেখালো আমাদেরকে। আমরা আমজনতা এটা নিজেরা বানিয়েছিলাম, নাকি আজকাল যারা আমাদের বেদআত শেখাচ্ছেন, তারাই শিখিয়েছিলেন!
সবই তারাই শেখান। তাদের শেখানো নামাজকে সালাত বলা নিয়েও কথাবার্তা হচ্ছে আজকাল। একপক্ষ বলছে নামাজ নয়, সালাত বলতে হবে। অপর পক্ষ বলছে, সালাতও বলা যাবে না। বলতে হবে সলাত। কী মুশকিলের কথা! দেড় হাজার বছর আগে সর্বজন গ্রহণযোগ্যতা পাওয়া সার্বজনীন ধর্মের এসব শব্দ নিয়েই এত বিভেদ আজ দেড় হাজার বছর পরেও। আজও শব্দের সামান্য উচ্চারণ নিয়ে এত তর্ক ফ্যাসাদে পড়ে থাকলে ধর্মের আসল মর্মবাণী উপলব্ধি করবো কখন?
রমজানের সিয়াম উপলব্ধির বিষয়। অথচ এসব নিয়ে কোন ভাবনা নেই। ভাবনা আছে শুধু রমজান শব্দটি নিয়ে। শব্দটি কি রমজান হবে, না কি রমাজান হবে, এ নিয়ে তর্ক। তর্ক হচ্ছে রমাজান আর রমাদান নিয়েও। রোজাকে রোজা বলা নিয়েও বিতর্ক কম নেই। বিতর্ক আছে সেহ্রী নিয়েও। আজকাল একটা পক্ষ কোনভাবেই সেহ্রী বলে না। বলে সাহ্রী। তবে লক্ষণীয় যে এখনো ইফতার শব্দটির উপর কারো নজর পড়েনি।
নজর কেবল ইফতারীর রকমারী খাবারের উপর। আবহমান বাংলায় কত ধরনের বাহারী খাবারের সমাহার যে ইফতারে হয়, তা বলাই বাহুল্য। হাতপায়ের নখ কাটা থেকে শুরু করে জীবন পথের সব কিছুতেই প্রিয় রাসুল (সাঃ) এর সুন্নত পালনের জন্যে আমাদের কত রকমের আহাজারী। অথচ নবীজির ইফতারী সুন্নত নিয়ে কারো কোন আহাজারী নেই। সবাই এই জায়গাটি যেন পাশ কাটিয়ে চলেন।
কেউই একটু ভেবে দেখেন না, নবীজির ইফতারী আয়োজনে তাঁর খাদেমগণ বেলা তিনটা থেকে চুলার পাড়ে গেছেন কিনা। সাজিয়েছেন কি না রকমারী খাবারের ডালি। ভেবে দেখেন না, তিনি পিয়াজু, আলুর চপ, বেগুনী আর ছোলাভাজা মুড়ি দিয়ে মাখিয়ে মজার ইফতারী করেছেন কি না। আর জিলাপি কিংবা হালিম? ওসব তো আরো পরের ব্যাপার। আকাশ কুসুম কল্পনার ব্যাপার।
আমাদের প্রিয় নবী ওসব করেননি। সিম্পল একটা রুটি আর কয়েকটা খেজুর দিয়ে উনি রোজা ভাঙ্গতেন। কখনো এসবও জুটতো না। জীবনে বহু রোজায় তিনি মোটে একটা খেজুর দিয়েই ইফতার করেছেন। আমাদের মত খাবারের পসরা সাজিয়ে বসেননি। সামর্থ্য থাকলে তো বসবেন। মুসলিম জাহানের বাদশাহ হয়েও তাঁর সামর্থ্য ছিল না। নিজের কব্জায় থাকা সম্পদ অন্যের জন্যে বিলিয়ে দিলে কারোই সামর্থ্য থাকে না। আমার নবীজি সব সময় সবকিছু অন্যকে বিলিয়ে দিতেন। নিজের জন্যে কিছুই রাখতেন না।
এটাই আমাদের শিক্ষা। এই শিক্ষাই বলে দেয়, রমজানের মূল মন্ত্র আর লক্ষ্যের সাথে এত্ত এত্ত খাবার যায় না। রমজানে এসব খাওয়া কোনভাবেই জরুরী নয়। রোজা মানে দৈহিক ও মানসিক সংযম। আমরা এমন সব সংযমের ধারে কাছেও নেই। রমজানে আল্ল−াহ্ পাক খুব সিম্পল একটা নিয়ম করে দিয়েছেন। নিয়মটি সহজ ভাবে বললে দাঁড়ায় এমন, তোমরা সকালের ব্রেকফাস্টটা ফজরের আগে খেয়ে ফেলবে। আর দুপুরের খাবারটা খাবে সন্ধ্যায়। জাস্ট এটুকুই। কঠিন কিছু না ।
এখন প্রশ্ন করুন নিজেকে নিজে। আপনি দুপুরে কি পিয়াজু, বেগুনী, ছোলাবুট আর মুড়িমাখা খান? জিলাপী কিংবা হালিম? বলা হচ্ছে, আপনি তাই খাবেন, যেটা আপনার নিত্যকার আহার। সব সময় যা খান, তা। কিন্তু না। আমরা সবাই খাবারের ঝাপি খুলি বসি। ১২ মাসের মধ্যে এই রমজানেই বেশি খাই। এবং বাকী ১১ মাস যা খাইনা, তাও খাই রমজানে।
সত্যি কথা বলতে, রমজানে আমরা সংযম নিয়ে রাসুলুল্লাহ (সাঃ) এর আসল সুন্নতই ভুলে যাই। ভুলে যাই, কারণ আমরা ইসলামের মর্মকথা নিয়ে ভাবিও না, সময়ও দেই না। সময় দেই কম গুরুত্বপূর্ণ শব্দমালা এবং তার উচ্চারণ নিয়ে। আর সময় নষ্ট করি তারাবীহ নামাজের রাকাত নিয়ে। ৮ রাকাত, নাকি ২০ রাকাত নিয়ে প্যাঁচাল পারতে পারতে আর রাতভর গলা অবধি খেতে খেতে কখন যে রমজান শেষ হয়ে যায় বুঝতেই পারি না। সংযমের অর্থ বোঝার সময়ও আর অবশিষ্ট থাকে না।

-লেখক: উপদেষ্টা সম্পাদক, যুগবার্তা।