ডেস্ক রিপোর্ট: পারমাণবিক বোমা তৈরি করতে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় যুক্তরাষ্ট্র যে প্রকল্প হাতে নিয়েছিল তার নাম ছিল ‘ম্যানহাটন প্রজেক্ট’। সেই বোমা তৈরির প্রধান বিজ্ঞানী ছিলেন রবার্ট ওপেনহাইমার। তাকে নিয়ে হলিউডে নির্মিত একটি সিনেমা চলতি সপ্তাহের শুক্রবার মুক্তি পাচ্ছে, আর সে কারণেই এই বিজ্ঞানীকে নিয়ে তৈরি হয়েছে নতুন করে আগ্রহ। জাপানের দুটি শহরে এই বোমা ফেলার পর যে বিপুল প্রাণহানি এবং ধ্বংসলীলা ঘটেছিল তা এই বোমা তৈরির সময়ই অনুমান করেছিলেন ওপেনহাইমার, শ্রীমদ্ভগবদ্গীতার উদ্ধৃতি দিয়ে বলেছিলেন, ‘এখন সাক্ষাৎ মৃত্যু ও বিশ্ব ধ্বংসকারীতে পরিণত হয়েছেন তিনি।’

যুক্তরাষ্ট্রের নিউ মেক্সিকো অঙ্গরাজ্যের ইয়োর্নাদা দেল মুয়ের্তো মরুভূমি। সেদিন (১৯৪৫ সালের) ১৬ জুলাই সালের ভোরবেলা, সেখানে বিশ্বের প্রথম পারমাণবিক বোমার পরীক্ষা হতে যাচ্ছে- যার সাংকেতিক নাম ট্রিনিটি। বিস্ফোরণস্থল থেকে ১০ কিলোমিটার দূরে একটি কন্ট্রোল বাংকারের ভেতরে কাউন্টডাউনের জন্য অপেক্ষা করছিলেন প্রকল্পটির প্রধান বিজ্ঞানী ও পরিচালক রবার্ট ওপেনহাইমার। তাকে দেখেই বোঝা যাচ্ছিল, তার ভেতরে একটা চাপা উত্তেজনা কাজ করছে। পাঁচ ফুট ১০ ইঞ্চি লম্বা ওপেনহাইমার চিরকালই ছিলেন হালকা-পাতলা।
কিন্তু ম্যানহাটান ইঞ্জিনিয়ার ডিস্ট্রিক্টের বৈজ্ঞানিক শাখা ‘প্রজেক্ট ওয়াই’- যারা বোমাটির ডিজাইন বা নকশা তৈরি করেছিল- তার পরিচালক হিসেবে তিন বছর কাজ করার পর তার ওজন আরো কমে গিয়ে ৫২ কেজিতে নেমে এসেছিল। আরো শীর্ণকায় হয়ে গেছিলেন তিনি।
পরীক্ষামূলক বিস্ফোরণের আগে তিনি ঘুমিয়েছিলেন মাত্র চার ঘণ্টা। একদিকে দুশ্চিন্তা, আরেক দিকে ধূমপানজনিত কাশি- তাকে জাগিয়ে রেখেছিল। ওপেনহাইমারের জীবনে ১৯৪৫ সালের সেই দিনটি ছিল তার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্তগুলোর অন্যতম। তার ওপর ২০০৫ সালে ‘আমেরিকান প্রমিথিউস’ নামে একটি জীবনীগ্রন্থ লেখেন ইতিহাসবিদ কা বার্ড আর মার্টিন জে শেরউইন। হলিউডে ওপেনহাইমার নামে যে ছবি যুক্তরাষ্ট্রে মুক্তি পাচ্ছে শুক্রবার- তা রচিত হয়েছে এ বইটিকে ভিত্তি করেই।
‘সূর্যের চেয়েও উজ্জ্বল’ বিস্ফোরণ
বিস্ফোরণের কাউন্টডাউন শুরু হবার মুহূর্তে ওপেনহাইমারকে দেখছিলেন পাশে থাকা একজন সামরিক কর্মকর্তা। বার্ড আর শেরউইন বর্ণনা করেন, সেই জেনারেলটি বলছিলেন যে, ‘শেষ কয়েকটি সেকেণ্ডে ড. ওপেনহাইমার যেন আরো উৎকণ্ঠিত হয়ে পড়ছিলেন, তার শ্বাস পড়ছিল না।’
তারপরই ঘটলো সেই প্রচণ্ড বিস্ফোরণ। তার ঔজ্জ্বল্য সূর্যকেও ম্লান করে দিল। একুশ কিলোটন টিএনটির ক্ষমতাসম্পন্ন সেই বিস্ফোরণ ছিল তখন পর্যন্ত পৃথিবীর বৃহত্তম। এর ফলে যে শকওয়েভ বা বাতাসের ঝাপটা তৈরি হয়েছিল তা শত মাইল দূর থেকেও অনুভব করা সম্ভব হয়েছিল। প্রচণ্ড গর্জনে মরুভূমি কেঁপে উঠলো, আকাশে পাকিয়ে উঠলো মাশরুম আকৃতির মেঘ। ওপেনহাইমারের মুখে এবার এক বিরাট স্বস্তি ফুটে উঠলো। কয়েক মিনিট পর ওপেনহাইমারের বন্ধু ও সহকর্মী ইসিডোর রাবি দেখলেন, হেঁটে যাচ্ছেন তিনি। আমি কখনো তার সেই হাঁটার দৃশ্য ভুলবো না, ভুলবো না যেভাবে তিনি গাড়ি থেকে নেমেছিলেন। সেটা ছিল ‘হাই নুন’ ছবির মতো একটা দৃপ্ত ভঙ্গী – যাতে ফুটে উঠছিল যে তিনি তাকে দেয়া কাজটা করতে পেরেছেন।
‘আমি এখন সাক্ষাৎ মৃত্যু, বিশ্ব ধ্বংসকারী’
বেশ কিছুকাল পরে ১৯৬০-এর দশকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে তার গভীরতর অনুভূতির কথা জানিয়েছিলেন ওপেনহাইমার। তিনি বলেছিলেন, বিস্ফোরণের পর পরই তার মনে পড়েছিল হিন্দু ধর্মগ্রন্থ শ্রমদ্ভগবদ্গীতার একটি উদ্ধৃতি, ‘এখন আমি পরিণত হয়েছি সাক্ষাৎ মৃত্যুতে, বিশ্ব ধ্বংসকারীতে।’

