Home মতামত অনু গল্প: কে তুমি আমায় ডাকো

অনু গল্প: কে তুমি আমায় ডাকো

72

পলাশ কলি হোসেন শোভা : শুনছেন? প্রথমে বুঝতে পারে না আসাদউল্লাহ্, ইকটু বা পাশে তাকতেই দেখে একটি মেয়ে তাকে বলছে, হে তাকেই তো ডাকছে, জ্বী বলুন?
আপনি ডাঃ আসাদ? ওনার মতই তো লাগছে। সব সময় গুরুগম্ভীর আসাদ ভ্রু কুচকে বলে জ্বী আমিই, কেন বলুন তো? মেয়েটি খুব দ্রুত বলে যায়, আপনাকেই তো আমি খুঁজছি। শপিং মলে তো কথা বলা হবে না আপনার ভিজিটিং কার্ডটা যদি দিতেন,আসাদ জানে পথে ঘাটে লোকজন তার সাথে এভাবেই আলাপ করতে চায়। কার্ড টি বের করে দিয়েই বললো, আচ্ছা আসি, দেখা হবে। সামনের দিকে যেতে যেতে আসাদ ভাবে আজকাল লোকজন আমাকে চট করে চিনে ফেলছে কারণটা কি!! পরমুহূর্তেই মনে হয়, টিভি তে সেমিনারে ইদানিং ইকটু বেশিই তাকে দেখা যায়, তাই হয়তো…..
ধানমন্ডির লেকের কোল ঘেঁষেই তার চেম্বার , পেশেন্ট না আসা পর্যন্ত পানির দিকে তাকিয়ে থাকতেই তার পছন্দ। ভেতরে আসতে পারি, বলেই মেয়েটি অনুমতির অপেক্ষা না করেই ঢুকে যায়। আসাদ তাকিয়ে দেখেই চিনতে পারে সেদিনের শপিং মলে দেখা হওয়া মেয়েটি।
ওহ্! আপনি বসুন। তা কি মনে করে এলেন?
বারে ডাক্তার এর কাছে লোকজন আসবে এটাই স্বাভাবিক নয়? বেশ আন্তরিক হয়ে কথা বলছে মেয়েটি আসাদ বুঝে ফেলে মিশুক আর আমুদে টাইপের মেয়ে। বসার ভঙ্গিটিও চমৎকার , ভালো লাগে আসাদের। খুব খেয়াল করে দেখতে থাকে এমন মেয়েদের রুপের ছটা প্রথমেই যে কারো নজর কাড়বে।
তা বলুন কি প্রবলেম?
বারে এমনি তে আসা যায় না আসাদ খুবই অবাক হয় এমন কথা তো কোন পেশেন্ট কখনোই বলেনি, একে তো পেশেন্ট ও মনে হচ্ছে না!
ডাঃ আমি এসেছি একান্ত কিছু কথা বলতে, কথা গুলো এমনই যে ফ্রী না হলে আমিও বলতে পারবো না, আপনিও আমার কোন চিকিৎসা করতে পারবেন না। তাই এতক্ষণ হেয়ালি করছি, সরি ডাঃ।
কি গোপন কথা হতে পারে, বয়স তো খুব বেশি হলে উনিশ কিংবা কুড়ি হবে। কলেজে পড়ার বয়সই তো মনে হচ্ছে।আসাদ কে চিন্তিত দেখে বলে, আমার সম্পর্কে ভাবছেন তো? আমি ম্যারিড, আজ দেড় বছর হলো বিয়ে হয়েছে, আসাদের মুখের ভাবান্তর দেখে বলে,
ওও আমি রেনু, পুরান ঢাকার মেয়ে ওখানেই স্বামী সংসার সব আছে।
আপনাকে তো সম্পূর্ণ সুস্থ মনে হচ্ছে , আমার কাছে কেন এসেছেন?
চা হবে স্যার? খুব খেতে ইচ্ছে করছে জানেন সব সময় ফ্লাক্স ক্যারী করি আজই… কথাটা শেষ করে না রানু
মনু মিয়া কে চা দিতে বলেই শুনতে চায় আসাদ এখানে আসার কারণ।
স্যার পুরাণ ঢাকার কলতা বাজারে আমার বাবার বাড়ি। বাবার দ্বিতীয় পক্ষের মেয়ে আমি। আগের ঘরে সাত ছেলে মেয়ে। আমার মায়ের রুপ দেখে বাবা বিয়ে করে।কিন্তু এ বিয়ে কেউ মেনে নিতে পারেনি।
আহা সমস্যা কি আপনার মায়ের?
