Home জাতীয় যেসব কারণে দেশের বড় অংশজুড়ে মরুভূমির মতো আবহাওয়া

যেসব কারণে দেশের বড় অংশজুড়ে মরুভূমির মতো আবহাওয়া

30

ডেস্ক রিপোর্ট: রংপুর বিভাগ ছাড়া দেশের প্রায় সব কটি জেলায় গরমে জীবন ওষ্ঠাগত। আটটি জেলায় চলছে তীব্র দাবদাহ। রাজধানী ঢাকাসহ দেশের বড় শহরগুলোতেও বায়ুদূষণ আর গরমে বিপর্যস্ত জনজীবন। এ আবহাওয়া যেন মরুভূমির মতোই—দিনে প্রচণ্ড গরম ও রাতে হালকা ঠান্ডা। কোথাও কোথাও ভোরের দিকে হালকা কুয়াশাও দেখা যাচ্ছে।

মরুভূমিপ্রধান দেশগুলোতে দিনের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ৪০ থেকে ৪৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস পর্যন্ত ওঠে। সেখানে আজ দেশের আটটি জেলায় সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ৪০ ডিগ্রি সেলসিয়াসের ওপরে উঠেছে।
চার দিন ধরে হঠাৎ দেশজুড়ে মরুভূমির মতো তাপমাত্রা কেন দেখা যাচ্ছে, নাতিশীতোষ্ণ আবহাওয়ার এই দেশে গ্রীষ্ম আসার আগেই তীব্র গরম লাগার কারণ কী, আর এ ধরনের আবহাওয়া কি বাংলাদেশে গ্রীষ্মকালের জন্য স্বাভাবিক হয়ে গেল—এসব প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে দেশের শীর্ষস্থানীয় আবহাওয়াবিদদের সঙ্গে কথা বলেছে প্রথম আলো। মতামত নেওয়া হয়েছে আবহাওয়া নিয়ে গবেষণা করেন—এমন আন্তর্জাতিক ও দেশি সংস্থাগুলোর গবেষকদেরও।
এর তিনটি কারণ চিহ্নিত করেছেন আবহাওয়া বিশেষজ্ঞরা। প্রথমত, যেসব এলাকায় দিনে বেশি গরম এবং রাতে তাপমাত্রা কমছে, সেসব এলাকায় জলাভূমি ও গাছপালা কমে যাচ্ছে। দ্বিতীয়ত, বায়ুদূষণের কারণে স্থানীয় তাপমাত্রা বেড়ে যাচ্ছে। তৃতীয়ত, বৈশ্বিক আবহাওয়ার নানা ধরনের পরিবর্তন ঘটছে, যা বঙ্গোপসাগর থেকে আসা মেঘমালা সৃষ্টি এবং বৃষ্টিপাতের ধরনকে প্রভাবিত করছে।

আবহাওয়াবিদেরা বলছেন, মরুভূমির আবহাওয়া সারা বছরই উত্তপ্ত থাকে। কিন্তু বাংলাদেশে কয়েক বছর ধরে গ্রীষ্মকালে এ ধরনের আবহাওয়া দেখা যাচ্ছে। বিশেষ করে চুয়াডাঙ্গা, যশোর, ঝিনাইদহ, রাজশাহী, পাবনাসহ বেশ কয়েকটি জেলায় শুধু এপ্রিল মাসে এ ধরনের আবহাওয়া দেখা যাচ্ছে। ঢাকা, চট্টগ্রাম, খুলনাসহ বড় শহরগুলোতেও একই প্রবণতা চোখে পড়ছে। একসময় এসব এলাকায় দিনে তাপমাত্রা বাড়ত, আর রাতে কিছুটা কম। এখন দিন ও রাতের তাপমাত্রার পার্থক্য অর্ধেকে নেমে আসছে। এ ধরনই উদ্বেগের।
এ বিষয়ে আবহাওয়া অধিদপ্তরের আবহাওয়াবিদ বজলুর রশিদ বলেন, ভৌগোলিকভাবে বাংলাদেশ নাতিশীতোষ্ণ এলাকায় পড়েছে। এখানে গ্রীষ্মকালে গরম থাকলেও বেশি দিন স্থায়ী হয় না। কিন্তু সাম্প্রতিক বছরগুলোয়, বিশেষ করে এ বছর দেশের বড় অংশের আবহাওয়া মরুভূমির মতো আচরণ করছে।

