Home জাতীয় বরিশালে ব্লাকমেইলিংয়ে সংঘবদ্ধচক্র মক্ষীরানীদের ভয়ঙ্কর ফাঁদ!

বরিশালে ব্লাকমেইলিংয়ে সংঘবদ্ধচক্র মক্ষীরানীদের ভয়ঙ্কর ফাঁদ!

77

আহমেদ জালাল : বরিশাল নগরীতে গড়ে উঠছে সংঘবদ্ধ চক্র কর্তৃক মক্ষীরানীদের ভয়ঙ্কর ফাঁদ! এই চক্রটি অর্থ হাতিয়ে নিতে টার্গেট করে ব্লাকমেইলিংয়ে ক্রমেই বেপরোয়া হয়ে উঠছে। ব্ল্যাকমেইল অপসংস্কৃতির বেড়াজালে পড়ছে নানা শ্রেনী পেশার মানুষ। এদের খপ্পড়ে পড়ে নি:স্ব হচ্ছে অসংখ্য যুবক। সম্প্রতি চক্রের খপ্পড়ে পড়া বরিশাল গ্রামীণফােন সেন্টারে কর্মরত রাকিবুল ইসলাম নামের এক যুবককে প্রেমের ফাঁদে ফেলে ব্ল্যাকমেইলে মোটা অঙ্কের অর্থ দাবি করে আসছিল। চক্রের অন্যতম সদস্য মক্ষীরানী হিসেবে পরিচিত সীমা আক্তার নামের এক যুবতির দাবিকৃত অর্থ দিতে অপরগতা প্রকাশ করায় ইতোমধ্যে নারী ও শিশু নির্যাতন মামলায় তাকে ঢুকেও দিয়েছে। সীমা আক্তার কর্তৃক ৫ লাখ টাকা চাঁদা দাবির একটি ভিডিও থানা পুলিশকে দেখানোর পরও প্রতারণার শিকার যুবকের বিরুদ্ধে ধর্ষণের মামলাটি রেকর্ড করে বরিশাল কোতয়ালী মডেল থানা পুলিশ। যে কেউ ব্ল্যাকমেইলিংয়ে মক্ষীরানীদের প্রতারণার পাতা ফাঁদে পড়ে গেলে একতরফা দোষ ভুক্তভোগী পুরুষের ঘাড়েই চেপে বসে! এর কী কোন প্রতিকার আছে? অবশ্য রাজধানীসহ দেশের বিভিন্নস্থানে এরকম সংঘবদ্ধ চক্রের বিষয়ে হার্ডলাইনে অবস্থান করছেন আইন প্রয়োগকারী বাহিনী ও গোয়েন্দা সংস্থাগুলো। এরআগে বরিশালে গোয়েন্দা সংস্থা সংঘবদ্ধ চক্রের বেশ কয়েকজন সদস্যকে আটকও করে। প্রতারক চক্রের সদস্যদের বিরুদ্ধে দায়ের করা হয় মামলা। কিন্তু এই চক্রটি ইদানিং এতোটাই বেপরোয়া হয়ে উঠছে যে আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলোর নাকের ঢগায় দেদারসে প্রতারণা করে চলছে। এবং তাদের নির্ধারিত অর্থ দিতে না পারলে মামলার বেড়াজালে ফাঁসিয়েও দিচ্ছে।
বরিশালে মানবপাচারকারী শাহারিয়ার পাবেল রাকিন গ্রুপ :
বরিশালে সুন্দরী নারীদের দিয়ে ব্ল্যাকমেইলিংয়ে অর্থ হাতিয়ে নিতে কয়েকটি চক্র রয়েছে। এরমধ্যে সংঘবদ্ধ একটি চক্রের হোতা মানবপাচারকারী শাহারিয়ার পাবেল রাকিন। বরিশাল নগর গোয়েন্দা পুলিশ গোপন সংবাদের ভিত্তিতে চলতি বছরের ৩ আগস্ট মঙ্গলবার দুপুরে বরিশাল নগরীর শীতলাখোলা প্যাসেফিক হাউজে অভিযান চালিয়ে নদী, সুবর্না ও শিমুল নামের তিনজনকে আটক করেন। কিন্তু এই চক্রের মূলহোতা শাহারিয়ার পাবেল রাকিন কৌশলে পালিয়ে