তার বন্ধুদের কথায়, পরবর্তী দিনগুলোতে ওপেনহাইমারের মধ্যে একটা বিষণ্ন তা ভর করেছিল।

একজন বলেছেন, রবার্ট চুপচাপ আর আনমনা হয়ে গেছিল, কারণ সে জানতো কী ঘটতে যাচ্ছে।

একদিন তাকে জাপানিদের ভাগ্যে কী ঘটতে যাচ্ছে তা নিয়ে বিড়বিড় করতে শোনা যায়। তিনি বলছিলেন, আহা ওই ছোটখাটো বেচারা লোকগুলো, ওই ছোটখাটো বেচারা লোকগুলো!

কিন্তু কয়েক দিন পরই তার হাবভাব আবার পাল্টে যায়। সামরিক নেতাদের সাথে কথা বলার সময় তিনি বারবার তাদের বলে দিচ্ছিলেন যেন বৃষ্টি বা কুয়াশার সময় বোমাটা ফেলা না হয়, বা খুব বেশি উঁচুতে বিস্ফোরণ ঘটানো না হয়- তাহলে ততটা ক্ষয়ক্ষতি হবে না।

হিরোশিমায় সফলভাবে বোমা ফেলার পর সহকর্মীদের সামনে তিনি মুষ্টিবদ্ধ হাত ওপরে তুলে যে ভঙ্গি করেছিলেন- তা ছিল বিজয়ী যোদ্ধার মতোই।
পরমাণু বোমা তৈরির ‘মূল ব্যক্তি’
ওপেনহাইমার ছিলেন ম্যানহাটান প্রজেক্টের কেন্দ্রীয় ব্যক্তি। পরমাণু বোমাকে বাস্তবে রূপদানে তার ভূমিকাই ছিল সবচেয়ে বেশি।

