Home রাজনীতি বিএনপিবিহীন ভোটেও হার, চিন্তিত আ.লীগ

বিএনপিবিহীন ভোটেও হার, চিন্তিত আ.লীগ

24

ভোটের মাঠে দলীয় অনৈক্য আবারও স্পষ্ট হয়েছে। জাতীয় নির্বাচনের আগে দলের অনৈক্য ও বিরোধী ভোটের জোর ভাবাচ্ছে আওয়ামী লীগকে।

ডেস্ক রিপোর্ট: সব ধরনের চেষ্টা করেও গাজীপুর সিটি করপোরেশন নির্বাচনে দলীয় প্রার্থীকে জেতাতে পারেনি আওয়ামী লীগ। বিএনপিবিহীন ওই ভোটে দলীয় প্রার্থীর পরাজয়ে ক্ষমতাসীন দলের নেতারা কিছুটা হতাশ ও চিন্তিত। তাঁরা দলের অনৈক্য ও বিরোধীদের ভোটকে এই পরাজয়ের মূল কারণ হিসেবে দেখছেন।

গাজীপুর সিটি করপোরেশন নির্বাচনের কৌশল নির্ধারণ, প্রচার ও ভোট পর্যবেক্ষণে যুক্ত থাকা কেন্দ্রীয় নেতাদের সঙ্গে কথা বলে আওয়ামী লীগের এই মনোভাব জানা গেছে।
গত বৃহস্পতিবার অনুষ্ঠিত গাজীপুর সিটি নির্বাচনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী আজমত উল্লা খানকে ১৬ হাজার ১৯৭ ভোটের ব্যবধানে হারিয়ে মেয়র নির্বাচিত হয়েছেন স্বতন্ত্র প্রার্থী জায়েদা খাতুন। যিনি সাবেক মেয়র জাহাঙ্গীর আলমের মা।

আওয়ামী লীগের নেতারা মনে করছেন, জায়েদা খাতুনের বিজয়কে ছোট করে দেখার অবকাশ নেই। সরকারবিরোধীরা একজোট হয়ে তাঁকে ভোট দিয়েছেন। পাশাপাশি ক্ষমতাসীন দলের মাঠপর্যায়ে অনৈক্য ছিল। আওয়ামী লীগ এবং সরকারের ভেতর সাবেক মেয়র জাহাঙ্গীর আলমের প্রতি সহানুভূতিশীল গোষ্ঠী আছে। সে প্রভাবও তাঁর মায়ের জেতার ক্ষেত্রে কাজ করেছে।
জাতীয় নির্বাচনের আগে বিরোধী ভোটের জোর ও দলের অনৈক্য ভাবাচ্ছে আওয়ামী লীগকে। দলটির নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের একাধিক সূত্রের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন ও যুক্তরাষ্ট্রের নতুন ভিসা নীতি—এসব বিবেচনায় গাজীপুর সিটি নির্বাচন সুষ্ঠু করার তাগিদ ছিল। বিএনপি অংশ না নেওয়ায় আওয়ামী লীগ নেতাদের বিশ্বাস ছিল, সুষ্ঠু ভোটেই দলীয় প্রার্থী আজমত উল্লা খান জয়ী হবেন। এ ছাড়া ভোটের প্রচার থেকে শুরু করে ভোট গ্রহণের আগপর্যন্ত সরকারের বিভিন্ন পর্যায় থেকেও গাজীপুরে নৌকা প্রতীকের প্রার্থীর জয় নিশ্চিত করতে চেষ্টা ছিল। কিন্তু এর কোনোটিই কাজে লাগেনি বলে কিছুটা চিন্তিত আওয়ামী লীগ।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আ ফ ম বাহাউদ্দিন নাছিম বলেন, দলীয় প্রার্থী জয়ী হলে খুশি লাগত। কিন্তু ভোট সুষ্ঠু হয়েছে। জনগণ একজনকে বেছে নিয়েছেন। এতে কিছু করার নেই। তিনি বলেন, দলের ভেতর কোনো সমস্যা ছিল কি না, সেটা বিশ্লেষণ করা হবে। তবে বিএনপি-জামায়াত আওয়ামী লীগকে হারাতে এককাট্টা ছিল।