সক্ষম হন। পরে চক্রের হোতা শাহারিয়ার পাবেল রাকিন, রাকিনের মা ও শিমুলকে আসামি করে নগর গোয়েন্দা পুলিশের এস আই জুম্মান বাদী হয়ে মানবপাচার আইনে বরিশাল কোতোয়ালি মডেল থানায় মামলা দায়ের করেন। ওইসময়ে নগর গোয়েন্দা পুলিশ সাংবাদিকের বলেন, শাহারিয়ার পাবেল রাকিন তাঁর নিজ বাসায় বিভিন্ন নারীদের আনতেন এবং অনৈতিক কর্মকান্ড চালাতেন। অভিযান চলাকালে স্থানীয়রা বলেছিলেন, শাহারিয়ার পাবেল রাকিনের বাসায় প্রতিনিয়ত নারী পুরুষদের আসা যাওয়া এবং অনৈতিক সকল কর্মকান্ডে বিব্রত এলাকাবাসী। রাকিনের এসব কর্মকান্ডে নষ্ট হচ্ছে যুবসমাজ। এহেন সংঘবদ্ধ চক্রের সদস্য কাজিপাড়ার আয়শা, কলেজ এভিনিউ এলাকার সীমা আক্তার, শিমুল, ফারজানা আক্তার ঝুমুরসহ আরো বেশ কয়েকজন।
বরিশালে অশ্লীল ছবি তুলে মুক্তিপণ আদায়কারী চক্রের ঝুমুরসহ ১০ জনকে আটক :
২০২০ সালের ১০ মার্চ প্রেম ও যৌন সম্পর্কের প্রলোভন দেখিয়ে ফাঁদে ফেলে জোর করে অশ্লীল ছবি তুলে মুক্তিপণ আদায়কারী চক্রের ফারজানা আক্তার ঝুমুরসহ ১০ জনকে আটক করতে সক্ষম হন বরিশাল মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ। এ চক্রের অন্যতম সদস্য কলেজছাত্রী ফারজানা আক্তার ঝুমুর দীর্ঘদিন কলেজের বনমালী গাঙ্গুলী ছাত্রী নিবাসে থেকে এ ব্যবসা পরিচালনা করত। পরে তাকে ছাত্রী নিবাস থেকে বের করে দেয়া হলে চক্রের সক্রিয় সদস্য হয়ে উচ্চবিত্তদের টার্গেট করে লাখ লাখ টাকা মুক্তিপণ আদায় করে। ঝুমুর নগরীর ড্রীম হাউজ নামের ব্যাক্তি মালিকানা একটি মেসে বসবাস করেন। মোবাইলে ঠিকাদার সোহেল আল মাসুদ ডেকে এনে সরকারী বরিশাল কলেজের সামনে দেখা করতে বলে পরবর্তীতে অন্তরঙ্গ সময় কাটাবার জন্য এক আত্বীয়ের চ্যাটার্জি লেনের লাবু মিয়ার ভাড়াটিয়ার বাসায় নিয়ে যাবার পর জোড় পূর্বক বিবস্ত্র করেন। এর পরপরই প্রতারক ডিবি পুলিশের পরিচয় দিয়ে অপর চক্রের সদস্য ভিতরে প্রবেশ করে ঠিকাদার সোহেলকে নির্যাতন করে ভয়ভীতি দেখিয়ে অর্থ হাতিয়ে নেয়। ঠিকাদার সোহেল আল মাসুদ ১০ মার্চ সন্ধ্যায় মেট্রোপলিটন পুলিশ কমিশনারের কাছে লিখিত আবেদন দিলে অভিযানে নামে ডিবি পুলিশ। এব্যাপারে ঠিকাদার সোহেল আল মাসুদ বাদী হয়ে একটি মামলা দায়ের করেন। অভিযোগের পেক্ষিতে অভিযান শেষে ১১ মার্চ বুধবার দুপুরে বরিশাল মেট্রোপলিটন পুলিশ কমিশনারের অস্থায়ী কার্যালয়ের সভাকক্ষে নগর বিশেষ শাখার উপ-কমিশনার মো. জুলফিকার আলী হায়দার সংবাদ সম্মেলনে বলেছিলেন, দুই ধাপে ফাঁদে ফেলে উচ্চবিত্তদের কাছ থেকে চাহিদা মাফিক অর্থ হাতিয়ে নেয় এ প্রতারক চক্র। প্রথমে যৌন সম্পর্ক স্থাপনের প্রলোভন দেখিয়ে ভাড়া ফ্লাটে নিয়ে চক্রের কলেজ পড়ুয়া তরুণীদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ অবস্থায় আটক করা হয়। পরে ডিবি পুলিশ পরিচয়ে শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন চালিয়ে অর্থ আদায় করে থাকে। পুলিশের ভাষ্য, শুধু ১০ জনই নয় এ চক্রে স্কুল-কলেজের আরও কিশোরী-তরুণী জড়িত থাকার তথ্য তারা পেয়েছে।
অতিসম্প্রতি প্রতারণার ফাঁদে পড়া রাকিবুল ইসলাম চাঁদাদাবির অর্থ দিতে অপরগতা প্রকাশ করার পর গত ২৯ সেপ্টেম্বর রাতে মক্ষীরানী সিমা আক্তার বরিশাল কোতয়ালী মডেল থানায় বিয়ের প্রলোভন দেখিয়ে ধর্ষণের মামলা করতে যান। ওইসময়ে মক্ষারানী সীমা আক্তার কর্তৃক ৫ লাখ টাকা দাবি করার ভিডিও ওসি নূরুল ইসলামের নখদর্পনে দেওয়া হয়। চাঁদা দাবির ভিডিও দেখে ওসি মো: নূরুল ইসলাম প্রথমে চমকে উঠেন! তাৎক্ষনিক পুলিশের এক কর্মকর্তাকে বলেন, এই মেয়ের বাড়ি বরগুনায় বরিশালে সে কী করে? বিষয়টি খতিয়ে দেখেন। এরপর ওসি এক পুলিশ কর্মকর্তাকে বলেন, ওই ছেলেকে থানায় নিয়ে আসেন। এ কথা বলার পর ওসি বলেন, ছেলেকে থানায় নিয়ে আসলে তো এরেস্ট করতে হবে, থানায় আনার পর ছেড়ে দেওয়াও যাবে না। এসব মেয়েরা খারাপ প্রকৃতির, এদের কাজ-ই প্রতারণার মাধ্যমে অর্থ হাতিয়ে নেওয়া। এই মেয়ের সঙ্গে কথা বলে হাজার ৫০ কিংবা লাখ খানেক টাকা দিলে সমাঝোতা হয়ে যাবে বলে আমি মনে করি। বলেন, আর মামলাও করবে না, টাকা পাওয়ার পর এই ধরণের মেয়েকে আর খুঁজে পাওয়া যাবে না। তৎসময়ে অন্যান্য কয়েক পুলিশ সদস্য এবং থানায় আসা সেবা প্রাথীরা বলেন, এ ধরণের মেয়েরা এসবই করে, ওই মেয়েকে ৫০ হাজার টাকা দিলে সটকে পড়বে। তখন প্রতারণার শিকার যুবকের স্বজন ও ঘনিষ্ঠদের ওসি বলেন, মেয়ের সঙ্গে কথা বলে দেখেন সে কী চায়? মেয়ের সঙ্গে সমাঝোতা করা যায় কিনা? ওই রাতে মেয়ের ভাষ্য : আমি ছেলেকে বিয়ে করতে চাই, এরবাইরে অন্য কিছু চাই না। যদি এই মুহুর্তে বিয়ে করে, সেক্ষেত্রে আমি মামলা করবা না। এরমধ্যে ওসি’র বেশ ব্যস্ততা পরিলক্ষিত হয়। কয়েক মিনিট পর ওসি নুরুল ইসলাম কর্তব্যরত পুলিশ কর্মকর্তাকে বলেন, মামলাটি রেকর্ড করেন। ওসি নুরুল ইসলাম সাংবাদিকদের বলেন, আইনটি এমনভাবে করা হয়েছে, এতে অনেক পুরুষের জীবন ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে। আইনানুযায়ী মামলাটি নিতে হচ্ছে। আইনটি নতুনভাবে ঢেলে সাজানো উচিৎ বলে মন্তব্য করেন ওসি মো: নুরুল ইসলাম। এর কিছুক্ষন পর ওসি সাংবাদিকদের বলেন, মামলাটি অলরেডি রেকর্ড হয়ে গেছে।
