Home জাতীয় লাশ দিতেও পুলিশের শর্ত, চেয়েছিল চাঁদাও

লাশ দিতেও পুলিশের শর্ত, চেয়েছিল চাঁদাও

52

হাতিরঝিল থানায় যুবকের মৃত্যু

ডেস্ক রিপোর্ট: রাজধানীর হাতিরঝিল থানা হেফাজতে মারা যাওয়া যুবকের লাশ পরিবারের কাছে হস্তান্তরেও শর্ত দিয়েছে পুলিশ। শর্ত মানতে পরিবার রাজি না হওয়ায় মর্গে পড়ে আছে লাশ। পরিবারের অভিযোগ, ৫ লাখ টাকা চাঁদা চেয়েছিল পুলিশ। দিতে না পারায় তাকে পিটিয়ে হত্যা করা হয়েছে। এমনকি মারা যাওয়া যুবক সুমন শেখ রুম্মনের মৃত্যুর খবরও গোপন করেছিল পুলিশ। আদালতে পাঠানো পুলিশের প্রতিবেদনে পরিবার মৃত্যুর খবর জেনেছে। লাশের ময়নাতদন্তে শরীরে একাধিক আঘাতের চিহ্ন পাওয়া গেছে। ময়নাতদন্তকারী চিকিৎসক ডা. মাইন উদ্দিন জানিয়েছেন, ‘সুরতহাল রিপোর্টে লাশের মুখের মধ্যে এক ধরনের পলিথিনের অস্তিত্বের কথা বলা হয়েছে। কিন্তু ময়নাতদন্তের সময় তিনি সেই পলিথিন পাননি।’

থানা হেফাজতে মারা যাওয়া যুবক রুম্মনের স্ত্রী জান্নাত আক্তার জানিয়েছেন, শনিবার দুপুরে থানাহাজত থেকে সুমনের মরদেহ ময়নাতদন্তের জন্য শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিক্যাল কলেজের মর্গে পাঠানো হয়। লাশ বুঝে পেতে পরিবার গতকাল রবিবার সোহরাওয়ার্দী মেডিক্যাল কলেজের মর্গে গিয়েছিল। কিন্তু তারা পুলিশি শর্তের কারণে লাশ বুঝে পাননি। তিনি বলেন, ‘আমরা লাশ বুঝে পেতে মর্গে গিয়েছিলাম। কিন্তু লাশ আমাদের বুঝিয়ে দেওয়া হয়নি। হাতিরঝিল থানা-পুলিশের এক এসআই আমাদের বলেছেন, গ্রামের বাড়ি নবাবগঞ্জে নেওয়া হলে লাশ দেওয়া হবে। আর যদি বর্তমান বসবাসস্থান ঢাকার রামপুরায় নেওয়া হয়, তাহলে লাশ দেওয়া হবে না। লাশ আমরা কোথায় নিয়ে যাব, কোথায় দাফন করব, সেটাও কি পুলিশকে বলতে হবে?’

জান্নাত আক্তার বলেন, ‘আমার স্বামী এভাবে মারা গেল। এখন তার লাশও বুঝে পাচ্ছি না।’ অভিযোগের বিষয়ে জানতে হাতিরঝিল থানার ওসির সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করেও তাকে পাওয়া যায়নি। তার মোবাইল নম্বরটি বন্ধ পাওয়া যায়। তেজগাঁও বিভাগের উপকমিশনার আজিমুল হকও গতকাল ফোন রিসিভ করেননি। তবে পুলিশের অন্য একটি সূত্র জানিয়েছে, লাশের বৈধ উত্তরাধিকার গেলে বুঝিয়ে দেওয়া হবে। জান্নাত আক্তার জানান, তারা এ ঘটনায় জড়িত পুলিশের বিরুদ্ধে মামলা করবেন। রবিবার তারা ঢাকার আদালতে গিয়েছিলেন। কিন্তু কাগজপত্র গোছানোর কারণে রবিবার মামলা করতে পারেননি। দুই-এক দিনের মধ্যে মামলা করবেন। এই মৃত্যুকে তারা হত্যাকাণ্ডই মনে করছেন।

