Home মতামত বাংলাদেশের প্রথম অন্তর্বর্তীকালীন সংবিধান ‘স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র’ প্রণয়ন দিবস কাল

বাংলাদেশের প্রথম অন্তর্বর্তীকালীন সংবিধান ‘স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র’ প্রণয়ন দিবস কাল

29

সৈয়দ আমিরুজ্জামান |

গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের প্রথম অন্তর্বর্তীকালীন সংবিধান ‘স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র’ প্রণয়ন ও ঐতিহাসিক বিপ্লবী মুজিবনগর সরকার গঠন করা হয়েছিল ১৯৭১ সালের ১০ এপ্রিল।
এবার ‘স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র’ জারির ৫২ বছর পূর্ণ হলো। এরসাথে সম্পৃক্ত সকলের প্রতি বিনম্র শ্রদ্ধা!
জাতির সূর্য সন্তান, ৭১-এর মহান মুক্তিযুদ্ধে তিরিশ লাখ শহীদ ও সকল শহীদ বুদ্ধিজীবী, সম্ভ্রম হারানো ২ লক্ষ মা-বোন, নির্যাতিত পনের লাখেরও বেশি মানুষ, সর্বস্ব হারানো ১ কোটি মানুষসহ গোটা জনগণের লড়াই-সংগ্রাম-ত্যাগ তিতিক্ষা অার অবদানের জন্য তাঁদের প্রতি বিনম্র শ্রদ্ধা ও অভিবাদন!!
বাঙালি জাতি ও জনগণের বড় ও শ্রেষ্ঠ অর্জন এই স্বাধীনতা। বাংলাদেশের ইতিহাস হলো স্বাধীনতা ও মুক্তির জন্য কোটি কোটি খেটে খাওয়া মানুষের সুদীর্ঘ লড়াইয়ের ইতিহাস। এ দেশের মানুষ লড়াই করেছে বৃটিশ সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে, পাকিস্তানী শাসক গোষ্ঠীর শ্রেণি শোষণ ও জাতিগত নিপীড়নের বিরুদ্ধে। দেশীয় সামরিক-বেসামরিক স্বৈরাচার ও লুটেরা শোষক শ্রেণীর বিরুদ্ধে। জনগণের সংগ্রামের মুখেই একদিন বৃটিশ সাম্রাজ্যবাদকে এ দেশ ছেড়ে চলে যেতে বাধ্য হয়েছিল। ১৯৪৭ সালে বৃটিশ সাম্রাজ্যবাদ চলে গেলেও আমাদের উপর চেপে বসল পাকিস্তানী শাসক গোষ্ঠীর ঔপনিবেশিক ধরণের শাসন ও শোষণ।
বাংলাদেশের মানুষ প্রথম থেকেই জাতিগত শাসন-শোষণ-বঞ্চণা-অনুন্নয়ন ও নিপীড়নের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করে এসেছে- যার চূড়ান্ত রূপ লাভ করল ’৭১-এর সুমহান সশস্ত্র স্বাধীনতা ও মুক্তি সংগ্রামের ভিতর দিয়ে।
অল্পসংখ্যক ঘাতক রাজাকার-আল বদর-আল শামস-শান্তি কমিটির সদস্য ছাড়া বাংলাদেশের তৎকালীন প্রায় সাড়ে ৭ কোটি মানুষ ধর্ম-বর্ণ-বিশ্বাস-নারী-পুরুষ-আবাল বৃদ্ধ বণিতা-দলমত নির্বিশেষে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ, মজলুম জননেতা মাওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানীর নেতৃত্বাধীন ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি-ন্যাপ (ভাসানী), অধ্যাপক মোজাফফর আহমদের নেতৃত্বাধীন ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি-ন্যাপ (মোজাফফর), কমরেড মণি সিং-এর নেতৃত্বাধীন কমিউনিষ্ট পার্টি, কাজী জাফর-রাশেদ খান মেনন-হায়দার আকবর খান রনো’র নেতৃত্বাধীন কমিউনিষ্ট