৪ অক্টোবর মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা এসআই নিজাম সেলফোনে জানান, বিয়ের প্রলোভন দেখিয়ে ধর্ষণের অভিযোগে মামলাটি দায়ের করা হয়। মামলা নং-৮১/২৯। ওই রাতেই মেয়েকে ওয়ান-ষ্টপ ক্রাইসিস সেন্টার (ওসিসি)তে পাঠানো হয়েছে। তিনি বলেন, মামলার তদন্ত চলছে। তিনি আরো জানান, আসামিকে গ্রেপ্তারের চেষ্টা চলছে।
বলাবাহুল্য : এরআগে মক্ষীরানী সীমা আক্তার চাঁদা দাবি প্রসঙ্গে সাংবাদিকদের বলেন, ওটা একটি মেয়ের সঙ্গে ফোনে কথা বলেছিলাম, তখন যে সে এটা রেকর্ড করবে তা তো বুঝিনি।
কে এই সীমা আক্তার?
বরগুনা জেলার বেতাগী থানার লতাবাড়িয়া এলাকার তৈয়ব আলী ও রাশিদা বেগম দম্পত্তির মেয়ে সীমা আক্তার। বর্তমান ঠিকানা : নগরীর কলেজ এভিনিউ এলাকার সৃতাস্মৃিতনী বাড়ির ভাড়াটিয়া। আশা ওরফে আয়শা, সীমা আক্তার, তানহা, রাবেয়া, কাজল বেগম, ফারজানা আক্তার ঝুমুর কখনো বিভক্ত হয়ে কখনো সংঘবদ্ধভাবে নানা কায়দায় প্রতারণার ফাঁদে ফেলে অর্থ হাতিয়ে নিচ্ছে। চক্রের সদস্য আয়শার বিরুদ্ধে রয়েছে প্রতারণার ফাঁদে ফেলে অর্থ হাতিয়ে নেয়ার অসংখ্য অভিযোগ। সাম্প্রতিক সময়ে আয়শার করা একটি ভিডিও ভাইরাল হয়।
ভিডিওতে অভিযুক্ত সীমা আক্তার বলেন ‘আমি রকিবুলের কাছে ৫ লাখ টাকা চাইছি, নিচে হলেও তো ৩ লাখ টাকা দেবেই। আর ওর টাকা না দিয়ে উপায়ও নাই। এরআগে বিপ্লব (আরেক ভুক্তভোগী ও সনামধন্য ব্যবসায়ী) ও টাকা দিয়া পা ধরছে, টাকা না দিয়া যাইবে কই? দিতে দেরি করলে নারী শিশু নির্যাতন মামলা দিয়া ডাবল আদায় করমু, জেল খাইটা বুঝবে।’
ব্লাকমেইলের শিকার রাকিবুল ইসলাম বলেন, বরিশালে গ্রামীণ ফোন কাষ্টমার কেয়ারে কর্মরত শাকিলের ঘনিষ্ঠ সীমা আক্তার। আমাকে সীমা আক্তার নামের ওই মেয়ের সঙ্গে প্রথমে শাকিল পরিচয় করিয়ে দেন। এরপর আমাকে প্রেমের ফাঁদে ফেলে চক্রটি হাতিয়ে নিয়েছে দফায় দফায় অর্থ। বন্ধুত্বের সুবাদে প্রেমের প্রস্তাব। প্রতারণার পাতা ফাঁদে ফেলে অশ্লীল ছবি ও ভিডিও করে। অত:পর ব্লাকমেইলিং এর ফাঁদে ফেলে ৫ লাখ টাকা দাবি করে। অন্যান্য ভুক্তভোগীদের সন্ধান পেয়ে আমি প্রতিবাদ করি ও টাকা ফেরৎ চাই। আমি প্রতিবাদ করলে আমাকে থানায় একটি মিথ্যা মামলাতে ফাঁসানো হয়। তাঁর দাবিকৃত অর্থ দিতে অপরগতা প্রকাশসহ প্রতিবাদ করায় মিথ্যা মামলায় আমাকে জড়িয়ে দেয়া হয়।