না না না স্যার আমার আমার ছয় বছর বয়সে বাবা মারা যায়। আমি মা অসহায় হয়ে পড়ি মামা নানা কেউ পাশে ছিলো না, অনেক কষ্টে এসএসসি কোন মতে পাশ করি। সৎ ভাইয়েরা কখনো সখনো আসে আর মা কে আমার বিয়ে দেবার কথা বলে। ততোদিনে আমি বুঝে গেছি আমার রুপই আমার কাল। বাইরে বেরোতে পারিনা, বিয়ের প্রস্তাব আসতেই থাকে
তাতে সমস্যা কোথায়?
স্যার বিয়ে তো জোর করে করছে হোসেন সর্দার। নাম শুনেন নি?বাবু বাজারের পঞ্চায়েত প্রধান। বয়স্ক একটা লোক, জানেন স্যার কম করে হলেও বাইশ বছরের বড় হবে।
ছয় তালা দালান আছে দোকানপাট আছে। সব আছে কিন্তু …. চুপ করে যায় রেনু। আসাদও চুপ করে থেকে বুঝার চেষ্টা করে রেনুর চাপা কষ্ট টা।
এমন এদেশে অনেক স্বামী স্ত্রী আছে বয়সের অনেক পার্থক্য , তারা তো ভালোই আছে আপনার সমস্যাটা কোন খানে?সব খুলে বলুন কোন কিছু গোপন করবেন না।
স্যার, আমার স্বামী প্রথম একমাস আমাকে নিয়েই মেতে ছিলো।তারপর শুরু হলো তার ব্যস্ততা। মহল্লার বিচার আচার, রাতের আড্ডা , জুয়া মদ কোনটাই বাকি নেই যা ও করে না! একা একা সময় কাটে না। কোথাও যেতে মন চায় না সবার প্রশ্ন জামাই আইলো না যে।এর উত্তর আমি আর দিতে পারছিলাম।না।
জানেন,খুব বেশি স্বপ্ন ছিলো, বাধ ভাঙা প্রেম আসবে জীবনে কলেজে পড়তে পারিনি। আঠারে বছরে বিয়ে হয়ে যায়। ভাবলাম এবার স্বামীই আমার সব সাধ মিটিয়ে দিবে। কিন্তু কই তা আর হলো না। ডাঃ ভেতরটা হাহাকারে অস্হির হয়ে থাকে। ভালবাসার কাঙাল আমি। আমি চাই, খুব করে চাই কেউ আমাকে পাগলের মত ভালবাসুক। আমার অস্তিত্ব জুড়ে শুধু তারই পদচারনা থাকবে তা আর হলো কই?
আপনি আপনার স্বামীকে নিয়েই সুখী হতে চেষ্টা করুণ ।
কি করে সম্ভব বলেন? সকালে বের হয় গভীর রাতে ফেরে, আমিও তো মানুষ আমার ও তো ইচ্ছে করে…….
আপনি কি চান রেনু বলুনতো?
আমি আসল কথাই তো বলিনি।আমাদের ছয় তালা বাড়ির তিন তালায় আমরা থাকি বাকি গুলো তে সব ভাড়া। ছয় মাস আগে দোতালায় নতুন ভাড়াটিয়া আসে এক ভদ্রলোক তাঁর চার মেয়ে নিয়ে। বড় মেয়েটার নাম পপি কলেজে পড়ে। ধীরে ধীরে ওর সাথে আমার বন্ধুত্ব হয়। একটা সময় এমন হয় যে কলেজের সময়টুকু ছাড়া বাকি সময় আমার সাথেই থাকে। আমার তখন মনে হতে লাগলো এইতে জীবন, এটাই তো আমি চেয়েছি। আমার স্বামী ও বেশ খুশি হলো যে আমি একজন সাথী পেয়েছি এটা ভেবে।
ডাঃ একটা সময় এমন হতো লাগলো আমার, ওকে না দেখলে ছটফট করতে লাগলাম।অন্য কারে সাথে কথা বলতে দেখলে আমি সহ্য করতে পারি না।
কেন আপনার এমন হয়? ছোট বেলায়ও তো বন্ধু ছিলো তখন কি এমন হতো?
