Home মতামত শহীদ ডা. মিলন ও বৈষম্যহীন-অসাম্প্রদায়িক গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার সংগ্রাম

শহীদ ডা. মিলন ও বৈষম্যহীন-অসাম্প্রদায়িক গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার সংগ্রাম

29

সৈয়দ আমিরুজ্জামান |
২৭ নভেম্বর ডা. শামসুল আলম খান মিলনের ৩৩তম শাহাদত দিবস। ১৯৯০ সালের এই দিন বেলা আনুমানিক ১০টা ৩০ মিনিটে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসির সামনে গণগ্রন্থাগারের কোনায় ডা. মিলন গুলিবিদ্ধ হয়ে শহীদ হন। ডা. মিলনের শহীদ হওয়ার সংবাদে তৎকালীন স্বৈরাচারবিরোধী ছাত্র গণআন্দোলনে সংগ্রামরত ৫ দল, ৮ দল ও ৭ দল তথা তিন জোট, সর্বদলীয় ছাত্র ঐক্য, স্কপ, বিএমএসহ সব পেশাজীবী সংগঠন অগ্নিস্ফুলিঙ্গের মতো জ্বলে ওঠে।

জেনারেল এরশাদের দীর্ঘ ৯ বছরের দুর্নীতি আর দুঃশাসনের বিরুদ্ধে সাধারণ মানুষের পুঞ্জীভূত ক্ষোভ সেদিন রাজপথে ফেটে পড়ে। গণঅান্দোলন মহান গণ-অভ্যুত্থানে রূপ নেয়। ফলে এরশাদ সরকার পদত্যাগে বাধ্য হয়। ‘৯১-এর সাধারণ নির্বাচনের মাধ্যমে দেশে নির্বাচিত সরকার প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে গণতন্ত্রের সূচনা হলেও গণমানুষের বহুদিনের কাঙ্ক্ষিত মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় অসাম্প্রদায়িক ও বৈষম্যহীন ব্যবস্থা অর্জিত হয় নি।

প্রতিবছর এই দিনে ডা. মিলন সম্বন্ধে কিছু না কিছু লিখতে হয়। মিলনের বিষয়ে লিখতে হলে প্রাসঙ্গিকভাবেই ডা. মিলনের বিদ্যমান শোষণমূলক অার্থ-সামাজিক ব্যবস্থার অামূল পরিবর্তনের প্রগতিশীল রাজনৈতিক চেতনা ও জীবনাদর্শ প্রসঙ্গ চলে আসে। কিশোর বয়স থেকেই ডা. মিলন ছিলেন সমাজসচেতন, স্বাধীন ব্যক্তিত্বসম্পন্ন দৃঢ় চরিত্রের একজন সংগ্রামী মানুষ। ১৯৬৯ আর ১৯৭১-এর আন্দোলনমুখর আগুন ঝরানো দিনগুলোর ছোঁয়া মিলনকে স্বদেশের প্রতি বিশ্বস্ত সমাজ পরিবর্তন অাকাঙ্ক্ষী একজন বিপ্লবী দেশপ্রেমী করে তুলেছিল। কৈশোর থেকে ক্রমেই নিজেকে উন্নীত করেছিলেন দেশের প্রতি প্রতিশ্রুতিবদ্ধ পরিবর্তন প্রত্যাশী একজন সংগ্রামী যুবকরূপে। এরপর তার অামূল পরিবর্তন অভিমুখী প্রগতিশীল রাজনৈতিক চেতনার উন্মেষ ঘটতে দেখা যায়।

১৯৮২ সালে জেনারেল এরশাদ ক্ষমতা দখলের পর যতগুলো রাজনৈতিক আন্দোলন-সংগ্রাম হয়েছিল, তার প্রতিটিতেই মিলনের অংশগ্রহণ ছিল অবধারিত। ১৯৮২ সালে মজিদ খান শিক্ষা কমিশনের বিরুদ্ধে ছাত্র আন্দোলন, ১৯৮৪ সালে সামরিক শাসনের অবসান ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের দাবিতে ছাত্র গণ-আন্দোলন, ১৯৮৬ ও ৮৭-র আন্দোলন নিয়ে মিলন ডায়েরিতে লিখেছিলেন, ‘মুক্তিপাগল মানুষের স্রোত নেমেছে রাজপথে। সেই স্রোত ব্যর্থ হয় ষড়যন্ত্রের নীলনকশায়। ১৯৮৭-তেও ব্যর্থ হয় লাগাতার হরতাল। নূর হোসেনের আত্মদান ব্যর্থ হয়ে যায়। ওই মিছিলে দেখেছি রাজনীতির মুখোশ পরা কিছু মানুষ।’ সেই মিছিল থেকে ডা. মিলন বাসায় ফিরেছিলেন পিঠে পুলিশের লাঠিপেটার চিহ্ন নিয়ে।

কী ছিল মজিদ খানের শিক্ষানীতিতে?