যুদ্ধ পরবর্তীকালে তার এক সহকর্মী জেরেমি বার্নস্টাইন বলেছেন, লস আলামোসের ওই প্রকল্পে যদি ওপেনহাইমার না হয়ে অন্য কেউ পরিচালক হতেন তাহলে যুদ্ধ শেষ হতো ঠিকই- তবে পারমাণবিক বোমা ছাড়া।

এই বোমা সফলভাবে তৈরির ব্যাপারে ওপেনহাইমারের প্রতিক্রিয়া ছিল বিচিত্র।

এক এক সময় তার মধ্যে যেমন উত্তেজনা আর উচ্চাভিলাষী মনোভাব দেখা গেছিল- তেমনই ছিল বিষাদ ও গ্লানি।

একজন পদার্থ বিজ্ঞানী হলেও তার মধ্যে দেখা গেছে একজন বড় নেতার গুণাবলী ও সম্মোহনী ব্যক্তিত্ব।

ওপেনহাইমারের চরিত্রে এই স্ববিরোধিতা নাকি অল্প বয়স থেকেই ছিল এবং এজন্য তার বন্ধু ও জীবনীকারদের কাছে তিনি ছিলেন একটা ধাঁধাঁ হয়ে।
জার্মান ইহুদি অভিবাসী পরিবারে জন্ম
ওপেনহাইমারের জন্ম নিউইয়র্কে ১৯০৪ সালে- জার্মানি থেকে অভিবাসী হয়ে যুক্তরাষ্ট্রে আসা এক ইহুদি পরিবারে। কাপড়ের ব্যবসা করে তারা বিত্তশালী হয়েছিলেন। নিউইয়র্কের আপার ওয়েস্ট সাইডে তাদের বড় অ্যাপার্টমেন্টে ছিল তিনজন কাজের মেয়ে, একজন ড্রাইভার আর বাড়ির দেয়ালে শোভা পেতো ইউরোপীয় শিল্পীদের আঁকা ছবি। বিলাসিতার মধ্যে বড় হয়েও ওপেনহাইমার ছিলেন খুবই বুদ্ধিমান কিন্তু অত্যন্ত লাজুক। সবাই বুঝে গেছিল যে এই ছেলেটি অন্যদের মতো না হলেও সবার ওপরে, বলেন একই স্কুলে পড়া এক বন্ধু। ৯ বছর বয়সে ওপেনহাইমার গ্রিক ও লাতিন দর্শন পড়ছিলেন, আর আগ্রহী ছিলেন খনিজ পদার্থে। তার লেখা চিঠি পড়ে নিউইয়র্কের মিনারেলজিক্যাল ক্লাব ভেবেছিল তা হয়তো বয়স্ক কারো লেখা।

খেলাধুলায় তার কোনো আগ্রহ ছিল না, অন্য ছেলেরা তাকে ক্ষ্যাপাতো। কিন্তু তার মা-বাবা নিশ্চিত ছিলেন যে তাদের ছেলে অত্যন্ত প্রতিভাবান।
হার্ভার্ডে ও কেমব্রিজে পড়াশোনা
ওপেনহাইমার হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে রসায়ন পড়েন, এর পর স্নাতকোত্তর পড়াশোনা করেন ইংল্যান্ডের কেমব্রিজে। তার স্পর্শকাতর ও উদ্ধত ব্যক্তিত্ব এসময় তার জন্য নানা সমস্যার কারণ হয়। কেমব্রিজে এমন এক ঘটনা তিনি ঘটিয়েছিলেন যা তার জন্য বিপদ ডেকে আনতে পারতো।

তার টিউটর চাইতেন ওপেনহাইমার যেন ল্যাবরেটরিতে কাজ করেন, কিন্তু তা তার মোটেও পছন্দ ছিল না। একদিন তিনি একটা আপেলের ভেতর বিষাক্ত রাসায়নিক পদার্থ ভরে তার টিউটরের ডেস্কে রেখে দিল। সৌভাগ্যবশত টিউটর আপেলটি খাননি, কিন্তু ওপেনহাইমারের কেমব্রিজে পড়াই এ জন্য ঝুঁকির মুখে পড়লো। শেষে তাকে থাকতে দেয়া হলো এই শর্তে যে তিনি মনোবিজ্ঞানীর কাছে যাবেন।

