Home প্রচ্ছদ মায়ের কান্দন যাবজ্জীবন!!!

মায়ের কান্দন যাবজ্জীবন!!!

46

সরদার মোঃ শাহীনঃ

বড় হবার পর থেকে জুলাই ছিল আমার জন্যে আনন্দের মাস। আমাকে আনন্দ দেবার মাস। এই মাসে জন্মেছিলাম বলে মাসটিকে একটু আলাদা রকমের মনে হতো আমার। জুলাই মাসকে আমার নিজের মাস মনে হতো। প্রতিদিন পত্রিকায় রাশিফলের পাতা ঘেটে জন্ম তারিখ মিলিয়ে রাশিফল দেখতাম। নিজের চরিত্র বোঝার চেষ্টা করতাম। জুলাইতে জন্ম নেয়া মানুষেরা কেমন চরিত্রের হয়, ভাবার চেষ্টা করতাম।
অথচ গেল ১২টি বছর ধরে জুলাই আসলেই মন আমার আনমনা হয়ে পড়ে। আমি ঝিমিয়ে পড়ি। একেবারে নিয়ম করেই পড়ি। যে মাসটি ছিল আমার জন্যে বিশেষ আনন্দের মাস, সে মাসটিই অতীব বেদনার হয়ে গেল। অতীব আশা-আনন্দের মাসটি এমন করে প্রচন্ড বেদনা-বিষাদের হবে কে জানতো! যে মাসে মা আমায় জন্ম দিয়ে দুনিয়ায় আনলেন, সে মাসেই মা আমার চলে গেলেন! আমাকে একেবারেই নিঃস্ব করে দুনিয়া থেকে চির বিদায় নিলেন দুঃখের দরদী আমার জনম দুঃখী মা!!
আইসিইউতে নেবার সময় আমি এমনটা ভাবিনি। ভেবেছিলাম ক’দিন একটু নিবিড় পরিচর্যায় ট্রিটমেন্ট পেলেই মায়ের ফুসফুস সেরে উঠবে। মা আবার স্বাভাবিক হবেন। এন্টিবায়োটিক ঠিকভাবে কাজ করবে। নিউমোনিয়াকে পরাজিত করার ব্যাপারে আমি ছিলাম বেশ আশাবাদী। কিন্তু দিন যতই যাচ্ছিল ফুসফুস ততই নিয়ন্ত্রণহীন হয়ে পড়ছিল। দেখা যাচ্ছিল ডাক্তারদের চোখেমুখে ঘামের রেখা। তারা ক্রমেই আশাহীন হয়ে পড়ছিলেন।
চরম আশাহীনতার খবরটা হাসপাতালের আইসিইউ থেকে আমাকেই সরাসরি কল দিয়ে জানায়। রাত সাড়ে বারোটার মত হবে। মিনিট পনেরও হয়নি মাকে হাসপাতালে দেখে এসেছি। ফ্রেশ হয়ে বাসার ডাইনিংয়ে বসেছি কেবল। প্রথম লোকমা মুখে তুলতে যাবো, অমনি মোবাইলে কল। কলিজাটা ধুক করে উঠলো। ফার্ষ্ট কলেই ধরলাম ফোনটা। অপর প্রান্ত থেকে আইসিইউ ডাক্তার শুধু বললো, সরি স্যার! এক্ষুণি আসা দরকার আপনার!!
বুঝতে আমার বাকী রইলো না কিছু। হাতের লোকমা মুখে না তুলে হাতে নিয়েই ঠাঁয় বসে রইলাম। কিংকর্তব্যবিমূঢ় আমি। বাইলা মাছের ভূনা ছিল প্লেটে। আমার প্রিয় মাছ। একদিন মা নিজেই আমাকে মাছটি খেতে শিখিয়েছেন। ভাতের সাথে মাখানো মাছের লোকমা প্লেটে ফেলেই সোজা হাসপাতাল। আইসিইউতে নিজের হাতে মায়ের চোখ দু’খানা বুজিয়ে দিয়ে তাঁর নিথর দু’পায়ে আমার হাতদু’খানা রেখে বসে পড়লাম। মায়ের পায়ে রাখলাম জীবনের শেষ চুম্বন!