১৯৮২ সালে হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ সরকারের শাসনামলে সামরিক সরকারের শিক্ষা উপদেষ্টা ছিলেন ড. আবদুল মজিদ খান। সে বছরের ২৩ সেপ্টেম্বর তার নেতৃত্বে ‘মজিদ খান শিক্ষা নীতির’ প্রস্তাব দেওয়া হয়। এ নীতিতে প্রথম শ্রেণি থেকে বাংলার সঙ্গে আরবি এবং দ্বিতীয় শ্রেণী থেকে ইংরেজী অর্থাৎ প্রাথমিক বিদ্যালয়েই ৩টি ভাষা বাধ্যতামূলক করার কথা বলা হয়। এ ছাড়া, যারা ৫০ শতাংশ ব্যয় বহন করতে পারবে, পরীক্ষার ফল খারাপ হলেও তাদের উচ্চশিক্ষার সুযোগ দেওয়ার কথা বলা হয় এতে। নিম্ন মাধ্যমিক ও মাধ্যমিক কোর্স করা হয় ১২ বছর।

যেভাবে আন্দোলনের সূচনা

১৯৮২ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর শিক্ষা দিবসে ছাত্রসমাজ এই শিক্ষানীতিকে গণবিরোধী ও সাম্প্রদায়িক শিক্ষানীতি আখ্যা দিয়ে ৩ দফা দাবিতে আন্দোলন চালানোর ঘোষণা দেয়। এই ৩ দফা দাবির মধ্যে ছিল মজিদ খানের গণবিরোধী শিক্ষানীতি বাতিল, সব ছাত্র ও রাজবন্দীকে নিঃশর্ত মুক্তিদান এবং সামরিক শাসন প্রত্যাহার করে গণতান্ত্রিক অধিকার পুনপ্রতিষ্ঠা করা।

বিদ্যমান শোষণমূলক অার্থ-সামাজিক ব্যবস্থার অামূল পরিবর্তনের প্রগতিশীল দৃষ্টিভঙ্গি ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বুকে লালন করে মিলন জাতীয় রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত হয়েছিলেন। স্বপ্ন দেখেছেন, বাংলাদেশ হবে সমাজতান্ত্রিক, গণতান্ত্রিক প্রগতিশীল সমাজব্যবস্থায় বিশ্বাসী একটি রাষ্ট্র, যেখানে শ্রেণিবৈষম্য থাকবে না, বুর্জোয়া সমাজব্যবস্থার আমূল পরিবর্তন ঘটবে। তাই জাতীয় রাজনীতির পাশাপাশি চিকিৎসকদের পেশাগত আন্দোলনেও সম্পৃক্ত হয়ে পড়েন। তাই তো এরশাদ সরকার প্রণীত গণবিরোধী স্বাস্থ্যনীতির বিরুদ্ধাচরণ করে আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন। এ সময় ডায়েরিতে লিখেছিলেন, ‘স্বাস্থ্য ব্যবস্থার মতো একটি মৌলিক ইস্যুকে কিছুতেই গণবিরোধী সরকারের খেয়াল-খুশির ওপর ছেড়ে দেওয়া যায় না।’ দুঃখজনক হলেও সত্য, দীর্ঘ ৩৩ বছর নির্বাচিত সরকারের অধীনে দেশ পরিচালিত হলেও আজও জনগণের কাঙ্ক্ষিত মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় অসাম্প্রদায়িক ও বৈষম্যহীন ব্যবস্থা অর্জন করা সম্ভব হয়নি।

বারবার গণ প্রত্যাশা নির্বাসিত হয়েছে সেনাশাসকদের ক্ষমতা কুক্ষিগত করার কারণে। সাধারণ মানুষের মৌলিক অধিকারগুলো ভূলুণ্ঠিত হয়েছে পদে পদে। বারবার আমাদের টগবগে তরুণ সন্তানেরা জীবন বাজি রেখে স্বৈরশাসকের পতন ঘটিয়েছে গণমানুষের অর্থনৈতিক মুক্তির জন্য, মৌলিক অধিকারগুলো প্রতিষ্ঠিত করার জন্য। আমাদের সন্তানদের রক্তস্রোতে অর্জিত জাতীয় অর্জনগুলো আজও ভূলুণ্ঠিত। বারবার আশাহত সাধারণ মানুষ বিদ্যমান ব্যবস্থার প্রতি। তবে শহীদ মিলনের প্রগতিশীল দৃষ্টিভঙ্গিতে তরুণদের পরিবর্তনের রাজনীতিতে ফিরে অাসতে হবে।