সেই মনোবিজ্ঞানী বললেন, ওপেনহাইমারের সাইকোসিস (মানসিক রোগ) আছে, কিন্তু চিকিৎসা করে এটা সারবে না। ওপেনহাইমারে পরে বলেছেন যে, তিনি সেই বার বড়দিনের সময় আত্মহত্যার কথা ভেবেছিলেন। পরের বছর এক বন্ধু তার বান্ধবীর কাছে প্রেম নিবেদন করেছেন বলে জানালে ওপেনহাইমার তাকে শ্বাসরোধে হত্যার চেষ্টা করেন।

তার জীবনীকাররা বলেন, মনোবিজ্ঞানী তাকে যে মানসিক শুশ্রূষা দিতে পারেনি- তা তিনি পরবর্তীকালে পেয়েছিলেন সাহিত্য পাঠ করে। এসময় থেকে দার্শনিক ও আধ্যাত্মিক গ্রন্থ পাঠ তার সারা জীবনের অভ্যাস হয়ে দাঁড়ায়।
পরমাণু বোমা
পরমাণু অস্ত্রের হুমকি সম্পর্কে রাজনীতিবিদদের আগে বিজ্ঞানীরাই সচেতন হয়েছিলেন। ১৯৩৯ সালে আলবার্ট আইনস্টাইন প্রথম মার্কিন সরকারের নেতাদের কাছে এই নিয়ে এক চিঠি লিখেছিলেন।

পরে ১৯৪২ সাল নাগাদ এটা স্পষ্ট হয় যে পারমাণবিক বোমা তৈরি করা সম্ভব ও এতে ওপেনহাইমারের দলেরও অবদান ছিল। এ জন্য পরিকল্পনা তৈরি হতে থাকে তখন থেকেই।

প্রথম যখন বোমা তৈরির প্রকল্পের প্রধান বিজ্ঞানী হিসেবে ওপেনহাইমারের নাম প্রস্তাব করা হয়, তখন বেশ কিছু আপত্তি উঠেছিল। কিন্তু তার জ্ঞান এবং বিশ্বস্ততা ও উচ্চাভিলাষের কারণে ম্যানহাটান প্রকল্পের সামরিক নেতা জেনারেল লেসলি গ্রোভস তাকে নেবার পক্ষেই মত দেন।
‘শয়তানের কাজ’
যুদ্ধের পর পরমাণু বোমা সম্পর্কে ওপেনহাইমারের মত পাল্টে গেছিল । তিনি একে ‘ত্রাস ও আক্রমণের’ যন্ত্র ও অস্ত্র নির্মাণ শিল্পকে শয়তানের কাজ বলে আখ্যায়িত করেন।

মার্কিন প্রেসিডেন্ট হ্যারি ট্রুম্যানকে ১৯৪৫ সালের অক্টোবরে তিনি বলেছিলেন, আমার মনে হয় যেন আমার হাতে রক্ত লেগে আছে। প্রেসিডেন্ট পরে বলেছিলেন, আমি ওকে বলেছিলাম রক্ত লেগেছে আমার হাতে- সেটা নিয়ে আমাকেই ভাবতে দাও।

গীতায় আছে যে অর্জুন কুরুক্ষেত্রে যুদ্ধ করতে চাইছিলেন না কারণ তাহলে তাকে তারই স্বজনদের হত্যা করতে হবে। কিন্তু ভগবান কৃষ্ণ তাকে অস্ত্র ধরতে উৎসাহ দিয়ে বলেন, যারা মারা যাবে তাদেরকে তিনি আগেই মেরে রেখেছেন, অর্জুন হবেন তার যন্ত্র মাত্র।

অস্ত্র তৈরির সময় ওপেনহাইমার তার সহকর্মীদের বলতেন- পরমাণু বোমা ব্যবহৃত হলে কী হবে তা বিজ্ঞানীদের বিষয় নয়, তাদের দায়িত্ব তাদের কাজ করা। কিন্তু যুদ্ধের পরে ওপেনহাইমারের নিজের যুক্তির ওপর আস্থা নড়ে গেছিল। পরে আরো শক্তিশালী হাইড্রোজেন বোমা তৈরিরও বিরোধিতা করেছিলেন তিনি। পরে এ কারণে ১৯৫৪ সালে তার বিরুদ্ধে মার্কিন সরকার তদন্ত করে ও তার সিকিউরিটি ক্লিয়ারেন্স কেড়ে নেয়। অবশ্য পরে ১৯৬৩ সালে তােেকএনরিকো ফার্মি পুরস্কার দেয়- যদিও ক্লিয়ারেন্স ফেরত দেয়া হয় তার মৃত্যুর ৫৫ বছর পরে

