ডেস্ক রিপোর্ট: বাংলাদেশে মূল্যস্ফীতি গত ১১ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ পর্যায়ে রয়েছে। এই হার এখন শতকরা প্রায় ১০ ভাগ ছুঁই ছুঁই। আর খাদ্যপণ্যের মূল্যস্ফীতি সবচেয়ে বেশি। সাধারণ মানুষ আয়ের অধিকাংশ অর্থই খাদ্য কিনতে ব্যয় করে বলে তাদের ওপর চাপ সবচেয়ে বেশি।
অর্থনীতিবিদেরা বলছেন, এই পরিস্থিতি অব্যাহত থাকলে দারিদ্র্য সীমার নীচে মানুষের সংখ্যা বেড়ে যাবে। একই সঙ্গে সাধারণ মানুষ খাদ্যপণ্যের ভোগ কমিয়ে দিয়ে টিকে থাকার চেষ্টা করবে। তাতে সাধারণ মানুষের বিশেষ করে নারী ও শিশুদের পুষ্টি ও স্বাস্থ্যের ওপর চাপ বাড়বে।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) মূল্যস্ফীতির সর্বশেষ যে হিসাব তৈরি করেছে তাতে দেখা যায় গত ১১ বছর তিন মাসের মধ্যে মূল্যস্ফীতি শীর্ষে রয়েছে। আগস্ট মাসে তারা মূল্যস্ফীতির হিসাব করেছে ৯.৮৬ শতাংশ। অবশ্য সেপ্টেম্বর মাসে একটু কমে তা হয়েছে ৯.১ শতাংশ। আর খাদ্যপণ্যের মূল্যস্ফীতি শতকরা ১০ ভাগের ওপর। আবার গ্রামে শহরের চেয়ে মূল্যস্ফীতি বেশি। তবে এই মূল্যস্ফীতির হার এখনো আনুষ্ঠানিকভাবে প্রকাশ করেনি বিবিএস। পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের অনুমোদন সাপেক্ষে দুই মাসের মূল্যস্ফীতির হিসাব একসঙ্গে প্রকাশ করা হবে।
বাংলাদেশে ২০১১ সালের মে মাসে সর্বোচ্চ মূল্যস্ফীতি হয়েছিলো ১০.২ শতাংশ। এরপর মূল্যস্ফীতি আর কখনোই ৯ ভাগ ছাড়ায়নি। চলতি আগস্ট এবং সেপ্টেম্বরে তা ছাড়িয়ে গেল।
বিশ্লেষকেরা বলছেন, এই মূল্যস্ফীতির পিছনে ইউক্রেন যুদ্ধের ফলে আন্তর্জাতিক বাজারে নিত্য পণ্যের দাম বাড়ার প্রভাব যেমন আছে তেমনি অভ্যন্তরীণ ব্যবস্থাপনার সংকটও আছে। তবে যে কারণই থাকুক না কেন এর ফলে সাধারণ মানুষের ক্রয় ক্ষমতা কমে যাচ্ছে। মানুষ ভোগ কমিয়ে পরিস্থিতি মোকাবেলার চেষ্টা করছে। ফলে অপুষ্টি বাড়বে এবং আরও মানুষ দারিদ্র্য সীমার নিচে নেমে যাবে।
কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশেন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সহ-সভাপতি এস এম নাজের হোসেন বলেন, ‘ওএমএস-এর ভোগ্যপণ্যের জন্য লাইন দেখলেই বোঝা যায় এরইমধ্যে নতুন করে একাংশ দারিদ্র্য সীমার নিচে চলে গেছে। মূল্যস্ফীতির কারণে নিম্ন আয়ের মানুষ এখন নিকে থাকতে চাল, ডিম, মাছ, মাংস খাওয়া কমিয়ে দিয়েছে। ফলে অপুষ্টিও দেখা দেবে।’
