Home মতামত প্রাণ খুলে কথা বলার একটাই তো ভাষা!!

প্রাণ খুলে কথা বলার একটাই তো ভাষা!!

32

সরদার মোঃ শাহীন:

বহু বছর আগের কথা। জাপানে প্রথম আসার প্রথম দিনের কথা। বিপদে পড়েছিলাম প্রথম দিনেই। অবশ্য জাস্ট বিপদ নয়; মহা বিপদ। এবং যে জিনিসটি নিয়ে মহাবিপদে পড়েছিলাম, তা হলো ভাষা। মহা কঠিন বিদঘুটে জাপানীজ ভাষা। চারপাশে যে যাই বলছে, কিছুই বুঝি না। কেবল এইটুকু বুঝতে পারছিলাম, ওদের ভাষার মধ্যে ভুলেও ভুল করে কেউ একটি ইংরেজী শব্দও ব্যবহার করছে না।

অন্তত ইয়েস কিংবা নো শব্দ দুটিও না। বিদেশী ভাষা যৎসামান্য ব্যবহার ছাড়াও যে কোন ভাষা চলতে পারে, সেটা সেই প্রথম দিনেই টের পেয়েছিলাম। সময়টা ১৯৯৫ সাল। জুলাইয়ের ৭ তারিখ কাকডাকা ভোরে নারিতা এয়ারপোর্টে নেমেছি। কি চমৎকার ছিমছাম এয়ারপোর্ট। প্রশান্ত মহাসাগরের একেবারে তীর ঘেঁষে বিশাল এয়ারপোর্ট। তখনকার চোখেও যেমনি বিশাল, এখনকার চোখেও।

সমস্যা হলো, প্লেন থেকে নেমে কোনদিকে যাবো বুঝতে পারছি না। বুঝবো কিভাবে! জীবনে কোনদিন কি বিদেশে গেছি যে বুঝবো! চক্ষু মেলে অবাক বিস্ময়ে দেখছি, ডান বাম দু’দিকেই বিশাল টার্মিনাল ভবন। যার শুরু আছে, কিন্তু শেষ নেই। কোনদিকে যাবো, কি করবো কিছুই বুঝতে পারছি না। অবশেষে এদিক ওদিক বার কয়েক তাকিয়ে বুদ্ধি করে সবাই যেদিকে হাঁটে আমিও সেদিকেই হাঁটা ধরলাম।

বিপত্তি বাঁধলো মোটামুটি মাঝপথে এসে। দু’দিকে চলে যাওয়া আলাদা দুটি পথ মাঝপথে। পথদুটি ধরে একদল বামে যাচ্ছে আর একদল ডানে। আমার সামনে থাকা সাথীরাও যাচ্ছে। আমি বুঝি না বলে, যেতে পারছি না। উপরের নির্দেশিকা বোর্ডে যা কিছু লেখা তার আগামাথা বোঝার ক্ষমতা সেই দিনটিতে এই অধমের ছিলনা। ছবির মত করে পেঁচিয়ে পেঁচিয়ে কি সব হাবিজুবি লেখা। বুঝলাম ইহাই জাপানীজ ভাষা।

যারা জাপানী কিংবা বিদেশী অথচ টুকটাক জাপানীজ পড়তে পারে তাদের জন্যে নির্দেশিকাই যথেষ্ঠ। কিন্তু যারা পারে না, বা আমার মত নতুন, তাদের সমস্যা প্রকট। দেখলাম, পথের ঠিক মাঝখানে একজন জাপানীজ দাঁড়িয়ে মুখেও নির্দেশনা দিয়ে যাচ্ছেন। প্রথমে না বুঝলেও কিছুক্ষণ শুনে বুঝতে পারলাম মানুষটি দু’টো আলাদা ভাষাতেও নির্দেশনা দিচ্ছেন। দু’টো ভাষার একটি জাপানীজ আর অন্যটি ইংরেজী।

কিন্তু উচ্চারণ ঘটিত সমস্যার কারণে তার মুখের ইংরেজী আমার বুঝতে সমস্যা হচ্ছিল। তার বলা জাপানীজ আর ইংরেজীকে আলাদা করতে আমার সময় লেগেছে। অবশেষে একটু দাঁড়িয়ে ভাল করে শুনে আধা আধা বুঝতে পারি তিনি কি বলছেন। তার বলা ইংরেজীকেও আমার মত অধমের কাছে জাপানীজই মনে হয়েছিল। এটা এখনও হয়। অধিকাংশ জাপানীজই ইংরেজীতে কঠিন রকমের দুর্বল। ইংরেজীতে ভীষণ রকমের দুর্বলতাটা জাপানীজদের মজ্জাগত।

