Home মতামত ফল কেন এত মিষ্টিমধুর

ফল কেন এত মিষ্টিমধুর

44

আব্দুল কাইয়ুম:

শুনলে অনেকেই হয়তো বিশ্বাস করবেন না, এমন মিষ্টিমধুর না হলে হয়তো ফলের গাছ পৃথিবীতে বিলুপ্ত হয়ে যেত। তখন আর আম, লিচু, কাঁঠাল এবং আরও আরও মিষ্টিমধুর ফল খাওয়ার সৌভাগ্য থেকে আমরা বঞ্চিত হতাম। প্রশ্ন হলো, মিষ্টি স্বাদ এক জিনিস আর ফলের গাছ টিকে থাকা আরেক ব্যাপার। এ দুয়ের মধ্যে কী এমন সম্পর্ক যে একটা না থাকলে আরেকটা বিলুপ্ত হয়ে যাবে? এর কারণ হলো, আকর্ষণীয় রং, রস আর সুগন্ধের কারণেই আমরা মজা করে ফল খাই। আর মানুষ শুধু না, অনেক পশুপাখিও ফল খায়। এরপর দূরে গিয়ে ফলের বীজ মাটিতে ফেলে। সেই বীজ থেকে নতুন গাছ জন্মায়। যদি মিষ্টি না হতো, তাহলে কেউ একটা টোকাও দিত না। পাখিও ঠোকর দিত না। গাছের ফল গাছেই পচে নষ্ট হতো। হয়তো শুধু সেই গাছতলায় আবার কয়েকটি গাছ হতো। ব্যস। এরপর ধীরে ধীরে ওই গাছ বিলুপ্ত হয়ে যেত।

ব্যাপারটা খুব সহজ মনে হলেও আসলে তত সহজ নয়। কেউ প্রশ্ন করবেন, গাছের কি এত বুদ্ধি? সে কীভাবে টের পেয়েছে যে মানুষ ও পশুপাখি মিষ্টি পছন্দ করে, তাই দূরদূরান্তে তাদের গাছের পরিসর ছড়িয়ে দিতে হলে মিষ্টি ফল তৈরি করতে হবে? সেটা নিশ্চয়ই না। গাছের এত জ্ঞান নেই। সুতরাং, সাদামাঠাভাবে যদি বলি, সবাই যেন খায় সে জন্যই গাছ বিশেষ যত্ন করে স্বাদে-গন্ধে অতুলনীয় সুস্বাদু ফল তৈরি করে, তাহলে সেটা ঠিক হবে না। বরং বলা যায়, আদি যুগে অনেক গাছেই হয়তো টক, তিতা বা বিষাক্ত ধরনের ফল ধরত। কিন্তু সেসব ফল খাওয়ার আগ্রহ পশুপাখির থাকত না। অন্যদিকে জিনগত রূপান্তরের মাধ্যমে অনেক গাছে মিষ্টি ফলও ধরত। ওই সব ফলই মানুষ ও পশুপাখি পেট ভরে খেত। আর দূরদূরান্তে ফলের বীজ ছড়িয়ে পড়ত। কালক্রমে তিতা, টক, বিষাক্ত গাছ ক্রমে প্রায় বিলুপ্তির পথে চলে যায়। টিকে থাকে সুস্বাদু, সুমিষ্ট ফলের গাছ, এভাবেই বরং বলা ভালো। এটা বিজ্ঞানসম্মত ব্যাখ্যা।