৫ লাখ টাকা দাবি প্রসঙ্গে সীমা আক্তার বলেন, আমি আয়শাকে বিশ্বাস করে ওভাবে বলেছি। তা ভিডিও হচ্ছে জানতামনা। আমি এ বিষয়ে আর কোন মন্তব্য করতে চাইছিনা।
এদিকে, বরিশাল নগরীর বিভিন্ন আবাসিক হোটেলে পতিতাবৃত্তি বা দেহ ব্যবসা চলে আসছিল। আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর কঠোর নজরদারীর কারণে আবাসিক হোটেলে দেহ ব্যবসা বন্ধ হয়ে যায়। বিশেষ করে বরিশাল মেট্রোপলিটন পুলিশ কমিশনার মোঃ শাহাবুদ্দিন খান বিপিএম-বার বিএমপিতে যোগদানের পর পতিতাবৃত্তি বন্ধে হার্ড লাইনে অবস্থান গ্রহন করেন। এরফলে এখানকার চিহৃিত আবাসিক হোটেলগুলোতে পতিতা বাণিজ্য বন্ধ হয়ে যায়। আবাসিক হোটেলগুলোতে পতিতা বাণিজ্য বন্ধ হয়ে গেলে নগরীতে পতিতা বা মক্ষীরানীদের দিয়ে নয়া পরিকল্পনায় গড়ে উঠে এক সংঘবদ্ধ চক্র। অবশ্য এই চক্রটি আরো আগ থেকেই ব্ল্যাকমেইলিংয়ের মাধ্যমে লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নিতে গড়ে উঠে। এই চক্রের সদস্যরা বিভিন্ন গ্রুপে বিভক্ত হয়ে মক্ষীরানীদের ব্যবহার করে দিনে দিনে বেপরোয়া হয়ে উঠেছে।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, বরিশাল নগরীর বিভিন্ন এলাকার বিভিন্ন ফ্ল্যাট ভাড়া নিয়ে চক্রের সদস্যরা পতিতাবৃত্তিকে সামনে রেখে ইয়াবার রমরমা বাণিজ্যও চালিয়ে আসার অভিযোগ মিলেছে। এদের পোশাকে, চলনে থাকে আভিজাত্যের ছাপ। তাদের টার্গেট বিত্তশালীরা। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে গভীর সখ্যতা গড়ে তোলে। মোবাইল ফোন নম্বর সংগ্রহ করে যৌন উত্তেজক কথা বলে। বশে আনার জন্য নানা কৌশল অবলম্বন করে। লোভ দেখানো হয় একান্ত আপন করে পাবার। আয়োজন করা হয় ঘরোয়া পার্টির। এহেন সুন্দরীদের রূপ লাবণ্যে মুগ্ধ সবাই, কিন্তু বিপত্তি ঘটে তখনই যখন কেউ কোনও ভয়ঙ্কর সুন্দরীর ফাঁদে পড়ে যান! তবুও কখনো কখনো একতরফা দোষ ভুক্তভোগী পুরুষের ঘাড়েই চেপে বসে। নারী সদস্যরা কখনো প্রেমের ফাঁদে ফেলে, কখনো সময় কাটানোর নামে টার্গেট করা ব্যক্তিকে ডেকে নিয়ে আসছেন তাদের নির্ধারিত ফ্ল্যাটে। এরপর ভিকটিমকে বিবস্ত্র করে তার পাশে চক্রের নারী সদস্যদের বিবস্ত্র অবস্থায় রেখে তোলা হচ্ছে ছবি; কেড়ে নেওয়া হচ্ছে সর্বস্ব। এখানেই শেষ নয়। বিবস্ত্র