এটা তারা নিজেরাও বোঝে। বোঝে বলেই বহির্বিশ্বে চলতে যেয়ে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই দোভাষী ব্যবহার করে। চলতে যাওয়া বলতে আমি ব্যবসা বাণিজ্য এবং ট্যুরিজমকে বুঝিয়েছি। তবে দোভাষী পোক্ত না হলেও বিপদ আছে। মহা বিভ্রান্তিও হয়। বিভ্রাট হয়। শুধু জাপানে নয়, ভাষা ঘটিত বিভ্রাট সব দেশেই হয়। উন্নত বিশ্বের সবাই নিজের ভাষায় থাকতে চায়। নিজের ভাষায় কথা বলতে চায়। এটা কিছুটা গোড়ামীর হলেও গরিমারও বিষয়। কোথায়ও কোথায়ও অহংকারেরও।

তবে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে চলতে গেলে আজকের বিশ্বে অন্তত ইংরেজীটা ভাল করেই জানা দরকার। না হলেই বিপত্তিটা বাঁধে। বড় রকমের অস্বস্তিকর অবস্থার তৈরী হয়। একবার এই জাপানেই এক মহা অস্বস্তিকর বিভ্রাট ঘটেছিল। জি৭ সামিট হচ্ছে জাপানের ওকিনাওয়াতে। শিল্পে উন্নত পৃথিবীর সেরা ৭টি দেশের প্রধানগণ অংশ নেবেন সামিটে। তাঁদের সবাইকে এয়ারপোর্টে রিসিভ করার জন্যে জাপানীজ তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী মিঃ মরি সকাল থেকেই অপেক্ষমান। একের পর এক মান্যবর অতিথিগণ আসছেন। আর তিনি লাল গালিচা বিছিয়ে সবাইকে হাস্যবদনে রিসিভ করছেন।

এবার আমেরিকান প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিনটনের পালা। প্রধানমন্ত্রী মরির কপালে ঘামের রেখা। তিনি ঘামছেন। ঘামছেন প্রেসিডেন্ট ক্লিনটনের কারণে। মহারসিক ক্লিনটন কখন কার সাথে কি রসিকতা করেন সেটা কেউই আগে ভাগে অনুমান করতে পারেন না। মিঃ মরিও পারছেন না। তিনি চাচ্ছেন রসিকতা ছাড়াই ভালোয় ভালোয় রিসেপশান পর্বটা যেন শেষ হয়। তাহলেই তিনি বাঁচেন। এদিকে সময় আর যায় না। অস্বস্তির সময় সব সময় দীর্ঘ হয়। কি আর করা! অস্বস্তি নিয়েই হালকা রোদের মিষ্টি আকাশ পানে তাকিয়ে তিনি আমেরিকান প্লেন দেখছেন আর মুছছেন চিকচিক করে জমে থাকা কপালের হালকা ঘাম।

ঘামাবারই কথা। কেননা তিনি ইংরেজীতে একেবারেই কাঁচা। কাঁচা মানে মহাকাঁচা। রাষ্ট্র প্রধানদের সাথে সৌজন্য কথাবার্তা যেটুকু হবার তার পুরোটাই তাঁকে আগেভাগে শিখিয়ে পড়িয়ে আনা হয়েছে। বলা যায় ঠোঁটস্থ করে আনা হয়েছে। পুরো একটা টিমের টানা অনেকগুলো দিন প্রচুর পরিশ্রম করতে হয়েছে তাঁর পেছনে। ক্লিনটনের সাথে কথাবার্তার জন্যে আগেভাগেই তাঁকে যা শেখানো হয়েছিল সেটা ঠিক এরকম;

মরি: হ্যালো মিঃ প্রেসিডেন্ট! হাউ আর ইউ?
ক্লিনটন: আই এম ফাইন। এন্ড ইউ? (ধরেই নেয়া হয়েছিল তিনি এমনটিই বলবেন)
মরি: মি টুউউউ।
জাস্ট এটুকুই। খুব জটিল কিছু নয়। খুবই সহজ কনভার্সেশন। মিঃ মরিকে মাত্র দু’টো লাইন বলতে হবে। মরিও খুবই যত্ন নিয়ে সে সব মুখস্ত করেই এয়ারপোর্টে এসেছেন।