ওপেনহাইমার তার বাকি জীবনে একদিকে তার কাজ নিয়ে গর্ব, অন্যদিকে এর পরিণাম নিয়ে অপরাধবোধ- এই দুই সমান্তরাল অনুভূতি নিয়েই বেঁচে ছিলেন। তরুণ বয়স থেকেই অত্যধিক ধূমপান করতেন ওপেনহাইমার। একারণে তার কয়েক দফা যক্ষ্মা হয়। ১৯৬৭ সালে গলদেশের ক্যান্সারে প্রয়াত হন তিনি। তিনি বলেছিলেন, একই ভুল আবার না করাই হচ্ছে বিজ্ঞানের কাজ। এটা কবিতা নয়।
পারমাণবিক বোমা তৈরি করতে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় যুক্তরাষ্ট্র যে প্রকল্প হাতে নিয়েছিল তার নাম ছিল ‘ম্যানহাটন প্রজেক্ট’। সেই বোমা তৈরির প্রধান বিজ্ঞানী ছিলেন রবার্ট ওপেনহাইমার। তাকে নিয়ে হলিউডে নির্মিত একটি সিনেমা চলতি সপ্তাহের শুক্রবার মুক্তি পাচ্ছে, আর সে কারণেই এই বিজ্ঞানীকে নিয়ে তৈরি হয়েছে নতুন করে আগ্রহ। জাপানের দুটি শহরে এই বোমা ফেলার পর যে বিপুল প্রাণহানি এবং ধ্বংসলীলা ঘটেছিল তা এই বোমা তৈরির সময়ই অনুমান করেছিলেন ওপেনহাইমার, শ্রীমদ্ভগবদ্গীতার উদ্ধৃতি দিয়ে বলেছিলেন, ‘এখন সাক্ষাৎ মৃত্যু ও বিশ্ব ধ্বংসকারীতে পরিণত হয়েছেন তিনি।’