সেই ছবি কখনো ইন্টারনেটে ছড়িয়ে দেওয়ার ভয় দেখিয়ে, কখনো পত্রিকায় ছাপানোর কথা বলে কখনো-বা নারী নির্যাতন মামলায় ফাঁসিয়ে দেওয়ার হুমকি দিয়ে ভুক্তভোগীর কাছ থেকে দফায় দফায় হাতিয়ে নিচ্ছে তারা কাঁড়ি কাঁড়ি টাকা। গোপনে ধারণ করা ভিডিও প্রতারক চক্রের কাছে থাকায় অধিকাংশ ভুক্তভোগী পরিবার ও সামাজিক মর্যাদার ভয়ে প্রতারকদের কাছে নিঃস্ব হয়েও মুখ খুলছেন না। অভিযোগ, এসব চক্রের সদস্যদের আশ্রয়-প্রশ্রয় দিচ্ছে অসাধু কিছু পুলিশ সদস্য, স্থানীয় সন্ত্রাস প্রকৃতির লোকজন, মাদক ব্যবসায়ী। এ যেনো এক নাটকের দৃশ্য! সেই নাটক জমিয়ে তোলেন কোনো এক সুন্দরী নারী। এসব কুশীলব চিত্রায়িত নাটকে একজন হন ভুক্তভোগী। তবে তিনি নাটকের ভুক্তভোগী নন, বাস্তবেই। মূলত: ভুক্তভোগী ছাড়া অন্য যারা, স্থানীয় মাস্তান, মাদক ব্যবসায়ী, অসাধু পুলিশ, সাংবাদিক যা-ই হোক-তারা সবাই একটি চক্রের সদস্য। সবার উদ্দেশ্য একটাই-ব্ল্যাকমেইলিং। টার্গেট তাদের ধনাঢ্য ব্যক্তি, বড় ব্যবসায়ী, চাকরিজীবী কিংবা রাজনীতিবিদ। পুলিশ ও সাংবাদিকের বেশভূষা-সবই আছে তাদের কাছে। ব্লাকমেইলিংয়ের নাটক সাজাতে এসব চক্রের পুরুষ সদস্যরা পরিস্থিতি বুঝে কেউ বনে যায় সাংবাদিক, কেউ বা আবার সাজেন পুলিশ কর্তা।
অনুসন্ধানী সূত্রগুলো বলছে, অনেক ক্ষেত্রে এসব মক্ষীরানীরা ভুয়া পরিচয় দিয়ে বাসা ভাড়া করে থাকেন। স্বামী-স্ত্রী পরিচয় দিয়ে বাসা ভাড়া করলেও আসলে স্বামীর পরিচয় দানকারী ব্যক্তিটি থাকে দালাল। এদের পোশাক-পরিচ্ছদে এবং আচার-আচরণে বোঝার উপায় নেই যে এরা দেহ ব্যবসার সঙ্গে জড়িত। এরা বিভিন্ন লেবাসে ঘুরে বেড়ায়। এমনকি আশেপাশের বাসিন্দারাও সহজে এদের অপকীর্তি বুঝতে পারে না। খদ্দেররা যখন বাসায় যাতায়াত করে তখন আত্মীয়ের পরিচয় দিয়ে দেহ ব্যবসায়ীদের বাসায় নির্বিঘ্নে যাতায়াত করে। হাতে থাকে মিষ্টি কিংবা ফলের প্যাকেট। দেখে মনে হবে কেউ বেড়াতে এসেছে। খদ্দেররা কখনোই একসাথে আসে না, মোবাইল ফোনের মাধ্যমে যোগাযোগ করে তাদের আসার সময় জানানো হয়। একজন চলে গেলে অন্য একজন আসে। এসব ফ্ল্যাটে রাখা হয় মক্ষীরানীদের। দেহব্যবসা কিংবা মক্ষীরানীদের ব্যাপারে এলাকার কেউ জেনে ফেললে কিংবা পরিচয় ফাঁস হওয়ার উপক্রম হলে তারা বাসা পাল্টিয়ে ফেলে। এসব মক্ষীরাণীরা যখন যে এলাকায় ফ্ল্যাট ভাড়া নেয় সে এলাকার উঠতি সন্ত্রাসীদের হাত করে নেয়। আবার খদ্দের ধরার জন্য এদের রয়েছে