দেশ এখনো বহুমুখী সমস্যায় নিমজ্জিত। পেঁয়াজসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় খাদ্যদ্রব্যের ঊর্ধ্বগতিতে মধ্যবিত্ত ও নিম্নবিত্ত—এই দুই শ্রেণির মানুষ দিশেহারা হয়ে। কিছু অসৎ ব্যবসায়ী সিন্ডিকেটের মাধ্যমে দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি করায় সাধারণ মানুষের জীবনে দুর্ভোগ নেমে এসেছে। দেশবাসী যেন ব্যবসায়ীদের হাতে একপ্রকার জিম্মি। প্রশাসনিক কোনো আইন বা নিয়ম এদের বিচলিত করে না। দেশে একটা শ্রেণির কাছে ক্ষমতার লোভ, অর্থের লোভ মানুষের জীবনের চেয়েও বড় বলে মনে হয়। সুবচনও যেন নির্বাসিত। বিচারপতি মুহাম্মদ হাবিবুর রহমান তাঁর মৃত্যুর আগে এক নিবন্ধে লিখেছিলেন, ‘দেশ আজ বাজিকরের দেশে পরিণত হয়েছে।’ গুম, খুন, নারী ধর্ষণ নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনায় দাঁড়িয়েছে। বিজ্ঞজনদের মতে, প্রশাসনিক দুর্বলতার কারণে এই ঘটনাগুলো ঘটা সম্ভব হচ্ছে। সাম্প্রতিক কালের রোহিঙ্গা ইস্যু ‘গোদের ওপর বিষফোড়ার’ মতো জাতির ওপর চেপে বসেছে।

এত সমস্যার পরও বাংলাদেশ আজ বিভিন্ন সূচকে অগ্রগতিসহ মাথাপিছু অায় ২৮২৪ ডলার। ইতোমধ্যে বিশ্বদরবারে নিম্ন-মধ্যম আয়ের দেশ হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করেছে। কিন্তু বিশাল বৈষম্যের কারণে দেশের এই সম্মান ততটা উচ্চতায় পৌঁছাতে পারেনি। আমরা জানি গণতন্ত্র মানে শুধুমাত্র ভোটাধিকার নয়। গণতন্ত্রের অর্থ অনেক ব্যাপক, যা সমাজকে অর্থনৈতিক, সামাজিক ও রাজনৈতিকভাবে অনেক ঋদ্ধ করে। বৈষম্যের কারণে আজ দেশে সামাজিক ন্যায্যতা ও সমতা অনুপস্থিত। দুর্নীতিতে আকণ্ঠ ডুবে গেছে দেশ।

২০২৪ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে ঘিরে রাজনৈতিক অঙ্গনে নতুন এক প্রস্তুতির আভাস পাওয়া যাচ্ছে। সাধারণ মানুষের মনেও এই বিষয়ে ঔৎসুক্যের শেষ নেই। আগামী নির্বাচন হবে জনগণের প্রত্যাশা পূরণের নির্বাচন। সমাজের সৎ, বিবেকবান, নৈতিকতাবোধসম্পন্ন যোগ্য মানুষ আগামী নির্বাচনে নির্বাচিত হয়ে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বৈষম্য ও দুর্নীতিবিহীন একটি সমতার শাসনব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত করবে, এটাই জাতির স্বপ্ন। জনজীবনে সার্বিক নিরাপত্তা ফিরে আসুক, এটাই দেশবাসীর কাম্য।
শহীদদের রক্তের বিনিময়ে অর্জিত এই মাতৃভূমি সম্ভাবনার এক অপার দুয়ার খুলে দিয়েছে আমাদের সম্মুখে। অনেকের মতে, আজকের যুবসমাজের মধ্যে মূল্যবোধের অবক্ষয় ঘটেছে। যুবসমাজ আজ লক্ষ্যভ্রষ্ট, দিগ্ভ্রান্ত। অথচ ভাষা আন্দোলন, স্বাধীনতা আন্দোলন, গণতান্ত্রিক আন্দোলন—সব কটি জাতীয় আন্দোলনের পুরোধায় ছিল ছাত্রসমাজ, যুবসমাজ। আমাদের রাষ্ট্রীয় যা কিছু অর্জন, তা এই তরুণদের রক্তের বিনিময়ে অর্জিত হয়েছে, এ কথা আমরা ভুলে যেতে পারি না।

প্রিয় মাতৃভূমি আজ বিপর্যস্ত। এই মাতৃভূমিকে পরবর্তী প্রজন্মের জন্য বাসযোগ্য করে যেতে হবে আমাদের। নবীন-প্রবীণ সব সচেতন বিবেকবান মানুষের মিলিত স্রোতোধারায় এগিয়ে নিয়ে যেতে হবে এ দেশ। তরুণদের উদ্দেশে বলব, ‘এ দেশ তোমার-আমার সবার। ক্ষোভে, অভিমানে মুখ ফিরিয়ে থেকে নিজেকে গুটিয়ে রাখা সঠিক না।’ এখন ‘যৌবন যার, যুদ্ধে যাওয়ার সময় তার’। মনে রাখতে হবে, শহীদদের স্বপ্ন সার্থক করার দায় আমাদের সবার। গণমানুষের বহুদিনের কাঙ্ক্ষিত প্রত্যাশার জন্য মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বৈষম্যহীন ও অসাম্প্রদায়িক ব্যবস্থার সংগ্রাম জারি রাখা জরুরি।

-লেখক: মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক গবেষক, সাংবাদিক ও কলামিস্ট।