২০১৬ সালে বিবিএস-এর খানা জরিপে দেখা যায় দেশের মানুষ গড়ে তাদের আয়ের ৪৭.৭ ভাগ খাদ্যের পিছনে ব্যয় করেন। ওই জরিপের তথ্যই বলে দেয় যে মানুষের আয় যত কম খাদ্যের পিছনে সেই মানুষের মোট আয়ের আনুপাতিক ব্যয় তত বেশি। জরিপে মোট ১২টি ইনকাম গ্রুপ দেখানো হয়। তাতে বলা হয়, সর্বনিম্ন আয়ের পাঁচ ভাগ মানুষ খাবারের পিছনে তাদের আয়ের ৬২.৫ ভাগ ব্যয় করেন। আয়ের নিম্নতম নয়টি গ্রুপ তাদের আয়ের গড়ে ৫৫ ভাগের বেশি খাদ্যের পিছনে ব্যয় করে। আর সর্বোচ্চ আয়ের পাঁচ ভাগ মানুষ খাদ্যের পিছনে ব্যয় করে আয়ের ৩৩.৭ ভাগ।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক ও বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সানেমের (সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিং) নির্বাহী পরিচালক অধ্যাপক ড. সেলিম রায়হান বলেন, ‘বিবিএস যে মূল্যস্ফীতির কথা বলছে বাস্তবে মূল্যস্ফীতি তার চেয়ে বেশি। তারা যে পদ্ধতিতে হিসেব করে তা অনেক পুরানো।’
তার কথা, ‘এই মূল্যস্ফীতির হার শহরের চেয়ে গ্রামের মানুষের ওপর বেশি। আর শহর এবং গ্রাম উভয় এলাকায় নিম্ন আয়ের মানুষের ওপর বেশি। এর কারণ ভোগ্যপণ্যের দাম বাড়ছে বেশি। আর নিম্ন আয়ের মানুষ ভোগ্যপণ্য কিনেতেই তার আয়ের অধিকাংশ অর্থ ব্যয় করে। সেটা এখন শতকরা ৮০-৯০ ভাগ হতে পারে। তাই এই পরিস্থিতিতে তাদের টিকে থাকা কঠিন হয়ে পড়ছে।’
তিনি মনে করেন, ‘বিশ্ব পরিস্থিতি, ডলার সংকটসহ আরও অনেক সংকট আছে। তারপরও সরকারের পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখার সুযোগ আছে। সেটা সরকার কেমন করছেনা। ফলে এই উচ্চমূল্য মন্দা পরিস্থিতির সৃষ্টি করতে পারে। এটা মন্দার একটা সূচক।’
ইউএনডিপি বাংলাদেশের কান্ট্রি ইকোনমিস্ট ড. নাজনীন আহমেদ মনে করেন, ‘মূল্যস্ফীতির পেছনে বিশ্ববাজারের প্রভাব আছে সত্য তবে এখানে অভ্যন্তরীণ ব্যবস্থাপনারও ত্রুটি আছে। কারণ বাজারে নিত্যপণ্যের দাম এখন স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় নির্ধারণ হয় না। এখানে সিন্ডিকেট আছে, মধ্যস্বত্বভোগী আছে। চালের দাম স্বাভাবিক নেই। কর্পোরেট প্রতিষ্ঠানগুলো চালের ব্যবসায় নেমে যাওয়ায় খরচও বেড়েছে। বেড়েছে বাজার নিয়ন্ত্রণের শক্তি। আবার ভোজ্য তেলসহ আমদানি পণ্যের দাম আন্তর্জাতিক বাজারের ওপর নির্ভরশীল হলেও এখানে আন্তর্জাতিক বাজারের চেয়ে বেশি। এখানেও বাজার প্রভাবিত করার অভিযোগ আছে।’
তিনি মনে করেন, ‘সরকার উদ্যোগ নিচ্ছে তবে তা সার্বিক নয়। দরকার সার্বিক ব্যবস্থাপনা।’ মূল্যস্ফীতির এই পরিস্থিতি দেশের নিম্ন এবং নিম্ন মধ্যবিত্তকে দারিদ্র্য অবস্থার মধ্যে নিয়ে যাওয়ার আশঙ্কা করে তিনি বলেন,’ সরকারের সামাজিক নিরাপত্তা বিশেষ করে খাদ্য নিরাপত্তা কর্মসূচি আরও বাড়াতে হবে।’
ইত্তেফাক