বিপ্লবীদের পূর্ব বাংলার সমন্বয় কমিটি (বর্তমানে বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টি), ছাত্র ইউনিয়ন [মেনন]-(বর্তমানে বাংলাদেশ ছাত্র মৈত্রী), ছাত্র ইউনিয়ন [মতিয়া]-(বর্তমানে বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়ন), কমিউনিষ্ট পূর্ব বাংলার সমন্বয় কমিটি (দেবেন শিকদারের নেতৃত্বে), শ্রমিক-কৃষক কর্মীসংঘ, কমিউনিস্ট পার্টি (হাতিয়ার), পূর্ব বাংলার কৃষক সমিতি, পূর্ব বাংলা শ্রমিক ফেডারেশন, বাংলাদেশ শ্রমিক ফেডারেশন (পূর্ব পাকিস্তান শ্রমিক ফেডারেশন), পূর্ব বাংলা বিপ্লবী ছাত্র ইউনিয়ন, উপরোক্ত অধিকাংশ বাম প্রগতিশীল রাজনৈতিক দল ও গণ-সংগঠনের প্রতিনিধিদের নিয়ে গঠিত বাংলাদেশ জাতীয় মুক্তি সংগ্রাম সমন্বয় কমিটিসহ অন্যান্য বামপন্থী প্রগতিশীল নানা গ্রুপ-দলের নেতৃত্বে বীরত্বপূর্ণ লড়াইয়ের ফলেই পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীর পরাজয় ঘটলো এবং পৃথিবীর মানচিত্রে বাংলাদেশ নামে একটি নতুন রাজনৈতিকভাবে স্বাধীন সার্বভৌম দেশের অভ্যুদয় ঘটলো। জাতিগত নিপীড়ন ও শোষণের শিকার জনগণের বিজয় অর্জিত হয়।
১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ চট্টগ্রাম স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করা হয়। এই ঘোষণাকে অনুমোদন দানের জন্য তথা বাংলাদেশের জনগণের স্বাধীনতার দাবীতে ১০ এপ্রিল তারিখে ‘স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র’ জারি করা হয়। ১৯৭০ সালে সাধারণ নির্বাচনে যারা তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান থেকে জাতীয় অাইন পরিষদের সদস্য (M.N.A.) নির্বাচিত হয়েছিলেন এবং যারা প্রাদেশিক আইন পরিষদের সদস্য (M.P.A.) নির্বাচিত হয়েছিলেন তাদের অধিকাংশই স্বাধীনতা ঘোষণার পর ভারতে চলে যান এবং তারা ১০ এপ্রিল কুষ্টিয়া জেলার মুজিবনগরে গণপরিষদ গঠনের মাধ্যমে স্বাধীন বাংলাদেশের অস্থায়ী সরকার গঠন করেন এবং এই অস্থায়ী সরকারের মাধ্যমে স্বাধীনতার ঘোষণাকে অানুষ্ঠানিকভাবে অনুমোদন করা হয়। ঘোষণা অনুযায়ী এটা ছিল স্বাধীন গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের বিপ্লবী সরকার। বিপ্লবী সরকারের এই ঘোষণা ২৬ মার্চ থেকে কার্যকরী করা হয়। ১৯৭১ সালের ১৭ এপ্রিল স্বাধীন গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের অস্থায়ী বিপ্লবী সরকার মুজিবনগরে আনুষ্ঠানিকভাবে শপথ গ্রহণ করে।
যুদ্ধোত্তর বাংলাদেশে ‘স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র’ সাময়িকভাবে অন্তর্বর্তীকালীন সংবিধানের কাজ করেছে। এটা যদিও একটা ঘোষণা ছিল তথাপিও এটাকে আমরা সংবিধান বলবো। কারণ ইহাতে রাষ্ট্রের প্রকৃতি, সরকার পদ্ধতি, সরকারের বিভাগ, সরকারের রূপরেখা পাওয়া যায়।