যুক্তরাষ্ট্রের নিউ মেক্সিকো অঙ্গরাজ্যের ইয়োর্নাদা দেল মুয়ের্তো মরুভূমি। সেদিন (১৯৪৫ সালের) ১৬ জুলাই সালের ভোরবেলা, সেখানে বিশ্বের প্রথম পারমাণবিক বোমার পরীক্ষা হতে যাচ্ছে- যার সাংকেতিক নাম ট্রিনিটি। বিস্ফোরণস্থল থেকে ১০ কিলোমিটার দূরে একটি কন্ট্রোল বাংকারের ভেতরে কাউন্টডাউনের জন্য অপেক্ষা করছিলেন প্রকল্পটির প্রধান বিজ্ঞানী ও পরিচালক রবার্ট ওপেনহাইমার। তাকে দেখেই বোঝা যাচ্ছিল, তার ভেতরে একটা চাপা উত্তেজনা কাজ করছে। পাঁচ ফুট ১০ ইঞ্চি লম্বা ওপেনহাইমার চিরকালই ছিলেন হালকা-পাতলা।
কিন্তু ম্যানহাটান ইঞ্জিনিয়ার ডিস্ট্রিক্টের বৈজ্ঞানিক শাখা ‘প্রজেক্ট ওয়াই’- যারা বোমাটির ডিজাইন বা নকশা তৈরি করেছিল- তার পরিচালক হিসেবে তিন বছর কাজ করার পর তার ওজন আরো কমে গিয়ে ৫২ কেজিতে নেমে এসেছিল। আরো শীর্ণকায় হয়ে গেছিলেন তিনি।
পরীক্ষামূলক বিস্ফোরণের আগে তিনি ঘুমিয়েছিলেন মাত্র চার ঘণ্টা। একদিকে দুশ্চিন্তা, আরেক দিকে ধূমপানজনিত কাশি- তাকে জাগিয়ে রেখেছিল। ওপেনহাইমারের জীবনে ১৯৪৫ সালের সেই দিনটি ছিল তার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্তগুলোর অন্যতম। তার ওপর ২০০৫ সালে ‘আমেরিকান প্রমিথিউস’ নামে একটি জীবনীগ্রন্থ লেখেন ইতিহাসবিদ কা বার্ড আর মার্টিন জে শেরউইন। হলিউডে ওপেনহাইমার নামে যে ছবি যুক্তরাষ্ট্রে মুক্তি পাচ্ছে শুক্রবার- তা রচিত হয়েছে এ বইটিকে ভিত্তি করেই।
‘সূর্যের চেয়েও উজ্জ্বল’ বিস্ফোরণ
বিস্ফোরণের কাউন্টডাউন শুরু হবার মুহূর্তে ওপেনহাইমারকে দেখছিলেন পাশে থাকা একজন সামরিক কর্মকর্তা। বার্ড আর শেরউইন বর্ণনা করেন, সেই জেনারেলটি বলছিলেন যে, ‘শেষ কয়েকটি সেকেণ্ডে ড. ওপেনহাইমার যেন আরো উৎকণ্ঠিত হয়ে পড়ছিলেন, তার শ্বাস পড়ছিল না।’
তারপরই ঘটলো সেই প্রচণ্ড বিস্ফোরণ। তার ঔজ্জ্বল্য সূর্যকেও ম্লান করে দিল। একুশ কিলোটন টিএনটির ক্ষমতাসম্পন্ন সেই বিস্ফোরণ ছিল তখন পর্যন্ত পৃথিবীর বৃহত্তম। এর ফলে যে শকওয়েভ বা বাতাসের ঝাপটা তৈরি হয়েছিল তা শত মাইল দূর থেকেও অনুভব করা সম্ভব হয়েছিল। প্রচণ্ড গর্জনে মরুভূমি কেঁপে উঠলো, আকাশে পাকিয়ে উঠলো মাশরুম আকৃতির মেঘ। ওপেনহাইমারের মুখে এবার এক বিরাট স্বস্তি ফুটে উঠলো। কয়েক মিনিট পর ওপেনহাইমারের বন্ধু ও সহকর্মী ইসিডোর রাবি দেখলেন, হেঁটে যাচ্ছেন তিনি। আমি কখনো তার সেই হাঁটার দৃশ্য ভুলবো না, ভুলবো না যেভাবে তিনি গাড়ি থেকে নেমেছিলেন। সেটা ছিল ‘হাই নুন’ ছবির মতো একটা দৃপ্ত ভঙ্গী – যাতে ফুটে উঠছিল যে তিনি তাকে দেয়া কাজটা করতে পেরেছেন।
‘আমি এখন সাক্ষাৎ মৃত্যু, বিশ্ব ধ্বংসকারী’
বেশ কিছুকাল পরে ১৯৬০-এর দশকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে তার গভীরতর অনুভূতির কথা জানিয়েছিলেন ওপেনহাইমার। তিনি বলেছিলেন, বিস্ফোরণের পর পরই তার মনে পড়েছিল হিন্দু ধর্মগ্রন্থ শ্রমদ্ভগবদ্গীতার একটি উদ্ধৃতি, ‘এখন আমি পরিণত হয়েছি সাক্ষাৎ মৃত্যুতে, বিশ্ব ধ্বংসকারীতে।’

তার বন্ধুদের কথায়, পরবর্তী দিনগুলোতে ওপেনহাইমারের মধ্যে একটা বিষণ্ন তা ভর করেছিল।

একজন বলেছেন, রবার্ট চুপচাপ আর আনমনা হয়ে গেছিল, কারণ সে জানতো কী ঘটতে যাচ্ছে।

একদিন তাকে জাপানিদের ভাগ্যে কী ঘটতে যাচ্ছে তা নিয়ে বিড়বিড় করতে শোনা যায়। তিনি বলছিলেন, আহা ওই ছোটখাটো বেচারা লোকগুলো, ওই ছোটখাটো বেচারা লোকগুলো!

