Home জাতীয় শেষ ফেরি’তে শেষ নিঃশ্বাস!

শেষ ফেরি’তে শেষ নিঃশ্বাস!

35

ডেস্ক রিপোর্ট: পদ্মা সেতুর উদ্বোধনের বাকি আর মাত্র কয়েক ঘণ্টা। ঢাকা থেকে দক্ষিণাঞ্চলের সড়কযাত্রায় ঘুঁচবে ফেরিঘাটের ভোগান্তি। সেতু উদ্বোধনের আগের দিন মাঝিরকান্দি থেকে ছেড়ে আসা শেষ ফেরিতে প্রাণ হারালেন বৃদ্ধা আমেনা বেগম। সেতু উদ্বোধনের মাত্র কয়েক ঘণ্টা আগে আমেনা পদ্মা পারাপারের সময় প্রাণ হারানো হতভাগ্য মানুষের তালিকায় আরও একটি সংখ্যা যোগ করলেন।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা শনিবার সকালে উদ্বোধনের পর রোবরার ভোরে যান চলাচলের জন্য খুলে দেয়া হবে পদ্মা সেতু। এর আগের দিন শুক্রবার বিকেল ৪টার দিকে শিমুলিয়া থেকে মাঝিরকান্দি নৌরুটে ফেরি চলাচল বন্ধের আনুষ্ঠানিক ঘোষণা দেয় প্রশাসন।

কর্তৃপক্ষ বলছে, সেতুর উদ্বোধন কেন্দ্র করে শনিবার রাত পর্যন্ত এই রুটে ফেরি চলাচল বন্ধ থাকবে। তবে কয়েক দিন ধরে পদ্মায় তীব্র স্রোতের কারণে প্রতি রাতেই ফেরি বন্ধ রাখা হয়েছে। একই অবস্থা শনিবার রাতেও থাকলে যান চলাচলের জন্য রোববার ভোরে সেতু খুলে দেয়ার আগে শিমুলিয়া থেকে মাঝিরকান্দি নৌরুটে আর ফেরি চলাচলের সম্ভাবনা নেই। সে ক্ষেত্রে মাঝিরকান্দি থেকে ছেড়ে আসা এবং শিমুলিয়ায় পৌঁছে আবার মাঝিরকান্দির উদ্দেশে যাত্রা করা ‘কুঞ্জলতা’ হবে সেতু খুলে দেয়ার আগে শেষ ফেরি।

আর এই শেষ ফেরিতেই শেষ নিঃশ্বাস পড়ল ৭০ বছর বয়সী আমেনা বেগমের। সুচিকিৎসার জন্য বরিশাল থেকে ঢাকার উদ্দেশে অ্যাম্বুলেন্সে নিয়ে আসছিলেন স্বজনেরা। তবে পদ্মা পাড়ি দেয়ার সময় মাঝনদীতেই কুঞ্জলতা ফেরিতে প্রাণ হারান তিনি। একই ফেরিতে তার নিষ্প্রাণ দেহ নিয়ে বরিশালের পথ ধরেছে অ্যাম্বুলেন্স।

স্বজনেরা জানান, বৃহস্পতিবার রাতে স্ট্রোক করায় আমেনার মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণ হয়। বরিশাল শের-ই বাংলা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে নেয়ার পর চিকিৎসকরা জরুরি ভিত্তিতে তাকে ঢাকায় নেয়ার পরামর্শ দেন।

গুরুতর অসুস্থ আমেনাকে নিয়ে শুক্রবার সকালে অ্যাম্বুলেন্সে করে ঢাকার উদ্দেশে রওনা হন তার বড় মেয়ে ও স্বজনেরা। সেনাবাহিনীতে কর্মরত আমেনার ছেলে ঢাকায় সিএমএইচে তার চিকিৎসার ব্যবস্থা করে রেখেছিলেন। বেলা ৩টার দিকে মাঝিকান্দি ঘাটে পৌঁছে সময়মতো ফেরিও পেয়ে যায় অ্যাম্বুলেন্সটি। তবে ফেরি মাওয়া প্রান্তের কাছাকাছি এসে পাড়ে ভেড়ার আগেই মারা যান আমেনা।

আমেনার ভাতিজা শাওন মাহমুদ বলেন, ‘আমার ফুপু রাতে স্ট্রোক করার পর জরুরি ভিত্তিতে সকালে ঢাকায় উদ্দেশে রওনা হই। ফেরি পেতে কোনো সমস্যা হয়নি। তবে এভাবে মাঝনদীতে তিনি চলে যাবেন আমরা বুঝিনি।’

অ্যাম্বুলেন্সচালক মো. আল আমিন বলেন, ‘এতো তড়াহুড়া করে গাড়ি চালিয়ে আসলাম, গাড়ির পর গাড়ি ওভারটেক করলাম, পুরো রাস্তায় আল্লাহ আল্লাহ করে গেলাম যেনো ফেরি পেতে সমস্যা না হয়। কিন্তু মানুষটারে হাসপাতালে পৌঁছায়ে দিতে পারলাম না।’