ঘোষণাপত্রে বাংলাদেশকে ‘সার্বভৌম প্রজাতন্ত্র’ হিসেবে ঘোষণা করা হয়। রাষ্ট্রপতি শাসিত সরকার ব্যবস্থা প্রবর্তন করা হয়। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি ও সৈয়দ নজরুল ইসলামকে উপ-রাষ্ট্রপতি ঘোষণা করা হয়।
ঘোষণাপত্রে বলা হয় –
১. রাষ্ট্রপতি প্রজাতন্ত্রের সকল সশস্ত্র বাহিনীর সর্বাধিনায়ক হবেন।
২. রাষ্ট্রপতি যে কোনো ব্যক্তিকে প্রধানমন্ত্রী ও মন্ত্রী নিয়োগ করতে পারবেন।
৩. রাষ্ট্রপতি কর ধার্য করবেন এবং অর্থ ব্যয় করবেন।
৪. রাষ্ট্রপতি প্রজাতন্রের নির্বাহী বিভাগের প্রধান হবেন।
৫. রাষ্ট্রপতি আইন প্রণয়নগত ক্ষমতা প্রয়োগ করবেন।
৬. রাষ্ট্রপতি গণপরিষদ আহবান ও স্থগিত করবেন।

২য় অন্তর্বর্তীকালীন সংবিধান
অস্থায়ী সংবিধান আদেশ
১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর বাংলাদেশ সম্পূর্ণভাবে স্বাধীনতা লাভ করে। ২২ ডিসেম্বর মুজিবনগর প্রবাসী সরকার দেশে এসে দায়িত্ব নিলেন। তখন বাংলাদেশের শাসনতন্র ‘স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র’ অনুসারেই দেশ পরিচালিত হতে থাকে। বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান পাকিস্তানি কারাগার থেকে মুক্তিলাভ করে ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি ঢাকা প্রত্যাবর্তন করেন। ১১ জানুয়ারি তিনি বাংলাদেশের রাষ্ট্রপ্রধান হিসেবে বাংলাদেশে অস্থায়ী শাসনতন্ত্র আদেশ (Provisional Constitutional Order) জারি করেন। এ শাসনতান্ত্রিক আদেশ জারির পটভূমিতে বলা হয়, ১৯৭১ সালের ১০ এপ্রিল মুজিবনগরের ঘোষিত স্বাধীনতার অাদেশ ছিল গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের জন্য একটি অস্থায়ী ব্যবস্থা এবং যে অবস্থার প্রেক্ষিতে এ স্বাধীনতা আদেশ জারি করা হয়েছিল তার অবসান ঘটেছে। তাছাড়াও এদেশের গণমানুষ সংসদীয় গণতন্ত্র ব্যবস্থা প্রবর্তনের ইচ্ছা পোষণ করেন। ফলে জনগণের আশা-আকাঙ্খা অনুযায়ী রাষ্ট্রপতি স্বাধীনতা ঘোষণার প্রেক্ষিতে এ ‘অস্থায়ী সংবিধান আদেশ’ জারি করেছেন।
ইহা ছিল বাংলাদেশের দ্বিতীয় অন্তর্বর্তীকালীন সংবিধান। ১৯৭২ সালের ১১ জানুয়ারি থেকে ১৬ ডিসেম্বর পর্যন্ত (বাংলাদেশের প্রকৃত সংবিধান রচিত না হওয়া পর্যন্ত) এই ‘অস্থায়ী সংবিধান আদেশ’ দেশে সংবিধানের কাজ করেছে। ইহাতে বাংলাদেশের জন্য একটি ব্রিটিশ পদ্ধতির সংসদীয় সরকারের বিধান রাখা হয়। ইহাতে বলা হয়,
১. বাংলাদেশে একটি মন্ত্রিসভা থাকবে এবং প্রধানমন্ত্রী মন্ত্রিসভার প্রধান থাকবেন (অনুঃ ৫)।
২. রাষ্ট্রপতি তার সকল দায়িত্ব প্রধানমন্ত্রীর সাথে পরামর্শক্রমে পালন করবেন (অনুঃ ৬)।
৩. ১৯৭০ সালের ৭ ডিসেম্বর এবং ১৯৭১ সালের ১ মার্চের মধ্যবর্তী বিভিন্ন তারিখে অনুষ্ঠিত নির্বাচনগুলোতে জাতীয় পরিষদ ও প্রাদেশিক পরিষদের আসনগুলোতে বিজয়ী বাংলাদেশের প্রতিনিধিদের নিয়ে একটি গণপরিষদ গঠিত হবে (অনুঃ ৪)।