না কখনোই হতো। পপি তো আমার ভালবাসা। কলেজ থেকে প্রতিদিন ই আমার জন্য কিছু না কিছু আনবেই। আচার পছন্দ বলে সব সময় এনেই গালে চট করে একটা চুমা দিয়ে গাল টিপে দেয় বলে, আমার মতো ভালো তোমায় কেউ বাসবে না গো। আমাদের মেলামেশাটা একটা পাগলামিরই পর্যায়ে চলে যায়। অন্য ভাড়াটিয়ারাও এ নিয়ে দশ কথা বলে। আমার স্বামীর কানেও কথাটা ওঠে আমরা নাকি প্রেম করছি, এটাকে নাকি সমকামী না কি সব বলে। আমরা দুজন দুজনকেই ভালবেসেছি। স্বামীর না পাওয়া আদর কেয়ারিং পপি দিচ্ছে, ওকে ছাড়া আমি বাচবো না ডাঃ, ওকে আমার বেঁচে থাকার জন্যই প্রয়োজন।
ঘড়ির দিকে তাকিয়ে আসাদ চমকে উঠে।অনেক রাত হয়ে গেছে, আজ আর নয় আগামীকাল আসবেন বাকি সিটিংটা তখন দেবো। ওহ্ ভালো কথা আপনি কিভাবে যাবেন?
সমস্যা নেই ডাঃ সাথে গাড়ি আছে আমি মায়ের বাসায় যাবো। বেশ কদিন ধরে ওখানেই আছি একথা বলে রেনু রুম থেকে বের হয়ে যায়
আসাদ ভাবতে থাকে ভাল বাসার হেরফের হলেও মানুষ মাএই শুধু ভালবাসার কাঙাল!!

আরে আপনি এসে গেছেন? তা কতক্ষণ? চেম্বারে ঢুকেই রেনু কে দেখতে পেয়ে আসাদউল্লাহ যেন ইকটু খুশীই হয়। কিন্তু কেন হয় তা সে নিজেই জানে কি?আসলে গতকাল রেনুর কথা গুলো তাকে অনেক ভাবিয়েছে, ভেরী ইন্টারেস্টিং মনে হওয়াতেই মনে মনে রেনু কে খুঁজছিলো।
তা কেমন আছেন রেনু? চেয়ারে বসতে গিয়ে খেয়াল করলো রেনু চা খেয়েছে কাপটা মনু মিয়া এখনো সরায়নি, আসাদ ভাবে এতো দেখি রীতিমতো চা খোর।হেসে বলে, তা শুরু করা যাক। ওহ্ হা বলছিলেন আপনি মায়ের বাড়িতে থাকছেন, বিষয়টা কি?
ডাঃ অনেক উল্টাপাল্টা ঘটনায় সর্দার মানে হোসেন সর্দার আমার হাসব্যান্ড আমাকে মায়ের বাড়ি পাঠিয়ে দেয়।
খুলে বলুন রেনু, আপনার স্বামী কি জেনেছিলো যে মায়ের কাছেই পাঠিয়ে দিতে হলো?
স্যার আমি তো তখন পপিকে নিয়ে আত্নহারা। একদিন পপি আমার ঘরে ঢুকেই জড়িয়ে ধরে বললো, জানো আজ বাংলা ক্লাসে তোমার কথা এত মনে হচ্ছিলো যে আমি মনই দিতে পারছিলাম না ক্লাসে বলেই চট করে গালে কয়েকটা চুমু দিয়ে জড়িয়ে ধরে আর আমিও বলে বসি পপি আমিও তো তোমাকে না দেখে থাকতে পারছি না, ঠিক ঐ মুহূর্তে সর্দার আমাদের দেখে ফেলে। এ সময় তার আসার কথা নয় কেন এলো আমি অবাকই হয়েছি।
রেনু আপনি যা বলছেন তাতে দুটো মেয়ের বন্ধুত্ব হলে তা স্বাভাবিক , একজন আরেকজনকে ভালোবাসলে ফীল করতেই পারে।
না না না ডাঃ কাহিনি আরও আছে।
মানে? আসাদ আরও উৎসুক হয়ে পড়ে। যদিও বুঝতে পারছে রেনু এরপরে কি বলবে।একটা মেয়ের মেন্টালী ডিসঅর্ডার হতেই পারে, সহজ চিকিৎসা ও আছে। হু বলুন?