এক সময় আকাশের প্লেন মাটিতে নেমে এলো। রানওয়ে থেকে আস্তে আস্তে এসে দাঁড়ালো নির্ধারিত জায়গায়। দরজা খুলতেই অতীব হাস্যবদনে মিঃ ক্লিনটন সিঁড়ি বেয়ে এয়ারপোর্টের টারমার্কে নেমে আসছেন। সিঁড়ির নীচে লাল গালিচায় দাঁড়িয়ে ঘামছেন প্রধানমন্ত্রী মরি। লাল গালিচায় প্রেসিডেন্ট ক্লিনটন পা রাখতেই হাত বাড়িয়ে মিঃ মরি হ্যান্ডশ্যাক করতে করতে বললেন, হ্যালো মিঃ প্রেসিডেন্ট! হো আর ইউ? হাউ না বলে তিনি ভুল করে হো বলে ফেলেছেন। ভুল জাস্ট এটুকুই। আর যায় কোথায়? মোক্ষম সুযোগ কি আর ক্লিনটন ছাড়েন! কঠিন হাসি হাসতে হাসতেই ক্লিনটন বললেন, মি? আই এম হাজবেন্ড অব হিলারী ক্লিনটন। এন্ড ইউ? হ্যান্ডশ্যাক আর শেষ করেন না তিনি। হাত ধরে নাড়িয়েই যাচ্ছেন। অগত্যা ক্লিনটনের হাতে হাত রেখেই প্রধানমন্ত্রী মরি হাসতে হাসতে শেখানো বুলিই বলে গেলেন, মি টুউউউ।

জাপানী মিডিয়া এটা নিয়ে ট্রল করেছে কয়েক মাস। ট্রল করারই কথা। তবে এটা নিয়ে তাঁকে হীনমন্যতায় ভোগতে দেখিনি কখনো। কেন ভোগেননি এটা তাঁর বিষয়। তবে আমি ভেবেছি ভিন্ন বিষয়। জাপানী প্রধানমন্ত্রী যদি তাঁর নিজের ভাষায় কথা বলার সুযোগ পেতেন, তিনি নিশ্চয়ই এমন পরিস্থিতিতে পরতেন না। কিংবা উল্টো ভাবে ভাবলে মিঃ ক্লিনটনকেও যদি জাপানী ভাষায় কথা বলতে হতো, তাহলে তাঁকেও হয়ত এমন পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে হতো।

কেন হতো? নিজের ভাষায় না বলে অন্যের ভাষায় বলতে যাওয়াতেই তো এই বিপত্তি। তাই নয় কি? যদি আজকের পৃথিবীর ভাষা ব্যবস্থাটাই অন্য রকমের হতো, যদি সবার ভাষা এক হতো তাহলে কি এমন পরিস্থিতির সৃষ্টি হতো? মোটেই হতো না। সবাই সবার সাথে এক ভাষায় কথা বলতো। মানে, নিজের ভাষায় কথা বলতো। নিজের ভাষায় মন খুলে যা বলা যায়, অন্যের ভাষায় তা কি বলা যায়?

যায় না। এটা বোঝার পরেও মানুষ এই সমস্যাটি নিয়ে আজো ভাবেনি। মানুষ তো কত কিছুই নিয়ে ভাবে। ভাবতে ভাবতে চাঁদ পেরিয়ে মঙ্গল গ্রহেও চলে গেল। শুধু সবার ভাষাটা এক করতে পারলো না! পারলো না প্রমাণ করতে, জাতিতে সবাই আমরা এক; আমরা মানুষ। আমাদের ভাষাও এক। সবাই এক ভাষায় কথা বলবো, সবার কথা সবাই বুঝবো। পৃথিবীটা সুন্দর থেকে আরো সুন্দরতম হবে। এটা কি খুব বেশি প্রত্যাশা? মানুষ চাঁদকে জয় করতে পারে। পারে মঙ্গলকেও জয় করতে। তাহলে সামান্য ভাষাকে জয় করতে পারবে না কেন?

পারা তো উচিত। পৃথিবীর সব জায়গার সবার ভাষা যদি একই ভাষা হতো, কতই না মজা হতো। সব দেশের সবাই কোন দোভাষী না নিয়ে কিংবা কোন টেক্সট অনুবাদ না করেই সবার কথা বুঝতে পারতো। বলতে পারতো। সবাই নিজের ভাষায় কথা বলতো। নিজের ভাষায় কথা বলার মজাই তো আলাদা! আফটার অল মায়ের ভাষা!! প্রাণ খুলে কথা বলার এই একটাই তো ভাষা!!!
-লেখক: উপদেষ্টা সম্পাদক, যুগবার্তা।