এই আদেশের অধীনে ১২ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান প্রেসিডেন্ট হিসেবে পদত্যাগ করেন এবং সংবিধান অনুযায়ী বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী প্রেসিডেন্ট হলেন এবং তিনি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে প্রধানমন্ত্রী নিয়োগ করলেন।
বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র প্রবাসী বাংলাদেশ সরকার বা মুজিবনগর সরকার কর্তৃক ১৯৭১ সালের ১৭ এপ্রিল তারিখে আনুষ্ঠানিকভাবে ঘোষিত একটি ঘোষণাপত্র। যতদিন বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ চলেছে ততদিন মুজিবনগর সরকার পরিচালনার অন্তর্বর্তীকালীন সংবিধান হিসেবে এই ঘোষণাপত্র কার্যকর ছিল। ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর স্বাধীন বাংলাদেশ শত্রুমুক্ত হওয়ার পরও এই ঘোষণাপত্র সংবিধান হিসেবে কার্যকর ছিল। ১৯৭২ সালের ১৬ ই ডিসেম্বর তারিখে যখন দেশের নতুন সংবিধান প্রণীত হয় তখন সংবিধান হিসেবে এর কার্যকারিতার সমাপ্তি ঘটে।
ইতিহাস : ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ রাতে পাকিস্তান সামরিক বাহিনী ঢাকা এবং তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের অন্যান্য অংশে আক্রমণ চালিয়ে ব্যাপক গণহত্যা চালায়। এই গণহত্যার প্রাক্কালে তৎকালীন আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দ, গণপরিষদ ও প্রাদেশিক পরিষদের সদস্যগণ নিরাপত্তার জন্য সীমান্ত অতিক্রম করে ভারতে গিয়ে আশ্রয় নেন। ৩০ মার্চের মধ্যেই তাদের অনেকে কলকাতায় সমবেত হন। প্রাদেশিক পরিষদের যে সকল সদস্য ১০ এপ্রিলের মধ্যে কলকাতায় পৌছতে সক্ষম হন তাদের নিয়ে তাজউদ্দীন আহমদ মন্ত্রিপরিষদ গঠন করেন। তার নির্দেশেই অধ্যাপক রেহমান সোবহান আরো কয়েকজনের সাহায্য নিয়ে স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রের একটি খসড়া প্রণয়ন করেন[১]।এরপর ব্যারিস্টার আমীর-উল-ইসলাম এই ঘোষণাপত্রের আইনগত দিকগুলো সংশোধন করে একে পূর্ণতা দান করেন[২]। এই ঘোষণাপত্রটি প্রথমে ১০ এপ্রিল মুজিবনগর থেকে প্রচার করা হয়[৩]।এরপর আবার ১৭ এপ্রিল তারিখে মেহেরপুর জেলার সীমান্তবর্তী স্থান বৈদ্যনাথতলায় (পরবর্তী নাম মুজিবনগর) এক অনাড়ম্বর অনুষ্ঠানে গণপরিষদের সদস্য অধ্যাপক এম ইউসুফ আলী আনুষ্ঠানিকভাবে স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র পাঠ করেন[৪]। এই ঘোষণার মাধ্যমে নবগঠিত প্রবাসী আইন পরিষদ বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব ঘোষণা করে সাথে সাথে এ ঘোষণাপত্র প্রবাসী সরকারের অবস্থান ও যৌক্তিকতা দৃঢ়ভাবে প্রতিষ্ঠা করে[৫]। এদিনই ২৬ মার্চের স্বাধীনতার ঘোষণাকে আনুষ্ঠানিকভাবে অনুমোদন দেয়া হয় এবং একই সাথে ২৬ মার্চ থেকে বাংলাদেশের স্বাধীনতা কার্যকর হয়েছে বলে ঘোষণা করা হয়। এর ফলে প্রবাসী মুজিবনগর সরকারও বৈধ বলে স্বীকৃত হয়। এ ঘোষণায় মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণকারী সকলের মধ্যে চেইন অফ কমান্ড স্থাপনের নির্দেশ দেয়া হয়।
