Home মতামত প্রান্তজনের জেল জীবনঃ ষোড়শ কিস্তি

প্রান্তজনের জেল জীবনঃ ষোড়শ কিস্তি

65

সাইফুল ইসলাম শিশির: ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার, কেরানীগঞ্জ, ঢাকা। গ্রিন প্রজেক্টের অফিসে বসে জাহাঙ্গীর আলমকে বললাম, কামাল সাহেবের এই ব্যাতিক্রমধর্মী উদ্যোগ আমাকে অভিভূত করেছে। আমি তাঁর সাথে দেখা করে আমার কৃতজ্ঞতা টুকু শুধু জানাতে চাই।
দেখা করতে চাইলেই এ ধরনের অতি গুরুত্বপূর্ণ বন্দিদের সাথে দেখা করা যায়না। জেল কর্তৃপক্ষের অনুমোদন, যার সাথে দেখা করতে চাই তার সম্মতি, এরপর নিরাপত্তার বিষয়টা তো আছেই। জাহাঙ্গীর আলমের পরামর্শ অনুযায়ী নিজের পরিচয় দিয়ে কামাল সাহেবকে ছোট্ট একটা চিরকুট লিখলাম। এখন শুধু প্রত্যাশার পালা। অনেকগুলো শর্ত পূরণ হলে তবেই মিলতে পারে সাক্ষাৎ এর সুযোগ।
হঠাৎ করে এক পাগলের কথা মনে পড়ল। সে রাস্তার মধ্যে দাঁড়িয়ে খালি গা হয়ে প্রায়শই হাতের মাসল শো করে আর স্বগতোক্তি করে – “আয়! আয়!!” পাগলকে একদিন এক রসিকজন জিজ্ঞেস করে, তুই তো খুব বাহাদুরি দেখাস। অমুকের সাথে মারামারি করতে পারবি ? পাগল একটু চিন্তা করে। তিন আঙ্গুল তুলে দেখায়, আর হাসে। এর শানেনজুল হলো সে পারবে। তবে তিনটা শর্ত আছেঃ ১. যার সাথে সে লড়বে তার হাত থাকবে খালি, পাগলের হাতে থাকবে একখানা লাঠি। ২. গলিটা হবে চিপা। ৩. সে হাঁটবে আগে আগে আর পাগল হাঁটবে পিছে পিছে। পিছন থেকে পাগল তার মাথায় মারবে বাড়ি। ব্যস! এতো শর্ত পূরণ হলে তারপর সে পারে।
দু’তিনদিন কোন খোঁজ না পেয়ে গ্রিন প্রজেক্টে গেলাম। জাহাঙ্গীর আলমকে খোঁজ করতেই শুনি, সে গতকাল জামিনে মুক্তি পেয়ে চলে গেছে। আমি একটু বিস্মিত ও আশাহত হলাম। ক’দিনের মধ্যেই তার সাথে আমার একটা চমৎকার সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল।
জেলখানা এক আজব জায়গা। এখানে কে কখন আসে, কখন কে চলে যায়, তার কোন ঠিক ঠিকানা নেই। যে মানুষ বুকের নিচে বালিশ নিয়ে ছটফট করে, শুয়ে- বসে ঝিমায়। মগডালে বসে থাকা ঘুঘুর ন্যায়। যেই শুনে জামিন হয়েছে, অমনি সব ফেলে রেখে দে- দৌড়। কত লোকের যে স্যান্ডেল, জুতা অদলবদল হয়েছে, কাপড়- চোপড় রেখে গেছে। তার কোন ইয়ত্তা নেই।
কর্ণফুলী বিল্ডিংয়ে ৩/৭ নম্বর ওয়ার্ডে দুপুরে শুয়ে ভাতঘুম দিচ্ছিলাম। এমন সময় এক সিআইডি বাবু এসে জানতে চাইল আপনি কি কাজী সালিমুল হক কামাল সাহেবের সাথে দেখা করতে চান? কারণ কী ? পূর্ব পরিচয় আছে কিনা? ইত্যাদি ইত্যাদি। বুঝলাম দেখা করার সম্ভাবনা একেবারে উবে যায়নি।
পরদিন বেলা ১১টার দিকে সিআইডি বাবু এসে সূর্যমূখী ভিআইপি সেলে নিয়ে গেলেন। এখানে হাই প্রফাইল প্রিজনারদের বিশেষ নিরাপত্তা দিয়ে রাখা হয়েছে। নিশ্চিছদ্র নিরাপত্তা ব্যুহ। ছিমছাম পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন পরিবেশ। চারিদিকে সবুজের ছড়াছড়ি।
৩য় তলার প্রসস্থ বারান্দায় সোফাসেট- চেয়ার টেবিল দিয়ে ওয়েটিং রুম করা হয়েছে। পরিচয় হলো চল্লিশোর্ধ্ব এক ভদ্রলোকের সাথে। মোঃ মনির হোসেন, তিনি একদা ঢাকার মেয়র সাদেক হোসেন খোকার এপিএস ছিলেন। জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলার একজন দণ্ডপ্রাপ্ত আসামি। জানতে চাইলেন, “কামাল স্যারের কাছে এসেছেন? উনি ওয়াস রুমে আছেন। একটু বসেন।” বুঝলাম এপিএস সর্বদাই এপিএস।
সৈম্য সুন্দর এক ভদ্রলোক এগিয়ে এলেন। বুঝতে অসুবিধা হলোনা ইনি কাজী সালিমুল হক কামাল। সমীহ জাগানিয়া এক ব্যক্তিত্ব। সালাম বিনিময়- পরিচয় পর্ব শেষে তিনি বিশেষ চেয়ারটিতে বসলেন। সবিনয়ে বললেন তাঁর পায়ে সামান্য একটু সমস্যা আছে। সামনে টুলের উপর পা-টা রাখতে হবে। শুরুতেই আমি গ্রিন প্রজেক্ট এর নান্দনিক দিক ও অপরিহার্যতার কথা- আমার কৃতজ্ঞতার কথা জানালাম। আলাপ চারিতায় বেরিয়ে এলো একজন সালিমুল হক কামাল ও GQ কোম্পানি গড়ে ওঠা, এক আকাশ ছোঁয়ার কাহিনী।
পরিচয়েই বুঝলাম তার মধ্যে এক দারুণ লিডারশীপ কোয়ালিটি এবং সম্মহনি ক্ষমতা আছে। যা মানুষকে টানে, ইঞ্জিনের মতো। ইঞ্জিন নিজে চলে অন্য ২০-৩০টা বগীকেও টেনে নিয়ে যায়।

চলবে —-

৩০ জুন ২০২১ খ্রিস্টাব্দ
লেক সার্কাস উত্তর ধানমণ্ডি
ঢাকা – ১২০৫

*মতামত বিভাগে প্রকাশিত সকল লেখাই লেখকের নিজস্ব ব্যক্তিগত বক্তব্য বা মতামত।