কিন্তু কয়েক দিন পরই তার হাবভাব আবার পাল্টে যায়। সামরিক নেতাদের সাথে কথা বলার সময় তিনি বারবার তাদের বলে দিচ্ছিলেন যেন বৃষ্টি বা কুয়াশার সময় বোমাটা ফেলা না হয়, বা খুব বেশি উঁচুতে বিস্ফোরণ ঘটানো না হয়- তাহলে ততটা ক্ষয়ক্ষতি হবে না।

হিরোশিমায় সফলভাবে বোমা ফেলার পর সহকর্মীদের সামনে তিনি মুষ্টিবদ্ধ হাত ওপরে তুলে যে ভঙ্গি করেছিলেন- তা ছিল বিজয়ী যোদ্ধার মতোই।
পরমাণু বোমা তৈরির ‘মূল ব্যক্তি’
ওপেনহাইমার ছিলেন ম্যানহাটান প্রজেক্টের কেন্দ্রীয় ব্যক্তি। পরমাণু বোমাকে বাস্তবে রূপদানে তার ভূমিকাই ছিল সবচেয়ে বেশি।

যুদ্ধ পরবর্তীকালে তার এক সহকর্মী জেরেমি বার্নস্টাইন বলেছেন, লস আলামোসের ওই প্রকল্পে যদি ওপেনহাইমার না হয়ে অন্য কেউ পরিচালক হতেন তাহলে যুদ্ধ শেষ হতো ঠিকই- তবে পারমাণবিক বোমা ছাড়া।

এই বোমা সফলভাবে তৈরির ব্যাপারে ওপেনহাইমারের প্রতিক্রিয়া ছিল বিচিত্র।

এক এক সময় তার মধ্যে যেমন উত্তেজনা আর উচ্চাভিলাষী মনোভাব দেখা গেছিল- তেমনই ছিল বিষাদ ও গ্লানি।

একজন পদার্থ বিজ্ঞানী হলেও তার মধ্যে দেখা গেছে একজন বড় নেতার গুণাবলী ও সম্মোহনী ব্যক্তিত্ব।

ওপেনহাইমারের চরিত্রে এই স্ববিরোধিতা নাকি অল্প বয়স থেকেই ছিল এবং এজন্য তার বন্ধু ও জীবনীকারদের কাছে তিনি ছিলেন একটা ধাঁধাঁ হয়ে।
জার্মান ইহুদি অভিবাসী পরিবারে জন্ম
ওপেনহাইমারের জন্ম নিউইয়র্কে ১৯০৪ সালে- জার্মানি থেকে অভিবাসী হয়ে যুক্তরাষ্ট্রে আসা এক ইহুদি পরিবারে। কাপড়ের ব্যবসা করে তারা বিত্তশালী হয়েছিলেন। নিউইয়র্কের আপার ওয়েস্ট সাইডে তাদের বড় অ্যাপার্টমেন্টে ছিল তিনজন কাজের মেয়ে, একজন ড্রাইভার আর বাড়ির দেয়ালে শোভা পেতো ইউরোপীয় শিল্পীদের আঁকা ছবি। বিলাসিতার মধ্যে বড় হয়েও ওপেনহাইমার ছিলেন খুবই বুদ্ধিমান কিন্তু অত্যন্ত লাজুক। সবাই বুঝে গেছিল যে এই ছেলেটি অন্যদের মতো না হলেও সবার ওপরে, বলেন একই স্কুলে পড়া এক বন্ধু। ৯ বছর বয়সে ওপেনহাইমার গ্রিক ও লাতিন দর্শন পড়ছিলেন, আর আগ্রহী ছিলেন খনিজ পদার্থে। তার লেখা চিঠি পড়ে নিউইয়র্কের মিনারেলজিক্যাল ক্লাব ভেবেছিল তা হয়তো বয়স্ক কারো লেখা।

খেলাধুলায় তার কোনো আগ্রহ ছিল না, অন্য ছেলেরা তাকে ক্ষ্যাপাতো। কিন্তু তার মা-বাবা নিশ্চিত ছিলেন যে তাদের ছেলে অত্যন্ত প্রতিভাবান।
হার্ভার্ডে ও কেমব্রিজে পড়াশোনা
ওপেনহাইমার হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে রসায়ন পড়েন, এর পর স্নাতকোত্তর পড়াশোনা করেন ইংল্যান্ডের কেমব্রিজে। তার স্পর্শকাতর ও উদ্ধত ব্যক্তিত্ব এসময় তার জন্য নানা সমস্যার কারণ হয়। কেমব্রিজে এমন এক ঘটনা তিনি ঘটিয়েছিলেন যা তার জন্য বিপদ ডেকে আনতে পারতো।