একাধিক দালাল। অভিযোগ রয়েছে, দেহ ব্যবসায়ীদের সহযোগী সন্ত্রাসীরা অনেক ক্ষেত্রে বিত্তবান কিংবা সমাজে প্রতিষ্ঠিত ব্যক্তিদেরকে পতিতাদের সাথে উলঙ্গ ছবি তুলে ব্ল্যাকমেইল করে থাকে। সামাজিক মান ইজ্জতের ভয়ে ওই ব্যক্তিরা সন্ত্রাসীদের চাহিদা মোতাবেক মোটা অংকের টাকা প্রদান করতে বাধ্য হয়। মান-সম্মানের ভয়ে খপ্পড়ে পড়া ব্যক্তিরা বিষয়টি গোপন রেখেছেন, আর তারা বোবা কান্নায় ভেঙ্গে পড়ছেন। অনেকেই এহেন মক্ষীরানীদের খপ্পড়ে পড়ে সর্বশান্ত হচ্ছে। আর হতাশাগ্রস্ত হয়ে অমানবিক জীবনযাপন করছেন এই সংঘবদ্ধ চক্রের খপ্পড়ে পড়া যুবকরা।
যদিও রাজধানীতে এরকম সংঘবদ্ধ চক্রের বিষয়ে কঠোর অবস্থান করছেন আইন প্রয়োগকারী বাহিনী ও গোয়েন্দা সংস্থাগুলো। রাজধানীর মিরপুর বিভাগের কয়েকটি থানা এলাকায় সুন্দরী নারী দিয়ে এমন ভয়ঙ্কর প্রতারণার ফাঁদ পাতে একাধিক প্রতারক চক্র। পুলিশের মিরপুর বিভাগের পল্লবী ও রূপনগর থানা এলাকায় সুন্দরী নারী দিয়ে প্রতারক চক্রের ব্লাকমেইলিংয়ের শিকার হয়ে সর্বস্ব খুইয়েছেন দুজন। চলতি বছরের এপ্রিল মাসে পল্লবী ও রূপনগর থানায় প্রতারক দুই চক্রের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করেন ভুক্তভোগী পদ্মা ব্যাংকের ভাইস প্রেসিডেন্ট মো. তারিকুল ইসলাম খান ও মিরপুর ডিওএইচএস কম্পিউটার নেটওয়ার্ক সিস্টেমস লিমিটেডের কর্মকর্তা মো. ফয়সাল। পৃথক ঘটনায় প্রতারক চক্রের নারী-পুরুষ ৬ সদস্যকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। গ্রেপ্তারকৃতরা হলেন মাদক (হেরোইন) সেবনের দায়ে বরখাস্তকৃত উপপুলিশ পরিদর্শক (এসআই) মোহাম্মদ আছাদুজ্জামান ওরফে আছাদ, জয়নাল, মেহেদী, আদনান, মো. শহিদুল ইসলাম ও মোসা. জারিয়া রহমান ওরফে সাথী আক্তার। পুলিশ তাদের কাছ থেকে মোবাইল ফোন, এটিএম কার্ড ও স্ট্যাম্প জব্দ করে। এছাড়া ১১ বছর ধরে বিয়ের নামে প্রতারণা করে আসছিলেন জান্নাত ওরফে জান্নাতুল ফেরদৌস। নাজির উদ্দিন নামে এক ভুক্তভোগী গত বছরের ১৭ সেপ্টেম্বর গুলশান থানায় মামলা দায়ের করেন। মামলা দায়েরের পর অভিযোগের ভিত্তিতে ওইদিন বিকেলে রাজধানীর গুলশান এলাকা থেকে তাকে গ্রেপ্তার করে সিআইডি।
সবমিলিয়ে বরিশালের সচেতনমহল মনে করেন আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর অনুসন্ধানে বেরিয়ে আসবে মক্ষীরানী চক্রটির নাম তালিকা ও প্রতারণার মাধ্যমে অর্থ আদায়ের হিসাব। বেরিয়ে আসবে থলের বিড়াল।