মা আমার ঘুমিয়ে গেলেন চির জীবনের তরে। নিদারুন কষ্ট করে গেলেন যাবার আগের বত্রিশটি মাস। যেদিন ষ্ট্রোক করেন, কেউ বলেনি সেই যাত্রায় বেঁচে যাবেন তিনি। স্কয়ার হাসপাতালের ইন্ডিয়ান ডাক্তারও বলেননি। তারা আশা ছেড়ে দিয়েছিলেন। শুধুমাত্র আল্লাহর রহমতে মা আমার বেঁচে যান। তবে ব্রেইনষ্ট্রোকে শরীরের অর্ধেকাংশ অবশ হয়ে পড়েছিল। বন্ধ হয়েছিল কথা বলার শক্তি। যতদিন বেঁচে ছিলেন, নড়াচড়ার শক্তি ছিল না। কথা বলতে পারতেন না। মুখ দিয়ে কিছু খেতেও পারতেন না।
খেতেন নাক দিয়ে। বত্রিশটা মাস নাকে নল লাগানোই ছিল। এটা দিয়েই যতটুকু সম্ভব খাওয়াতাম। খাবার আর কী? সবই তরল জাতীয়। লক্ষ্য একটাই; শরীরে পুষ্টির যেন ঘাটতি না হয়। মা বুঝতেন না এসবের কিছুই। শুধু তাকিয়ে তাকিয়ে দেখতেন আমাদের। আর তাঁর চোখ বেয়ে গড়াতো অশ্র“বিন্দু। চোখের পলক ফেলতেন খুব কম। আর আমার মুখটা কাছে নিলে তিনি তাঁর মুখ বাড়িয়ে চুমু খেতেন। অবিকল সেই ছোট্ট বেলার চুমু!
এই একটি কাজ তিনি সব সময় করতেন। শেষবারের মত আইসিইউতে যাওয়া পর্যন্ত করেছেন। যখন সুস্থ ছিলেন তখনও করতেন। একটু বেশিই করতেন। আমার বয়স বিবেচনায় নেননি কোনদিন। সব সময় ভাবতেন, আমি ছোট্ট শিশুটিই আছি। হয়ত কোলের সন্তান বলেই এমনটা ভাবতেন। মা বলতেন, কোলের বা কনিষ্ঠ সন্তানের জন্যে মায়া বেশি লাগে। সব মায়েরা কী বলে জানি না। আমার মা বলতেন। একটু বেশি বেশিই বলতেন। আর আমি বিশ্বাসও করতাম। সেই ছোটবেলায় যেমনি করতাম, আজও করি। জনম ভর করছি।
আমি বিশ্বাস করতাম, আমার সামান্য কষ্টেও তিনি অসামান্য কষ্ট পেতেন। আমার কষ্টে মা যেমনি কষ্ট পেতেন আমার চাইতেও বেশি; তেমনি আমার খুশিতে খুশিও হতেন বেশি। দেশে গ্রাজুয়েশনের পর জাপানের বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে যাবার সব প্রস্তুতি যখন সম্পন্ন হলো, মায়ের খুশি দেখে কে! এক এক করে ফোন করে সব আত্মীয়স্বজনকে জানিয়ে দিলেন। তবে আনন্দের খবরের চেয়ে কষ্টের খবরটাই বেশি দিলেন। তাঁর একটাই চিন্তা, নিজহাতে রান্নাবান্না করে একা আমি খাবো কেমন করে! বাঁচবো কেমন করে!!
নিজের বাঁচার চিন্তা করতেন না মা আমার কোনকালেও। এয়ারপোর্টে যাবার সময় জেদ করলেন, সাথে তিনি যাবেনই। অথচ তখনও তাঁর প্রচন্ড মাথা ব্যাথা। ক্রনিক মাইগ্রেনের রোগী তিনি। পেইন কিলারে অভ্যস্ত। নাপা খেয়েছেন একসাথে ১২টা। অথচ মাথা ব্যাথা নিয়েই যাবেন। কোনভাবেই বাঁধা দেয়া গেল না। আমার রেডী হবার আগে তিনি নিজেই রেডী হয়ে বসে আছেন। মুখে পাউডার মেখেছেন। নিজে নিজেই মেখেছেন।