রুম্মনের পরিবার জানিয়েছে, সুমনকে ধরার পর পুলিশ তাদের কাছে ৫ লাখ টাকা দাবি করে। টাকা না দেওয়ায় পুলিশ তাকে পিটিয়ে মেরে ফেলেছে। রুম্মন রামপুরায় ইউনিলিভারের পানি বিশুদ্ধকরণ যন্ত্র পিওরইটের বিপণন অফিসে ছয় বছর ধরে কাজ করছেন। মাসে ১২ হাজার টাকা বেতন পেতেন। গত শুক্রবার রাতে সেখান থেকে পুলিশ তাকে মারতে মারতে থানায় নিয়ে যায়। পিওরইটের একটি চুরির মামলায় গ্রেফতার তিন আসামির দেওয়া তথ্যের ভিত্তিতে তাকে গ্রেফতার করা হয়। তার কাছ থেকে ৩ লাখ টাকাও উদ্ধার হয়েছে।

মৃত্যুর তথ্য গোপন
চুরির মামলায় গ্রেফতারের পরদিন শনিবার সাড়ে ১০টার দিকে হাতিরঝিল থানা হেফাজতে থাকা রুম্মনের জন্য সকালের নাস্তায় পরোটা, ডিম ও আধা লিটার কোমলপানীয় নিয়ে যান তার সম্বন্ধী (স্ত্রীর বড় ভাই) মোশাররফ হোসেন ও শাশুড়ি। মোশাররফ হোসেন বলেন, ‘শনিবার সকাল সাড়ে ১০টা/১১টার দিকে আমার মাকে সঙ্গে নিয়ে থানায় যাই রুম্মনের সঙ্গে দেখা করতে ও নাস্তা দিতে। মা নাস্তা নিয়ে থানায় ঢুকতে গেলে পুলিশ বাধা দেয়। এরপর দায়িত্বে থাকা জাফর উদ্দিন আলম নামের একজন কনস্টেবলের হাতে নাস্তা দেওয়া হয় এবং নাস্তা পৌঁছে দেওয়ার জন্য কনস্টেবলকে ১০০ টাকাও দেওয়া হয়। কনস্টেবল জানান, ওপর থেকে নিষেধ, ভেতরে ঢোকা যাবে না।’ তিনি বলেন, ‘থানায় ঢুকতে না দিয়ে কনস্টেবল জানান, আসামিকে থানা থেকে দুপুর সাড়ে ১২টার সময় আদালতে পাঠানো হবে। আপনারা আদালতে গিয়ে উকিল ধরেন। এরপর থানা থেকে বেরিয়ে মাকে বাসায় পাঠিয়ে আমি ও আমার বোন আদালতে যাই। আদালতে গিয়ে শুনি, সেখানে রিপোর্ট এসেছে, থানার ভেতরে রুম্মন আত্মহত্যা করে মারা গেছেন।’

সিসিটিভি ফুটেজে আত্মহত্যার দৃশ্য দেখেনি পরিবার
পুলিশ বলছে, শুক্রবার রাত ৩টা ৩২ মিনিটে রুম্মন তার পরনের ট্রাউজারের রশি দিয়ে লোহার গ্রিলের সঙ্গে গলায় ফাঁস দেন, যা সিসিটিভি ফুটেজে দেখা গেছে। এ ফুটেজ নিহতের স্ত্রীসহ স্বজনদেরও দেখানো হয়েছে। তবে রুম্মন আত্মহত্যা করলে ঝুলে থাকার দৃশ্য সিসিটিভি ফুটেজে দেখেননি বলেও দাবি পরিবারের। মোশাররফ হোসেন বলেন, ‘ফুটেজে দেখা গেছে পরনে থাকা ট্রাউজার প্যান্ট খুলে ফেলছে (রুম্মন)। শুধু আন্ডারওয়্যার পরা ছিল। এরপর সে দেওয়াল ধরে ওপরে ওঠে। আবার নিজেই নিচে নেমে আসে। সে যদি ফাঁস দিয়ে আত্মহত্যাই করে তাহলে ঝুলে থাকার কথা। সিসিটিভি ফুটেজে ঝুলে থাকার দৃশ্য থাকার কথা। কিন্তু ফুটেজে তার ঝুলে থাকার কোনো দৃশ্য দেখা যায়নি। এমনকি ঝুলে থাকলে কোন পুলিশ তাকে নিচে নামাল সেই দৃশ্যও দেখাতে পারেনি পুলিশ। এরপর সিসিটিভি ফুটেজের ভিডিও বন্ধ করে দিয়ে পুলিশ আমাদের বাইরে যেতে বলে।’