তাহলে এত নিমগাছ টিকে আছে কীভাবে
এটাও ঠিক। নিম যে যমতিতা, সেটা কে না জানে? তাহলে সেই গাছ টিকে আছে কীভাবে? কেউ তো নিম খেতে চায় না! এটা আসলে নিমের ঔষধিগুণের ব্যাপার। যে বাসায় নিমগাছ থাকে, সেখানে অসুখ-বিসুখ কম হয়। মানুষ অভিজ্ঞতা থেকে এটা শিখেছে। তাই অনেকে যত্ন করে বাসায় নিমের চারা লাগায়। নিমের যদি ঔষধিগুণ না থাকত, তাহলে সেটাও হয়তো উধাও হয়ে যেত। নিমপাতার অনেক গুণ। একইভাবে তুলসীগাছেরও কদর বেড়েছে। অনেক পশুপাখিও দেখেছে নিমপাতার অনেক গুণ। দেখা যায়, পেটের অসুখ হলে অনেক পশু কিছু গাছের লতাপাতা খায়। যদিও ওই সব গাছের পাতা বা ফল খুব বিস্বাদ লাগে, তাও অসুখ ভালো করার জন্যই সেসব ফল খায়। কারণ বাঘ, সিংহ, বানরের তো ডাক্তার থাকে না। নিজেদের চিকিৎসা নিজেরাই করে। তাই ঔষধি গাছের প্রজাতি তাদের ফলের গুণে নয়, ঔষধিগুণের জন্য টিকে থাকে বেশ ভালোভাবেই।

নারকেলের গুণটা কী
ডাব-নারকেলের অনেক গুণ। কিন্তু সমস্যা হলো, আদিম যুগে মানুষ বা পশুপাখির পক্ষে ডাবের পানি বা নারকেলের গুণ বোঝা কঠিন ছিল। কারণ, ডাবগাছে ওঠা কঠিন, আর ডাবের খোসা ছাড়ানো আরও কঠিন। নারকেল তো আরও কঠিন ব্যাপার। তাহলে এই প্রজাতির গাছ টিকে থাকল কীভাবে?

ভালো প্রশ্ন। এর পেছনে একটা লক্ষণীয় ব্যাপার আছে। দেখা যায়, সমুদ্র বা নদীর তীরেই এসব গাছ আদিমকাল থেকে বেশি জন্মেছে। এর সুবিধা হলো, পাকার পর গাছ থেকে নারকেল নদী বা সাগরে পড়ে এবং পানির স্রোতে ভেসে গিয়ে উপকূলে অন্য এলাকায় নতুন গাছ জন্ম দেয়। এভাবে তাদের বংশ টিকে থাকে। পরে মানুষ তার স্বাদ ও ঔষধিগুণ টের পেয়ে সযত্নে শহর-গ্রাম-গঞ্জে নিয়ে আসে। লক্ষ করলে দেখব, নারকেলগাছের পাতাগুলো হাতের আঙুলের মতো ফাঁকা ফাঁকাভাবে ছড়ানো। কারণ, নদী বা সাগর পাড়ে সব সময় বাতাসের প্রবাহ থাকে। পাতার ফাঁক দিয়ে বাতাস চলে যায়, গাছ বেঁচে থাকে। এটাও নারকেলগাছের টিকে থাকার একটা সুবিধা।

ফলের আরও কিছু ব্যাপার আছে। যেমন আম-কাঁঠালের বীজের চারপাশে অনেক সুস্বাদু শ্বাস থাকে, যা মূলত ফলের প্রধান আকর্ষণ। এরও অন্য একধরনের উপকার গাছ পায়। যেমন একটা বানর গাছ থেকে একটা পাকা আম নিয়ে দূরে কোনো গাছের ওপর বসে খেতে শুরু করল। এমন সময় হয়তো আরেকটা খাবারের সন্ধান পেয়ে আধখাওয়া আমটা মাটিতে ফেলে ছুট দিল। তখন মাটিতে আমের বীজের চারপাশের সুমিষ্ট শ্বাস নতুন চারার জন্য সার হিসেবে কাজ করে। তা ছাড়া পশুপাখি বা মানুষ ফল খেয়ে পরিপাকের পর যে বর্জ্য ত্যাগ করে, সেটাও ভালো সার হিসেবে কাজ করে। এভাবে বীজের সার হিসেবেও ফলের সুফল গাছ পায়।

তাই আমরা বলতেই পারি, আম, লিচু, কাঁঠালসহ আরও সব ফল যদি সুমিষ্ট স্বাদ, মনমাতানো গন্ধ ও আকর্ষণীয় রঙের না হতো, তাহলে হয়তো এসব গাছের টিকে থাকাই কঠিন হতো।-লেখক: প্রথম আলোর সহযোগী সম্পাদক ও মাসিক ম্যাগাজিন বিজ্ঞানচিন্তার সম্পাদক।-প্রথম আলো