এর কারণ চিহ্নিত করতে গিয়ে বজলুর রশিদ বলেন, বাংলাদেশে সাধারণত টানা তিন থেকে চার দিন দাবদাহ চলার পর কালবৈশাখী ও বৃষ্টি চলে আসে। এতে তাপমাত্রা কমে আসে। এবার বাতাসে আর্দ্রতা কম থাকায় এবং আকাশে মেঘ না থাকায় সূর্যের তাপ টানা এক সপ্তাহ ধরে দেশের ভূখণ্ডকে উত্তপ্ত করে চলেছে। আর তা সন্ধ্যার পর মরুভূমির মতো দ্রুত ঠান্ডা হয়ে যাচ্ছে।
আবহাওয়া অধিদপ্তরের পর্যবেক্ষণ বলছে, আজ বৃহস্পতিবার দেশের রংপুর বিভাগের জেলাগুলোয় দাবদাহ ছিল না। বাকি সব জেলার সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ৩৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস ছাড়িয়েছে। এই তাপমাত্রা আবার রাতে ২০ থেকে ২৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসের মধ্যে নেমে আসে। আর্দ্রতা মরুভূমির মতো ১০ থেকে ৪০ শতাংশের মধ্যে থাকছে।

আজ দেশের সবচেয়ে বেশি তাপমাত্রা ছিল চুয়াডাঙ্গায়, ৪১ ডিগ্রি সেলসিয়াস। আর ওই এলাকায় সর্বনিম্ন তাপমাত্রা ছিল এর অর্ধেকের কম, ১৯ দশমিক ৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস। ঢাকার ক্ষেত্রেও প্রায় একই পরিস্থিতি দেখা গেছে। আজ বেলা দেড়টায় রাজধানীর সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ৩৯ দশমিক ৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস ছিল, আর গতকাল বুধবার ভোরে সর্বনিম্ন তাপমাত্রা ছিল ২৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস।
এ নিয়ে কানাডার সাসকাচুয়ান বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষক মোস্তফা কামাল প্রথম আলোকে বলেন, ‘মূলত ফারাক্কা বাঁধের প্রভাবে দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে পদ্মা নদীর পানি কমে গেছে। এ ছাড়া আমাদের নিজেদের তৈরি নানা অবকাঠামোর কারণে পদ্মার শাখা নদ-নদীগুলো পানিশূন্য হয়ে গেছে। সেখানে গাছপালাও কম। আর ঢাকাসহ বড় শহরগুলো অপরিকল্পিত নগরায়ণের কারণে বৃক্ষ ও জলাভূমিশূন্য হয়ে পড়েছে। যে কারণে এপ্রিলে সূর্য থেকে আসা উত্তাপে ভূখণ্ড দ্রুত গরম হয়ে যাচ্ছে। আর সূর্য ডুবে গেলে তা দ্রুত তাপ ছেড়ে দিয়ে ঠান্ডা হয়ে যাচ্ছে।’
আবহাওয়া অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, দেশে সবচেয়ে বেশি তাপমাত্রা ছিল ১৯৭২ সালের ১৯ মে রাজশাহীতে। সেবার তাপমাত্রা ৪৫ দশমিক ১ ডিগ্রি সেলসিয়াস উঠেছিল। এর আগে ১৯৫৬ সালের ১৬ এপ্রিল বরিশালে ৪৩ দশমিক ৬ ডিগ্রি সেলসিয়াস, ১৯৮৯ সালের ২১ এপ্রিল বগুড়ায় ৪৪ ডিগ্রি সেলসিয়াস, ১৯৬৩ সালের ২ এপ্রিল যশোরে ৪৩ দশমিক ৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস, ১৯৭৫ সালে ময়মনসিংহে ৪৩ দশমিক ৩ ডিগ্রি সেলসিয়াস এবং ১৯৬৬ সালের ১০ এপ্রিল রাঙামাটিতে ৪৩ দশমিক ৩ ডিগ্রি সেলসিয়াস উঠেছিল।
ন্যাশনাল ওশানোগ্রাফিক অ্যান্ড মেরিটাইম ইনস্টিটিউটের (নোয়ামি) নির্বাহী পরিচালক মোহন কুমার দাশ প্রথম আলোকে বলেন, নানা ধরনের প্রাকৃতিক কারণে বাংলাদেশের একেক এলাকায় একেক সময় দাবদাহ বেশি হতো। তবে দুই যুগ ধরে দেশের বড় শহর, রাজশাহী বিভাগ এবং দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে বেশি দাবদাহ হচ্ছে। মূলত, এসব এলাকায় নদীগুলো শুকিয়ে যাওয়া এবং গাছপালা কমে আসার একটি দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব এখন আস্তে আস্তে স্পষ্ট হচ্ছে।

মোহন কুমার বলেন, এসব এলাকায় ধারাবাহিকভাবে তাপমাত্রা বেড়ে যাচ্ছে এবং দিন ও রাতের তাপমাত্রার পার্থক্য বেশি থাকছে। এটা মরুর আবহাওয়ার লক্ষণ। ফলে এসব এলাকায় বেশি পরিমাণে গাছ লাগাতে হবে। পাশাপাশি নদীগুলোয় পানি ধরে রাখার ব্যবস্থা করতে হবে।
প্রথমআলো