আমার ওঠার আগে গাড়িতেও গিয়ে বসলেন নিজে নিজে। আমাকে তাঁর পাশে বসালেন। মুষলধারের বৃষ্টিতে গাড়ি চলছে এয়ারপোর্টের দিকে। তিনি আমার হাত ধরে বসে আছেন। এবং একটু পর পর গালে চুমু খাচ্ছেন। আর হাত দিয়ে মুছছেন তাঁর চোখ। কোন শব্দ করে নয়; শব্দহীন কান্নায় ভিজিয়ে দিচ্ছেন। বাইরের প্রচন্ড বৃষ্টি গাড়ির ভেতরের আমাকে ভেজাতে না পারলেও মায়ের কান্নায় গাড়ির ভেতরের পরিবেশটাই ভিজে উঠছিল যেন! তখনও মা নিজেকে ধরে রাখতে পেরেছিলেন। কিন্তু যখন এয়ারপোর্টে সিঙ্গাপুর এয়ারলাইন্স চেকইনের সব ফরমালিটিজ শেষে বিদায়ের ক্ষণ এলো, মা এবার এলোমেলো হয়ে গেলেন। আর ধরে রাখতে পারেননি নিজেকে। আমাকে জাপটে ধরে প্রচন্ড জোরে চিৎকার দিয়ে উঠলেন। তাঁর কান্না আর চিৎকারে এয়ারপোর্টের সবাই চমকে উঠলো। তাতে মায়ের কিচ্ছু আসে যায় না। মা চিৎকার করে কেঁদেই চলেছেন। জড়িয়ে ধরে আছেন শক্ত করে আমাকে। কিছুতেই ছাড়বেন না তিনি। আমাকে ছাড়বেনও না; ভেতরেও যেতে দেবেন না।
এমনি এক পরিস্থিতি আমার জীবনে আবারো আসছে। এবার, আমার বিদায়ের পালা নয়। পালা আমার শোনিমের। শোনিম বিদায় নেবে আমাদের কাছ থেকে। ভিন্ন দেশের ইউনিভার্সিটিতে শোনিম পড়তে যাবে আর কয়েকটা দিন পরেই। শোনিম আছে খুবই ফুরফুরা মেজাজে। আছে মহা আনন্দে। সে বড় হয়েছে এবং এখন থেকে একা চলতে পারবে, এই আনন্দেই সে বিভোর।
এদিকে আমরা বিভোর কষ্টে। শোনিম আমাদের ছেড়ে দূরে যাবে, এই কষ্টে এখন থেকেই শোনিমের মা এবং আমার ঘুম হারামের পথে। আমরা ভাবতেই পারছি না শোনিমকে দূরদেশে রেখে থাকবো কেমন করে! অথচ মাকে একা ফেলে একদিন আমি ঠিকই দূরে চলে গিয়েছিলাম। নিজে যেদিন মায়ের কাছ থেকে বিদায় নিয়েছিলাম, সেদিন মায়ের কষ্টটা এর চেয়েও হয়ত তীব্র ছিল। কিন্তু সেদিন বুঝিনি আমি।
বুঝিনি! কেননা তখনও আমি যে শুধু সন্তান ছিলাম। বাবা হইনি। বাবা কী জিনিস বুঝিনি! এখন আমি বাবা হয়েছি। আমার বোঝার সময় হয়েছে। সন্তানের জন্যে বাবামায়ের অনুভূতি, আকুতি আর কষ্টের হাহাকার এখন আমরা দু’জনা পরতে পরতে অনুভব করতে শুরু করেছি। কী দংশনে জ্বলে মরছি সেটা হাঁড়ে হাঁড়ে টের পেতে শুরু করেছি। অথচ সেদিন এমনটা বুঝিনি।
শুধু আমি কেন? কেউ বোঝে না! সন্তানেরা বাবামায়ের প্রকৃত কষ্ট কখনোই অনুভব করার শক্তি রাখে না। কেবল বাবামায়েরা রাখেন। শুধু আমার বাবা নন, আমার মা নন! সব বাবামায়েরাই রাখেন!!! বাবা-মা বাবা এবং মা হন শুধু কষ্ট পাবার জন্যে! কাঁদার জন্যে!! যাবজ্জীবন কাঁদার জন্যে!!!

-লেখকঃ উপদেষ্টা সম্পাদক, যুগবার্তা।