আমেনা প্রাণ হারানোর পর স্বজনদের আর্তনাদে কুঞ্জলতা ফেরিতে হৃদয়বিদারক পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়। ফেরির কর্মীসহ অন্য যানবাহনের কর্মী ও যাত্রীরা অ্যাম্বুলেন্সটি ঘিরে ধরেন। ফেরির লস্কর নাজমুল বলেন, ‘আমাগো ফেরিতেই ওনার দম ছাড়ার কথা কপালে লেখা ছিলো। ব্রিজ হয়ে গেছে, এখন আর অমন দৃশ্য দেহন লাগবো না।’

পদ্মা পারাপারে ঝরেছে অসংখ্য প্রাণ

২০১৯ সালের ২৫ জুলাই। মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় গুরুতর আহত নড়াইলের কালিয়া পাইলট মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের ষষ্ঠ শ্রেণির ছাত্র তিতাস ঘোষকে বহনকারী অ্যাম্বুলেন্স রাত ৮টার দিকে পৌঁছায় পদ্মার কাঁঠালবাড়ী প্রান্তের ১ নম্বর ফেরিঘাটে।

তবে এটুআই প্রকল্পে কর্মরত যুগ্ম সচিব আবদুস সবুর মণ্ডল পিরোজপুর থেকে ঢাকা যাবেন বলে ফেরি আটকে অপেক্ষা করতে থাকে ঘাট কর্তৃপক্ষ। প্রায় ৩ ঘণ্টা পর সবুর মণ্ডল ঘাটে পৌঁছালে ফেরি ছাড়ে। অ্যাম্বুলেন্সটিও ফেরিতে ওঠার সুযোগ পায়। তবে এরই মধ্যে মস্তিষ্কে প্রচুর রক্তক্ষরণে ফেরিতেই মারা যায় তিতাস।

সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত প্রতিবেদন ও স্থানীয় নৌ-পুলিশের অনানুষ্ঠানিক তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, গত ১০ বছরে পদ্মায় বিভিন্ন নৌ-দুর্ঘটনায় প্রাণ হারিয়েছেন দেড় শতাধিক মানুষ। নিখোঁজ আছেন অনেকে।

এক দশকের মধ্যে সবচেয়ে ভয়াবহ দুর্ঘটনা ঘটে ২০১৪ সালের। সে বছরের ৪ আগস্ট আড়াই শতাধিক যাত্রী নিয়ে পদ্মায় ডুবে যায় পিনাক-৬ নামের একটি লঞ্চ। সরকারি হিসাবে, দুর্ঘটনার পর ৪৯ জনের মরদেহ উদ্ধার করা হয়। নিখোঁজ ৬৪ জন। উদ্ধার হওয়া মরদেহের মধ্যে ২১ জনকে মাদারীপুরের শিবচর পৌর কবরস্থানে বেওয়ারিশ হিসেবে দাফন করা হয়। গত আট বছরেও তাদের পরিচয় শনাক্ত হয়নি। হদিস পাওয়া যায়নি দুর্ঘটনার শিকার পিনাক-৬ লঞ্চটির।

গত বছরের ৩ মে কাঁঠালবাড়ীর বাংলাবাজার পুরোনো ঘাটে পদ্মা নদীতে যাত্রীবোঝাই স্পিডবোট বালুবোঝাই বাল্কহেডের সঙ্গে ধাক্কা লেগে ডুবে যায়। এতে তিন শিশুসহ ২৬ যাত্রী মারা যান। একই বছর মাত্র ১০ দিনের মাথায় ১২ মে বাংলাবাজার-শিমুলিয়া নৌরুটের পদ্মা নদীতে একটি রো-রো ফেরিতে প্রখর রোদের তাপে পাঁচজন যাত্রী প্রাণ হারান। এনায়েতপুরী নামের ফেরিটি ঘাটে পৌঁছানোর পর জ্ঞান হারানো অর্ধশতাধিক যাত্রীকে উদ্ধার করা হয়।

এছাড়া প্রায় প্রতি বছর পদ্মায় স্পিডবোটে উল্টে বা দুটি স্পিডবোটের সংঘর্ষে প্রাণহানি ঘটেছে। ট্রালারডুবিও হয়েছে অনেকবার।

শিবচর উপজেলার চরজানাজাত নৌ-পুলিশ ফাঁড়ির ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা জাহানুল আলম বলেন, ‘নৌ-দুর্ঘটনার সঠিক পরিসংখ্যান আমাদের কাছে নেই। ছোট-বড় কোনো দুঘর্টনা ঘটলে সঙ্গে সঙ্গে আমরা উদ্ধার তৎপরতায় অংশ নিই। কোথাও নৌপথে অনিয়ম হলে ব্যবস্থা নিই। এর বাইরে তেমন কিছু করার নেই।’

মাদারীপুর সচেতন নাগরিক কমিটির সভাপতি ইয়াকুব খান শিশির বলেন, ‘দীর্ঘদিন ধরেই বাংলাবাজার-শিমুলিয়া নৌরুটে ফেরি, লঞ্চ ও স্পিডবোট চলাচলের ক্ষেত্রে অনেক অনিয়ম আর স্বেচ্ছাচারিতা ছিলো। এ কারণেই বড় বড় দুর্ঘটনা ঘটেছে। পদ্মা সেতুর কারণে এ ধরনের দুর্ঘটনা কমে আসবে।’ নিউজবাংলা