Home মতামত লাল গোলাপ নাকি রক্তস্নাত ইতিহাস

লাল গোলাপ নাকি রক্তস্নাত ইতিহাস

74

এম এইচ নাহিদ: আজ ১৪ ফেব্রুয়ারি। বিশ্ব ভালোবাসা দিবস। ভালোবাসার লাল গোলাপে তরুণ-তরুণীর আনন্দে বুঁদ থাকার দিন। কিন্তু প্রশ্ন হলো-আজ কি সত্যি’ই ভালোবাসা দিবস! নাকি পাশ্চাত্য সংস্কৃতির তথাকথিত ভালোবাসা দিবসের আঁড়ালে রক্তরাঙা ফাগুনের ঐতিহাসিক মধ্য ফেব্রুয়ারির ইতিহাস ভুলানোর ষড়যন্ত্র!
’৮৩-র এই ১৪ ফেব্রুয়ারি’র আন্দোলন গণতন্ত্র মুক্তির লড়াইয়ের রক্তস্নাত স্মারক। মধ্য ফেব্রুয়ারি রাজপথের রক্তপ্রবাহ স্বৈরাচারবিরোধী ঘৃণার শিহরণ। ছাত্রজনতার স্পর্ধিত স্পন্দন। সেদিনের মিছিলের আওয়াজ স্বৈরশাসকের ক্ষমতার মসনদ কাঁপিয়েছিল। এ আন্দোলন কেবল কুখ্যাত মজিদ কমিশনের গণবিরোধী শিক্ষানীতির বিরুদ্ধে নয়, পরবর্তীকালে তা স্বৈরাচারবিরোধী গণআন্দোলনে রূপ নিয়েছিল। জাফর, জয়নাল, দিপালী সাহা, আয়ুব, কাঞ্চনের রক্তরাঙা পথে সেলিম, দেলোয়ার, তাজুল, রাউফুন, বসুনিয়া, শাহজাহান সিরাজ, নুর হোসেন, জেহাদ আর ডা. মিলন সহ অসংখ্য শহীদের রক্তগঙ্গার মধ্য দিয়েই ’৯০-র ৬ ডিসেম্বর বিশ্ব বেহায়া সামরিক স্বৈরশাসক শাসক এরশাদের পতন ঘটেছিল। সূচিত হয়েছিল গণতন্ত্র মুক্তির পথ।
তাই তো মধ্যফেব্রুয়ারিকে শাসকগোষ্ঠীর এত ভয়! তারুণ্যের প্রতিবাদের ভাষা স্তব্ধ করতেই পুঁজিবাদের খপ্পরে পড়া শাসকচক্র ও তাদের দালাল এরশাদের প্রিয়ভাজন শফিক রেহমান এনেছিল পশ্চিমা সংস্কৃতির তথাকথিত বিশ^ ভালোবাসা দিবস। ‘কর্পোরেট পুঁজির মুনাফা লুটের হাতিয়ার’-এ ভালোবাসা দিবস ভুলিয়ে দিতে চায় আগুন রাঙা ফাগুনের রক্তস্নাত মধ্য ফেব্রুয়ারির ইতিহাসকে। নতুন প্রজন্মের চিন্তা ও মনন থেকে মুছে দিতে চায় প্রতিবাদে গর্জে ওঠার ভাষা। যা আজ অনেকটা বিস্মৃতির আড়ালে যাচ্ছে। কিন্তু ওরা জানে না বাঙালি যেমন ভালো বাসতে জানে, তেমনি লড়াইয়ের প্রয়োজনে প্রিয়জনের হাত ধরেই মিছিলে পা মিলিয়ে রক্ত দিতেও দ্বিধা করেন না।
’৮২-র ২৪ মার্চ ক্ষমতা দখল করেই এরশাদ ক্ষমতাকে আঁকড়ে থাকতে ধর্মকে ঢাল হিসেবে ব্যবহার করেন। একুশের বিভিন্ন অনুষ্ঠান ইসলাম পরিপন্থী বলে ঘোষণা দেন। আল্পনা অংকনের ওপর জারি করা হয় নিষেধাজ্ঞা। জাতির প্রতিবাদের ভাষা স্তব্ধ করতে প্রথমেই শিক্ষায় আঘাত হানে। মেতে উঠে ‘শিক্ষা’ ধ্বংসের চক্রান্তে। শিক্ষার্থীদের দাবি ছিল একটি অবৈতনিক, সার্বজনীন, বৈষম্যহীন, বিজ্ঞানভিত্তিক একমুখী শিক্ষাব্যবস্থা। কিন্তু কিন্তু এরশাদের ‘মজিদ কমিশনের’ প্রস্তাবিত গণবিরোধী শিক্ষানীতিতে বাণিজ্যিকীকরণ আর সাম্প্রদায়িকতার অনুপ্রবেশ ঘটেছিল। বলা হয়েছিল উচ্চ শিক্ষার সুযোগ কেবল তারাই পাবে, যারা শিক্ষা ব্যয়ের শতকরা ৫০ ভাগ ব্যয় করতে পারবে। গণবিরোধী সেই শিক্ষানীতিকে শরীফ খানের শিক্ষা কমিশনের নব্য সংস্করণ অ্যাখ্যা দিয়ে তার বিরুদ্ধে ফুঁসে উঠেন ছাত্র সমাজ। মধুর ক্যান্টিনে গঠিত হয় সর্বদলীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ।