মোশাররফ হোসেন আরো বলেন, ‘রুম্মনকে মিথ্যা অভিযোগ দিয়ে মেরে ফেলা হয়েছে, আমরা এর সুষ্ঠু বিচার চাই।’ রুম্মনের স্ত্রী জান্নাত বলেন, ‘দেশে বিচার আছে। সে চুরি করলে তার বিচার হবে। থানা হেফাজতে তাকে হত্যা করা হলো কেন? ইউনিলিভারের পিওরইট ও পুলিশ আমার স্বামীকে হত্যা করেছে। তার কাছে পুলিশ ৫ লাখ টাকা দাবি করে থানা থেকে। পুলিশকে টাকা না দেওয়ায় আমার স্বামীকে হত্যা করা হয়েছে।’ পিওরইট কতৃ‌র্পক্ষ রুম্মনের বিরুদ্ধে যে ৫৩ লাখ টাকা চুরির অভিযোগ তুলেছে সেখানেও সন্দেহ পরিবারের। পিওরইটের কর্মকর্তাদের কেউ এই টাকা সরিয়ে রুম্মনের ওপর দায় চাপাচ্ছে। এমনকি পুলিশও তাদের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে। পরিবার বলছে, টাকার অঙ্ক তো কম নয়, মিলেমিশেই তারা এটা করেছে।

লাশের ময়নাতদন্ত ও কিছু প্রশ্ন
রুম্মনের লাশের ময়নাতদন্ত করেছেন সোহরাওয়াদী‌র্ হাসপাতালের চিকিৎসক ডা. মাইন উদ্দিন। তিনি বলেন, ‘ট্রাউজারের রশি দিয়ে ঝুলে থাকার আলামত ময়নাতদন্তে মিলেছে। এর কারণে তার মুখ হা করা ছিল। কিন্তু সুরতহাল রিপোর্টে মুখে এক ধরনের পলিথিন থাকার কথা বলা হয়েছে। আমরা লাশের মুখে সেটা পাইনি। এটা খুব জরুরি ছিল। এটা পেলে মৃত্যুর কারণ জানতে সহজ হতো। তবে লাশের শরীরে একাধিক আঘাতের চিহ্ন আমরা পেয়েছি। তবে ঐ আঘাতের কারণে তার মৃত্যু হয়নি।’

এদিকে এ ঘটনায় দুই পুলিশ সদস্যকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে। বরখাস্ত পুলিশ সদস্যরা হলেন, হাতিরঝিল থানার ডিউটি অফিসার এসআই হেমায়েত হোসেন ও কনস্টেবল মো. জাকারিয়া। এছাড়া তেজগাঁও শিল্পাঞ্চল জোনের অতিরিক্ত উপ-পুলিশ কমিশনার (এডিসি) হাফিজ আল ফারুককে প্রধান করে তিন সদস্যের একটি কমিটি গঠন করেছে পুলিশ।

পুলিশের দাবি
‘গত ১৫ আগস্ট ইউনিলিভারের পিওরইট থেকে ৫৩ লাখ টাকা চুরি হয়। এ ঘটনায় মামলার পর তিন জনকে গ্রেফতার করে হাতিরঝিল থানা পুলিশ। গ্রেফতার তিন জন হলেন, আল আমিন, সোহেল রানা ও অনিক হোসেন। তারা এখন কারাগারে আছেন। ঐ তিন জনকে জিজ্ঞাসাবাদ ও চুরির ঘটনায় সিসিটিভি ফুটেজ বিশ্লেষণ করে রুম্মনকে শনাক্ত করা হয়। এরপর শুক্রবার রামপুরা মহানগর এলাকার বাসা থেকে তাকে গ্রেফতার করে পুলিশ। তার বাসা থেকে ৩ লাখ ১৩ হাজার ৭০০ টাকা উদ্ধার করা হয়।
ইত্তেফাক