ডাঃ আমরা খুব চিঠি লিখতাম।
তো কি হয়েছে? সবাই লিখে।
ব্যপারটা তা নয়। ও এমন ভাবে লিখতো তা কেবল একজন প্রেমিকাকে লেখা সম্ভব । আমি ও রোজ একটা করে চিঠি দিতাম।ভাড়াটিয়ারা আমাদের এই মেলামেশা টা ভালো চোখে দেখতো না তাছাড়া আমার বয়স কম দেখে তারা আমার উপর খবরদারি শুরু করে দেয়। ছাদে বারান্দায় পপি আমাকে আদর করতো আর জানেন ডাঃ আমার তা কেমন জানি ভালো লাগতে শুরু করলো।আসলে সর্দার তো আমাকে কখনো পপির মত আদর করেনি। চিঠি গুলো সব সর্দারের হাতে পড়ে যায়, সে সব গুলো চিঠি পড়ে, তারপর……
মানে কি বলছেন রেনু? আপনার স্বামীই তো….
না তা কখনো হয়নি, ওর অতিরিক্ত ব্যস্ততা আর অত রাতে বাড়ি ফিরে আমাকে আদর করার সময় হতো না। শুনেছি,পচার মার কাছে রেগুলার যায়। ওওহ্ পচার মা এবাড়ির রাধুনি বুয়া আমি আসার আগেই ওকে এখান থেকে সরিয়ে ভাড়া বাসায় তুলেছে
বলেন কি! তাও কি সম্ভব? এত রুপবতী একটি মেয়ে ফেলে….আসাদ কেমন জানি ধাঁধায় পড়ে যায়।
রেনু বলতে থাকে, আমি পচার মায়ের কথা জিগ্যেস করতেই আমাকে এমন শাসালো আর ভয়ও দেখালো এসব নিয়ে আমি যেন অহেতুক বাড়াবাড়ি না করি
আপনি, আপনার কথা বলুন।
আমাদের দুজনের দেখাসাক্ষাৎ বন্ধ করে দেয় ওদের বাড়ি ছাড়ার নোটিশও দিয়ে দেয়। আমি অনেক বলেছি সর্দার কে ওদের তুলে দিও না, আমি আর ওর সাথে মেলামেশা করবো না
জানেন আমার কথা শুনলোই না। পপি চলে যাবার দিন খুব জোরে কথা বলছিলো সিড়িতে একটা কাগজ ফেলে চলে যায় আমার দিকে তাকলোই না। কাগজটা তুলে এনে দেখি ওর নতুন বাসার ঠিকানা আর নতুন একটা মোবাইল নাম্বার। কিন্তু আমার তো ফোন সর্দার নিয়ে গেছে।
তাহলে আপনি ওর বাসায় যেতেন?
নো ডাঃ তা তো সম্ভব ছিলো না ওর বাবা মা আমাকে সহ্যই করতে পারতো না। কিন্তু একদিন আমরা গোপনে দেখা করি এটাও সর্দার জেনে যায়। আমি কি করে জানবো বলুন ও আমার পেছনে লোক লাগিয়ে রেখেছে।পরিস্থিতি এমন হলো আমাকে মায়ের বাড়ি পাঠিয়ে দিয়েছে মাস হতে চললো। শুনেছি আমাকে ডিভোর্স দিবে।ডাঃ আপনিই বলুন আমার দোষটা কোথায়? শুধু মাএ ভাললবাসার কাঙাল আমি যা পাইনি স্বামীর কাছে তা যে দিয়েছে আদর তাতেই আমি সুখ পেয়েছি সুখি থাকতে চেয়েছি
ইয়ে মানে আপনারা কি স্বামী স্ত্রীর মত……কথাটা শেষ করতে পারেনা আসাদ রেনু বাধা দিয়ে উঠে।না ডাঃ আমরা শুধু ভালোবেসেছি,জড়িয়ে ধরেছি আর….থেমে যায় রেনু।
কিছুক্ষণ পরে আপন মনে বলতে থাকে,কেন সে আমায় ডাকে? আর সব্বাই কেন এই রিলেশন নিয়ে নোংরামি করছে ডাঃ? আমি তো কিছুই চাইনি।যে ভালবাসার তীব্র আকাংখা আমার ভেতরে তা পেলে কি এমন হয়…
আসাদ বুঝতে পারে রেনুর মনের অবস্থা । হয় এমনই হয় কোন কোন মেয়েদের অন্য একটি নারীর আকর্ষণ নয় ভালবাসার মোহজালে আটকে পড়ে যায় অবশ্যই এর চিকিৎসা সে নিজেই করবে। রেনুকে সে সুস্থ করে তুলবেই তবে তার স্বামী হোসেন সর্দার কেই বেশী প্রয়োজন।ঘড়ির দিকে তাকিয়ে আজও চমকে উঠে আসাদ।

-লেখক : অধ্যাপক (অব) মিরপুর গার্লস আইডিয়াল বিশ্ববিদ্যালয় কলেজ, ঢাকা।