Home বাণিজ্য ও অর্থনীতি শুধু আমাদের দুটো ডালভাতের ব্যবস্থা করে দিন

শুধু আমাদের দুটো ডালভাতের ব্যবস্থা করে দিন

25

টাঙ্গাইল প্রতিনিধি: টাঙ্গাইল মির্জাপুরের আজগানা ইউনিয়নের কাঁচা কাঠ পুড়িয়ে কয়লা তৈরির প্রায় ২৫ টি চুল্লী উপজেলা নির্বাহী অফিসারের নির্দেশে বন্ধ করা হয়েছে। হয়তো শীঘ্রই ভেঙে ফেরা হবে এসব চুল্লী। চা শ্রমিকদের মতো স্বল্প মুজুরি আর সারাদিন গাধার খাটুনি খেটে দুটো ডালভাতের আশায় শত শত শ্রমিক কাজ করেন কয়লা চুল্লীতে। এসব শ্রমিক স্থানীয়। অনেকেরই নিজের জমি নাই। যাদের জমি আছে বছরের ছয় মাস পানির তলে থাকায় একবার চাষ হয়। এক ফসলি এসব জমিতে চাষ করে দুবেলা খাবারও জোটে না। ভরসা শুধু পরিবারের ছোটবড় সবাইকে নিয়ে কাঠ পোড়ানো চুল্লীতে শ্রম বিক্রির কাজ।
পাহাড়ি গাছের ডাল কিবা বাড়ীর উঠানের অপ্রয়োজনীয় গাছ আসে মহিষের গাড়ী চেপে। ভারী কাঠগুঁড়ো গাড়ী থেকে নামানো, কাঠ চিঁড়ে চুল্লীর উপযোগী করা ও চুল্লীতে থাক থাক কাঠ সাজানো সবই করতে এই শ্রমিকদের। একটা চুল্লীতে কাঠ সাজাতে লেগে যায় সপ্তাহ খানেক। তারপর শুরু হয় আগুন দেওয়ার কাজ। আগুন জ্বেলে দিলেই ধোঁয়া আর ধোঁয়া।কাঠ পোড়ানোর অনেক শ্রমিকই শ্বাসকষ্টে ভূগেন। তারপরও উপায় না থাকায় শত বছর ধরে চলছে তাদের এই পূর্ব পুরুষের পেশা।

সম্প্রতি টাঙ্গাইলের মির্জাপুর উপজেলার কাঠ পোড়ানো চুল্লী মৌখিকভাবে বন্ধ করে উপজেলা প্রশাসন। আর এতেই বেকার হয়ে পরে শত শত শ্রমিক।

সরেজমিনে দেখা যায়, আজগানা গ্রামে মহিষ বাতানে বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে প্রায় ২০/২৫ টি কাঠ পোড়ানো চুল্লী। নিজ বাড়ির উঠানে বা একটু দূরে স্থাপিত এসব চুল্লীতে কাঠ পোড়ানো বন্ধ রয়েছে। চুল্লীর আশেপাশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে চুল্লীর কাঁচা মাল কাঠেরগুঁড়ি।

চুল্লীতে কর্মরত কবির হোসেন,আলহাজ, নাসিমা সহ একাধিক শ্রমিক জানান, আমরা অশিক্ষিত মানুষ।আমরা দীর্ঘ ১০০ বছর ধরে পূর্ব পুরুষের কাঠ পুড়ানো ব্যবসার সাথে জড়িত। আমাদের নিজের কোন জমি নাই।পরের জমি বর্গা চাষ করি আর জমিতে প্রায় ছয় মাস পানি থাকায় বছরে এক বারই চাষ করা যায়। এতে যে ফসল পাই তা দিয়ে দুবেলা ভাতও জোটে না। তাই বাধ্য হয়ে এ পেশায় আছি। তাছাড়া এই পাহাড়ি অঞ্চলে পেশা বদল করার আর কোন সুযোগ নাই।
কাঠ পুড়িয়ে কয়লা তৈরি যদি অবৈধ হয় তাহলে সরকার বন্ধ করে দিক। কিন্তু আমরা যারা অসহায় দিনমজুর তাদের কাজের সুযোগ করে দিয়ে আমাদের যেন বাঁচায়। আমরা বিভিন্ন এনজিও ঋণে জর্জরিত। প্রতি সপ্তাহে হাজার হাজার টাকা কিস্তি। চুল্লী বন্ধ থাকায় পরিবারের ভরণপোষণের দায়িত্বও নিতে পারছি না। আর কিস্তি টাকা পরিশোধ করতে না পারায় বাড়ি থেকে পালিয়ে বেড়াচ্ছি। আমাদেরকে বাঁচান। বিষ খেয়ে মরা ছাড়া আর কোন গতি নাই।
সরকার যদি ডাকাত আর সর্বহারাদের পূনর্বাসন করতে পারে তাহলে আমাদেরকেও সহোযোগিতা করতে পারবে। তাদের থেকে আমাদের অপরাধ বেশি না। আমরা পরিস্থিতির শিকার।