গাজীপুরের ভোটের ফল নিয়ে সরকারের একজন মন্ত্রীর সঙ্গে এই প্রতিবেদকের কথা হয়। তিনি নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ‘জায়েদা খাতুন আমাদেরই লোক; ফলে তাঁর জয় আওয়ামী লীগেরই—এমনটা অনেকে বলতে পারেন। সুষ্ঠু নির্বাচন করে দেখিয়ে দেওয়া গেছে, এটা বলেও অনেকে আত্মতৃপ্তি নিতে পারেন। কিন্তু মূল কথা অ-জনপ্রিয়তা ও দলীয় অনৈক্যে আওয়ামী লীগ হেরেছে; এটা মেনে না নিলে সামনে বিপদ আছে।’

ব্যক্তির জয়, দলের হার
বিতর্কিত মন্তব্যের কারণে জাহাঙ্গীর আলমকে ২০২১ সালে আওয়ামী লীগ থেকে বহিষ্কার করা হয়েছিল। এর পরপরই স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় মেয়র পদ থেকে তাঁকে সাময়িক বরখাস্ত করে। এরপর চলতি বছরের জানুয়ারিতে তিনি দলীয় ক্ষমা পান। সিটি নির্বাচনকে কেন্দ্র করে ১৫ মে তাঁকে আজীবনের জন্য বহিষ্কার করে আওয়ামী লীগ।

নৌকা প্রতীকের প্রার্থীকে হারিয়ে মা জায়েদা খাতুনের বিজয় নিশ্চিত হওয়ার পর জাহাঙ্গীর আলম বৃহস্পতিবার রাতে সাংবাদিকদের বলেন, গাজীপুরে নৌকার জয় হয়েছে, পরাজয় হয়েছে ব্যক্তির।

তবে আওয়ামী লীগের নেতাদের মনোভাব ঠিক উল্টো। দলের কেন্দ্রীয় কমিটির অন্তত পাঁচজন দায়িত্বশীল নেতা এই প্রতিবেদককে বলেন, গাজীপুরে আওয়ামী লীগ ও নৌকার পরাজয় হয়েছে; জিতেছেন জাহাঙ্গীর।

এই নেতারা বিশ্বাস করেন, জাহাঙ্গীর রাজনীতিতে আসার পর এবং মেয়র হয়ে জাতীয় ও স্থানীয় পর্যায়ে আওয়ামী লীগের অনেক নেতাকে অনেক সুযোগ-সুবিধা দিয়েছেন। সরকারের ভেতরেও অনেকে আছেন, যাঁরা জাহাঙ্গীর থেকে সুবিধা নিয়েছেন। এর সুফল জাহাঙ্গীর এই নির্বাচনে পেয়েছেন। পাশাপাশি সরকারবিরোধী যে ভোট, সেটাও জাহাঙ্গীরের মায়ের পক্ষে গেছে।

এ ছাড়া গত মার্চে গাজীপুর সিটি করপোরেশনের ৭৬ কাউন্সিলরের মধ্যে ৬১ জন সাময়িক বরখাস্ত জাহাঙ্গীর আলমকে মেয়র পদ ফিরিয়ে দেওয়ার আবেদন করেন স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ে। আজমত উল্লা দলীয় মনোনয়ন পাওয়ার পরও এসব সাবেক কাউন্সিলর ভোটে জাহাঙ্গীরের পক্ষে ছিলেন বলে মনে করেন দলের নেতারা। এর বাইরে বিএনপি থেকে বহিষ্কৃত কাউন্সিলর প্রার্থীদের মাধ্যমেও জাহাঙ্গীর মায়ের জন্য ভোটারদের টেনেছেন বলে মনে করা হচ্ছে।

এই নির্বাচনের আগে মানুষ জাহাঙ্গীর মা জায়েদা খাতুনের নামও শোনেনি। একেবারেই সাধারণ এই নারীর কাছে হেরে যাওয়ায় আওয়ামী লীগের প্রার্থী নির্বাচন ঠিক হয়েছে কি না, সেই আলোচনা সামনে আনতে চান জাহাঙ্গীরের প্রতি সহানুভূতিশীল নেতারা। তবে কেন্দ্রীয় ও স্থানীয় আওয়ামী লীগ সূত্র বলছে, আজমত উল্লার মতো শিক্ষিত, মার্জিত ও পুরোনো নেতাকে দলীয় প্রার্থী করার বিষয়টি ভুল ছিল, এমনটা দল মনে করা না। তিনি টঙ্গী পৌরসভার মেয়র থাকা অবস্থায় জনপ্রিয় ছিলেন। দলের মহানগর সভাপতি হিসেবে সংগঠনে দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তিদের বেশির ভাগই তাঁর অনুগত হিসেবে কাজ করবেন, এটা ধরে নেওয়া হয়েছিল। তবে পুরো গাজীপুর সিটিতে আজমত উল্লার প্রভাব যতটা ভাবা হয়েছিল, ভোটের মাঠে ততটা দেখা যায়নি। টঙ্গীর বাইরে বাকি এলাকাগুলোতে তাঁর যাওয়া-আসা কম ছিল।