ঘোষণাপত্র :
বাংলাদেশ গণপরিষদ দ্বারা ঘোষণা[৬]
স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র
মুজিবনগর, বাংলাদেশ
তারিখ: ১০ এপ্রিল ১৯৭১
যেহেতু ১৯৭০ সালের ৭ ডিসেম্বর থেকে ১৯৭১ সালের ১৭ জানুয়ারি পর্যন্ত বাংলাদেশে অবাধ নির্বাচনের মাধ্যমে শাসনতন্ত্র রচনার উদ্দেশ্যে প্রতিনিধি নির্বাচিত করা হয়েছিল;
এবং
যেহেতু এই নির্বাচনে বাংলাদেশের জনগণ ১৬৯টি আসনের মধ্যে আওয়ামী লীগ দলীয় ১৬৭ জন প্রতিনিধি নির্বাচিত করেছিল;
এবং
যেহেতু জেনারেল ইয়াহিয়া খান ১৯৭১ সনের ৩রা মার্চ তারিখে শাসনতন্ত্র রচনার উদ্দেশ্যে নির্বাচিত প্রতিনিধিদের অধিবেশন আহ্বান করেন;
এবং
যেহেতু তিনি আহূত এই অধিবেশন স্বেচ্ছাচার এবং বেআইনীভাবে অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ ঘোষণা করেন;
এবং
যেহেতু পাকিস্তান কর্তৃপক্ষ তাদের প্রতিশ্রুতি পালন করার পরিবর্তে বাংলাদেশের জনপ্রতিনিধিদের সঙ্গে পারষ্পরিক আলোচনাকালে ন্যায়নীতি বহির্ভূত এবং বিশ্বাসঘাতকতামূলক যুদ্ধ ঘোষণা করেন;
এবং
যেহেতু উল্লিখিত বিশ্বাসঘাতকতামূলক কাজের জন্য উদ্ভূত পরিস্থিতির পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশের সাড়ে সাত কোটি মানুষের অবিসংবাদিত নেতা শেখ মুজিবুর রহমান জনগণের আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার অর্জনের আইনানুগ অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য ১৯৭১ সালের ২৬শে মার্চ ঢাকায় যথাযথভাবে স্বাধীনতা ঘোষণা করেন, এবং বাংলাদেশের অখণ্ডতা ও মর্যাদা রক্ষার জন্য বাংলাদেশের জনগণের প্রতি উদাত্ত আহ্বান জানান;
এবং
যেহেতু পাকিস্তান কর্তৃপক্ষ বর্বর ও নৃশংস যুদ্ধ পরিচালনা করেছে এবং এখনও বাংলাদেশের বেসামরিক ও নিরস্ত্র জনগণের বিরুদ্ধে নজিরবিহীন গণহত্যা ও নির্যাতন চালাচ্ছে;
এবং
যেহেতু পাকিস্তান সরকার অন্যায় যুদ্ধ ও গণহত্য এবং নানাবিধ নৃশংস অত্যাচার পরিচালনার দ্বারা বাংলাদেশের গণপ্রতিনিধিদের পক্ষে একত্রিত হয়ে শাসনতন্ত্র প্রণয়ন করে জনগণের সরকার প্রতিষ্ঠা করা অসম্ভব করে তুলেছে;
এবং
যেহেতু বাংলাদেশের জনগণ তাদের বীরত্ব, সাহসিকতা ও বিপ্লবী কার্যক্রমের মাধ্যমে বাংলাদেশের উপর তাদের কার্যকরি কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করেছে;
সার্বভৌম ক্ষমতার অধিকারী বাংলাদেশের জনগণ নির্বাচিত প্রতিনিধিদের প্রতি যে ম্যান্ডেট দিয়েছেন সে ম্যান্ডেট মোতাবেক আমরা, নির্বাচিত প্রতিনিধিরা, আমাদের সমবায়ে গণপরিষদ গঠন করে পারষ্পরিক আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে বাংলাদেশের জনগণের জন্য সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করার উদ্দেশ্যে