চুল্লীর মালিক শারীরিক প্রতিবন্ধী হারুন -অর-রশিদ বলেন, আমি শারীরিক প্রতিবন্ধী। এই চুল্লী থেকে যে আয় হয় তা দিয়েই আমার পরিবারের আহার জোটে। চুল্লী তৈরির সময় বাঁধা দেয় এ এলাকার প্রভাবশালী আনোয়ার, হেলাল আর জাহাঙ্গীর। পরে প্রতি চুল্লী ৩০ হাজার টাকা করে প্রদান করার পর চুল্লী তৈরির অনুমতি মিলেছে। সম্প্রতি চুল্লী প্রতি ৩ লক্ষ টাকা চাঁদা দাবি করে।এতো টাকা চাঁদা দিতে অপারগতা প্রকাশ করলে তারা বলে চুল্লী চলবে না। পরে তারা প্রশাসনকে লিখিত ভাবে জানালে প্রশাসন কাঠ পোড়ানো কাজ বন্ধ করেন। অথচ এই আনোয়ারের বাবা ও একজন পোড়ানো কাঠ বিক্রির ব্যবসায়ী ছিলেন। ঐ সময়ে তারা এ এলাকায় চুল্লী স্থাপন করে কাঠ পোড়াতে সাধারণ মানুষকে উদ্বুদ্ধ করতেন।

চুল্লীর মালিক আঃ মান্নান, মোঃ দুলাল মিয়া,হান্নানসহ অনেকেই জানান, আজ ইউনিয়নের চেয়ারম্যান কাদের সাহেবের সাথে চক্রান্ত করে আনোয়ার, হেলাল ও জাহাঙ্গীর আমাদের বাপ-দাদার প্রায় শত বছরের পুরনো ব্যবসা বন্ধ করার পায়তারা করতেছে। তাদের চাওয়া তিন লক্ষ টাকা চাঁদা প্রদান করলেই আজ চুল্লী বৈধতা পেতো।
আমরা সবারই প্রতি সপ্তাহে ৮- ১০ হাজার টাকা ঋণের কিস্তি প্রদান করি। কিস্তি উঠিয়েই চুলা তৈরি করেছি। তারা ৩০ হাজার টাকা নিয়ে চুলা চালানোর আশ্বাসও দিলো আবার প্রতি মাসে ৩ লক্ষ টাকা চাঁদা না দেওয়ায় চুলা বন্ধের ব্যবস্থা করেছে।
এখন পরিবার নিয়ে কোথায় যাবো। এখন তো চুলা বন্ধ। কিস্তি দিবো কি আর খাবো কি? আমাদের বিষ খেয়ে মরা ছাড়া আর কোন উপায় নাই।

এ বিষয়ে স্থানীয় বাসিন্দা মোঃ আনোয়ার হোসেন বলেন, আমি কোন চাঁদা দাবি করি নাই। এটি আমার বিরুদ্ধে যড়যন্ত্র। আমার বাড়ির চারপাশে এসব চুল্লী গড়ে উঠেছে। ধোঁয়ায় বাড়িতে বসবাস করা যায় না। আমি স্ত্রী শ্বাসকষ্টের রোগী তাই আমি পরিবেশ রক্ষার্থে অভিযোগ জানিয়েছি। বাকিটা প্রশাসন বুঝবে।

আজগানা ইউনিয়নের চেয়ারম্যান আব্দুল কাদের সিকদার বলেন, প্রশাসনের কাছে অনুরোধ এসব অবৈধ কয়লা চুল্লী শীঘ্রই বন্ধ করা হোক। দশ জনের জন্য তো দশ হাজার লোকের ক্ষতি হতে দেওয়া যাবে না। পরিবেশ বাঁচাতে এসব চুল্লী বন্ধ করা উচিৎ।

মির্জাপুর উপজেলা নির্বাহী অফিসার শাকিলা বিনতে মতিন বলেন, কাঠ পুড়িয়ে কয়লা তৈরির চুল্লী অবৈধ। এজন্য মৌখিকভাবে সেগুলো বন্ধ রাখার নির্দেশ প্রদান করা হয়েছে। শীঘ্রই ওগুলো ভেঙে ফেলা হবে।

তিনি বলেন, কাঠ পোড়ানো চুল্লীতে যারা কাজ করেন তারা এ অবৈধ ব্যবসা সম্পর্কে অবগত রয়েছেন। তারা পেশা বদলে ফেলতে পারেন। যারা নিতান্তই অসহায় তাদের সহায়তার ব্যাপারে উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছে সুপারিশ করবো যাতে তারা কর্মমুখী হয়ে স্বাভাবিক জীবন যাপন করতে পারেন।