মাকে ভোটে দাঁড় করানো কাজে দিয়েছে
আওয়ামী লীগের বিভিন্ন পর্যায়ের সূত্র থেকে জানা গেছে, মায়ের পক্ষে ভোট করার দায়ে জাহাঙ্গীর আলমকে দল থেকে স্থায়ীভাবে বহিষ্কার করার সিদ্ধান্তটি কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগ থেকে স্বতঃস্ফূর্তভাবে আসেনি। দলের নেতাদের একটা অংশ সিদ্ধান্তটি নিতে অনেকটা বাধ্য করেছেন। দলের প্রভাবশালী একটা অংশ জাহাঙ্গীরের প্রতি সহানুভূতিশীল ছিল। যদিও জাহাঙ্গীরকে দলীয় প্রার্থীর বিপক্ষে দাঁড়াতে দেওয়া হবে না—এ ধরনের মত জোরালো ছিল। এমনকি তাঁকে দলীয় প্রার্থীর বিপক্ষে অবস্থান নেওয়ার সুযোগ না দেওয়ার বিষয়টিও দলে আলোচিত হয়েছে। কিন্তু জাহাঙ্গীর সেটা আঁচ করতে পেরে মাকেও প্রার্থী করে রাখেন। তাঁর এই ‘কৌশলী’ সিদ্ধান্তের পেছনে দলের কোনো অংশের পরামর্শও থাকতে পারে বলে কেউ কেউ মনে করেন।

আওয়ামী লীগ মনে করেছিল জায়েদা খাতুন অখ্যাত। জাহাঙ্গীরের মতো তিনি প্রভাব ফেলতে পারবেন না। কিন্তু জাহাঙ্গীর প্রার্থী হলে প্রচারের ক্ষেত্রে যতটা চাপ দেওয়া যেত, নারী হওয়ায় তাঁর মায়ের প্রচারে ততটা চাপ দেওয়া যায়নি।
কেন্দ্রীয় ও স্থানীয় আওয়ামী লীগের নেতারা বলছেন, জাহাঙ্গীর আলমকে ভোটে দাঁড়াতে দেওয়া হবে না—এটা তিনি জানতেন। এ ছাড়া মেয়র থাকা অবস্থায় সড়ক সম্প্রসারণের নামে ব্যক্তি-মানুষের জমি নেওয়াসহ নানা অনিয়মের কারণে কিছুটা জনপ্রিয়তা হারিয়েছিলেন তিনি। কিন্তু তাঁর প্রার্থিতা বাতিল, ভোটের আগে দুর্নীতি দমন কমিশনে (দুদক) তলব, প্রচারের সময় গাড়ি ভাঙচুর, মায়ের বাধ্য ছেলে হিসেবে নিজেকে উপস্থাপন—এসব কারণে শেষ দিকে মানুষের সহানুভূতি পেয়েছেন। সে কারণে তাঁর মা কিছু সহানুভূতি ভোট পেয়েছেন।

তবে আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য কাজী জাফর উল্যাহ বলেন, আওয়ামী লীগের ভোট নৌকাতেই বেশি পড়েছে। কিছু ভোট হয়তো জাহাঙ্গীরের মায়ের পক্ষে গেছে। তবে বিএনপি-জামায়াত ও সরকারবিরোধী সবার লক্ষ্য ছিল নৌকা ঠেকানো। তিনি বলেন, এই নির্বাচনে দুটি বিষয় পরিষ্কার। শেখ হাসিনার অধীনে সুষ্ঠু নির্বাচন হচ্ছে, এটা প্রমাণিত হয়েছে। আর আওয়ামী লীগ–বিরোধীরা নৌকা ঠেকাতে একজোট—এটা বোঝা গেল।