বাংলাদেশকে একটি সার্বভৌম গণপ্রজাতন্ত্র ঘোষণা করছি এবং এর দ্বারা পূর্বাহ্নে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্বাধীনতা ঘোষণা অনুমোদন করছি; এবং
এতদ্বারা আমরা আরও সিদ্ধান্ত ঘোষণা করছি যে শাসনতন্ত্র প্রণীত না হওয়া পর্যন্ত বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান প্রজাতন্ত্রের রাষ্ট্রপ্রধান এবং সৈয়দ নজরুল ইসলাম উপ-রাষ্ট্রপ্রধান পদে অধিষ্ঠিত থাকবেন; এবং
রাষ্ট্রপ্রধান প্রজাতন্ত্রের সশস্ত্র বাহিনীসমূহের সর্বাধিনায়ক পদে অধিষ্ঠিত থাকবেন; ক্ষমা প্রদর্শনের ক্ষমতাসহ সর্বপ্রকার প্রশাসনিক ও আইন প্রণয়নের ক্ষমতার অধিকারী থাকবেন; এবং
তাঁর কর ধার্য ও অর্থব্যয়ের ক্ষমতা থাকবে; এবং
বাংলাদেশের জনসাধারণের জন্য আইনানুগ ও নিয়মতান্ত্রিক সরকার প্রতিষ্ঠার জন্য অন্যান্য প্রয়োজনীয় সকল ক্ষমতারও তিনি অধিকারী হবেন।
বাংলাদেশের জনগণ দ্বারা নির্বাচিত প্রতিনিধি হিসাবে আমরা আরও সিদ্ধান্ত ঘোষণা করছি যে, কোনো কারণে যদি রাষ্ট্রপ্রধান না থাকেন অথবা যদি রাষ্ট্রপ্রধান কাজে যোগদান করতে না পারেন অথবা তাঁর দায়িত্ব ও কর্তব্য পালনে যদি অক্ষম হন, তবে রাষ্ট্রপ্রধান প্রদত্ত সকল দায়িত্ব উপ-রাষ্ট্রপ্রধান পালন করবেন।
আমরা আরও সিদ্ধান্ত ঘোষণা করছি যে, বিশ্বের একটি জাতি হিসাবে এবং জাতিসংঘের সনদ মোতাবেক আমাদের উপর যে দায়িত্ব ও কর্তব্য বর্তেছে তা যথাযথভাবে আমরা পালন করব।
আমরা আরও সিদ্ধান্ত ঘোষণা করছি যে, আমাদের এই স্বাধীনতার ঘোষণা ১৯৭১ সনের ২৬শে মার্চ থেকে কার্যকর বলে গণ্য হবে।
আমরা আরও সিদ্ধান্ত ঘোষণা করছি যে, আমাদের এই সিদ্ধান্ত কার্যকর করার জন্য আমরা অধ্যাপক এম. ইউসুফ আলীকে যথাযথভাবে রাষ্ট্রপ্রধান ও উপ-রাষ্ট্রপ্রধানের শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠান পরিচালনার জন্য দায়িত্ব অর্পণ ও নিযুক্ত করলাম।
স্বাক্ষর: অধ্যাপক এম. ইউসুফ আলী বাংলাদেশ গণপরিষদের
ক্ষমতা দ্বারা এবং ক্ষমতাবলে
যথাবিধি সর্বাধিক ক্ষমতাধিকারী।
আইনের ধারাবাহিকতা বলবৎকরণ আদেশ ১৯৭১
বাংলাদেশের অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রে প্রদত্ত ক্ষমতাবলে একই দিনে আইনের ধারাবাহিকতা বলবৎকরণ আদেশ নামে একটি আদেশ জারি করেন। ঘোষণাপত্রের সাথে সামঞ্জস্য রেখে ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ পর্যন্ত বাংলাদেশে যে সকল আইন চালু ছিল, তা রক্ষার্থে এই আদেশ বলবৎ করা হয়[২]।
পূর্ণ বিবরণ
আইনের ধারাবাহিকতা বলবৎকরণ আদেশ ১৯৭১[৭]
মুজিবনগর, বাংলাদেশ, ১০ এপ্রিল ১৯৭১, শনিবার ১২ চৈত্র ১৩৭৭