পূর্ব ঘোষিত কর্মসূচী অনুযায়ী ’৮৩-র ১৪ ফেব্রুয়ারি সকালে ঢাকা বিশি^বিদ্যালয়ের বটতলায় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের আহ্বানে হাজার হাজার ছাত্রছাত্রী জমায়েত হয়ে মজিদ খানের শিক্ষানীতি প্রত্যাহার ও রাজবন্দীদের মুক্তির দাবিতে শিক্ষাভবন অভিমুখে যাত্রা শুরু করে। মিছিল বাংলা একাডেমি পার হতেই পুলিশ হিংস্রতার নগ্নমূর্তি ধারণ করে টিয়ারশেল নিক্ষেপ ও গুলিবর্ষণ করে। মিছিলের উপর ট্রাক উঠিয়ে দেয়। পেটুয়া বাহিনীর উন্মত্ততায় গুলিবর্ষণে একে একে লুটিয়ে পড়েন জাফর, জয়নাল, দিপালীসহ অসংখ্য তাজা প্রাণ। রক্তরঞ্জিত হয় রাজপথ। পুলিশ অনেক লাশ গুম করে ফেলে। পুলিশের নির্মম নির্যাতনের হাত থেকে রক্ষা পাননি শিশু একাডেমির অনুষ্ঠানে থাকা নিষ্পাপ শিশুরাও। সেখানেও তারা বর্বর হামলা চালায়। অসংখ্য শিক্ষার্থী গুরুতর আহত হন। রঙিন পানি ছিটিয়ে চিহ্নিত করে শত শত ছাত্র ছাত্রীকে গ্রেপ্তার করা হয়। অনির্দিষ্ট কালের জন্য বন্ধ করা হয় ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়। কারফিউ জারি করা হয় সারা দেশে। ছাত্র হত্যার বর্বরোচিত তান্ডবের খবর সারাদেশে ছড়িয়ে পড়লে আরো তীব্র ক্ষোভে রাস্তায় নামেন হাজার হাজার সাধারণ মানুষও। ১৫ ফেব্রুয়ারি দেশজুড়ে হরতালেও পুলিশের গুলিতে নিহত হন জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র আইয়ুব, চট্টগ্রামে শহীদ হন কাঞ্চন নামে এক ছাত্র। অনেক শিক্ষার্থীকে গ্রেপ্তার করে জেলে পাঠানো হয়। কিন্তু লড়াই থামে নি, বরং তা আরো তীব্র হয়। অবশেষে ১৭ ফেব্রুয়ারি স্বৈরাচারী এরশাদ বাধ্য হয়ে ঘোষণা দেন, “জনগণের রায় ছাড়া শিক্ষা সম্পর্কে চ‚ড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেয়া হবে না।”
মূলত ’৮৩-র মধ্য ফেব্রুয়ারি’র ছাত্র আন্দোলন পরবর্তীতে সামরিক শাসন বিরোধী গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জাতীয় দাবিতে পরিণত হয়। জাতীয় রাজনৈতিক দলগুলোও বিভিন্ন জোটের ব্যানারে ঐক্যবদ্ধ হয়। সকল শ্রেণিপেশার মানুষের সম্মিলিত লড়াইয়ে বেসামাল হয়ে পড়েন এরশাদ। তীব্র গণআন্দোলনের মুখে ’৯০-র ৬ ডিসেম্বর ক্ষমতা ছাড়তে বাধ্য হন। তাই মধ্য ফেব্রুয়ারির সেই লড়াইয়ের ইতিহাস গণতন্ত্র মুক্তির স্মারক।
কিন্তু শাসকগোষ্ঠীর অপচেষ্টা আর কর্পোরেট হাউসের বাণিজ্যিক মহোৎসবে রক্তে লেখা সেই দিনকে ছাত্রসমাজ আজ প্রায় ভুলতে বসেছে। কৌশলে ভুলানো হচ্ছে। গৌরবজনক এ ইতিহাসকে মুছে ফেলার জন্য তাদের পা-চাটা সাংবাদিক শফিক রেহমানের মাধ্যমে ১৪ ফেব্রুয়ারি তথাকথিত ‘ভালোবাসা দিবসের’ আবির্ভাব ঘটে। সেই তথাকথিত ভালোবাসা দিবসে এদিন বুঁদ হয়ে থাকেন তরুণ প্রজন্ম। অথচ স্বৈরাচারবিরোধী ছাত্রআন্দোলনের অগ্নিগর্ভ থেকে রচিত ঐতিহাসিক দশ দফায় আলোকে তৈরি শিক্ষা আজো অধরা। পূর্ণ গণতন্ত্রও অধরা।
তবে ভালোবাসা দিবসের আঁড়ালে নতুন প্রজন্মকে যতই দমিয়ে রাখার চেষ্টা করা হোক, ইতিহাসের সংগ্রামী চেতনা হারায় না। হারাবে না। ভালোবাসার আগুন রাঙা কোনো এক ফাগুনে আবার জাগবে তারুণ্য।-লেখক: সাংবাদিক ও সাবেক ছাত্রনেতা।