আমি বাংলাদেশের উপ-রাষ্ট্রপতি এবং অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম, স্বাধীনতা ঘোষণাপত্র প্রদত্ত ক্ষমতাবলে ১৯৭১ সালের ১০ এপ্রিল তারিখে এ আদেশ জারি করছি যে, ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ পর্যন্ত বাংলাদেশে যে সকল আইন চালু ছিল, তা ঘোষণাপত্রের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে একইভাবে চালু থাকবে, তবে প্রয়োজনীয় সংশোধনী সার্বভৌম স্বাধীন বাংলাদেশ গঠনের জন্য করা যাবে। এই রাষ্ট্র গঠন বাংলাদেশের জনসাধারণের ইচ্ছায় হয়েছে। এক্ষণে, সকল সরকারি, সামরিক, বেসামরিক, বিচার বিভাগীয় এবং কূটনৈতিক কর্মকর্তা ও কর্মচারী যারা বাংলাদেশের প্রতি আনুগত্যের শপথ গ্রহণ করেছেন, তারা এতদিন পর্যন্ত নিয়োগবিধির আওতায় যে শর্তে কাজে বহাল ছিলেন, সেই একই শর্তে তারা চাকুরিতে বহাল থাকবেন। বাংলাদেশের সীমানায় অবস্থিত সকল জেলা জজ এবং জেলা ম্যাজিস্ট্রেট এবং সকল কূটনৈতিক প্রতিনিধি যারা অন্যত্র অবস্থান করছেন, তারা সকল সরকারি কর্মচারীকে স্ব স্ব এলাকায় আনুগত্যের শপথ গ্রহণের ব্যবস্থা করবেন।
এই আদেশ ১৯৭১ সালের ২৬শে মার্চ থেকে কার্যকর করা হয়েছে বলে গণ্য করতে হবে।
স্বাক্ষর:- সৈয়দ নজরুল ইসলাম
অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি

ক্ষুধাপীড়িত, অত্যাচারিত, শোষণ-লুণ্ঠন-দুর্নীতি জর্জরিত মানুষকে বেঁচে থাকার তাগিদে মুক্তির আকাঙ্খায় নিজ নিজ ভাগ্য পরিবর্তনের প্রেরণায় মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বাম প্রগতিশীল শক্তির পক্ষে জনগণকে ঐক্যবদ্ধ হতে হবে। জনগণকে অবশ্যই স্বাধীনতাপন্থীদের লাল সবুজ ঝান্ডার নিচে ঐক্যবদ্ধ হয়ে সৃষ্টি করতে হবে সর্বহারা-শ্রমিক-কৃষক-খেতমজুর-সাধারণ জনগণের স্বার্থের রাজনৈতিক বিকাশ। জনগণ চাইলে, এই অবস্থার পরিবর্তন হবে। অতীতে প্রগতিশীল শক্তির অংশগ্রহণে যেভাবে জনগণ ইতিহাস সৃষ্টি করেছিল, প্রগতিশীলরা এগিয়ে যাবে আর বাংলাদেশ উন্নত ও সমৃদ্ধ হবে।
গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের প্রথম অন্তর্বর্তীকালীন সংবিধান ‘স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র’, ২য় অন্তর্বর্তীকালীন সংবিধান ও ‘৭২-এর সংবিধানের রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতি এবং নির্দেশনা অনুযায়ী মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বাস্তবায়ন করতে হলে বিদ্যমান শোষণমূলক অার্থ-সামাজিক ব্যবস্থার মৌলিক পরিবর্তন দরকার। দরকার জনগণের মৌলিক মানবিক অধিকার প্রতিষ্ঠায় সুশাসন নিশ্চিত করা। আর সেটি করতে হলে আমাদের বৈষম্যহীন ব্যবস্থা চালু করতে হবে। গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র, ধর্ম নিরপেক্ষতা এবং জাতীয়তাবাদ এই চার নীতিতে দেশকে এগিয়ে নিতে হবে। তাহলেই জনঅাকাঙ্খা পূরণ করা সম্ভব হবে।

-লেখক:মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক গবেষক, সাংবাদিক ও কলামিস্ট।