তার টিউটর চাইতেন ওপেনহাইমার যেন ল্যাবরেটরিতে কাজ করেন, কিন্তু তা তার মোটেও পছন্দ ছিল না। একদিন তিনি একটা আপেলের ভেতর বিষাক্ত রাসায়নিক পদার্থ ভরে তার টিউটরের ডেস্কে রেখে দিল। সৌভাগ্যবশত টিউটর আপেলটি খাননি, কিন্তু ওপেনহাইমারের কেমব্রিজে পড়াই এ জন্য ঝুঁকির মুখে পড়লো। শেষে তাকে থাকতে দেয়া হলো এই শর্তে যে তিনি মনোবিজ্ঞানীর কাছে যাবেন।

সেই মনোবিজ্ঞানী বললেন, ওপেনহাইমারের সাইকোসিস (মানসিক রোগ) আছে, কিন্তু চিকিৎসা করে এটা সারবে না। ওপেনহাইমারে পরে বলেছেন যে, তিনি সেই বার বড়দিনের সময় আত্মহত্যার কথা ভেবেছিলেন। পরের বছর এক বন্ধু তার বান্ধবীর কাছে প্রেম নিবেদন করেছেন বলে জানালে ওপেনহাইমার তাকে শ্বাসরোধে হত্যার চেষ্টা করেন।

তার জীবনীকাররা বলেন, মনোবিজ্ঞানী তাকে যে মানসিক শুশ্রূষা দিতে পারেনি- তা তিনি পরবর্তীকালে পেয়েছিলেন সাহিত্য পাঠ করে। এসময় থেকে দার্শনিক ও আধ্যাত্মিক গ্রন্থ পাঠ তার সারা জীবনের অভ্যাস হয়ে দাঁড়ায়।
পরমাণু বোমা
পরমাণু অস্ত্রের হুমকি সম্পর্কে রাজনীতিবিদদের আগে বিজ্ঞানীরাই সচেতন হয়েছিলেন। ১৯৩৯ সালে আলবার্ট আইনস্টাইন প্রথম মার্কিন সরকারের নেতাদের কাছে এই নিয়ে এক চিঠি লিখেছিলেন।

পরে ১৯৪২ সাল নাগাদ এটা স্পষ্ট হয় যে পারমাণবিক বোমা তৈরি করা সম্ভব ও এতে ওপেনহাইমারের দলেরও অবদান ছিল। এ জন্য পরিকল্পনা তৈরি হতে থাকে তখন থেকেই।

প্রথম যখন বোমা তৈরির প্রকল্পের প্রধান বিজ্ঞানী হিসেবে ওপেনহাইমারের নাম প্রস্তাব করা হয়, তখন বেশ কিছু আপত্তি উঠেছিল। কিন্তু তার জ্ঞান এবং বিশ্বস্ততা ও উচ্চাভিলাষের কারণে ম্যানহাটান প্রকল্পের সামরিক নেতা জেনারেল লেসলি গ্রোভস তাকে নেবার পক্ষেই মত দেন।
‘শয়তানের কাজ’
যুদ্ধের পর পরমাণু বোমা সম্পর্কে ওপেনহাইমারের মত পাল্টে গেছিল । তিনি একে ‘ত্রাস ও আক্রমণের’ যন্ত্র ও অস্ত্র নির্মাণ শিল্পকে শয়তানের কাজ বলে আখ্যায়িত করেন।

মার্কিন প্রেসিডেন্ট হ্যারি ট্রুম্যানকে ১৯৪৫ সালের অক্টোবরে তিনি বলেছিলেন, আমার মনে হয় যেন আমার হাতে রক্ত লেগে আছে। প্রেসিডেন্ট পরে বলেছিলেন, আমি ওকে বলেছিলাম রক্ত লেগেছে আমার হাতে- সেটা নিয়ে আমাকেই ভাবতে দাও।

গীতায় আছে যে অর্জুন কুরুক্ষেত্রে যুদ্ধ করতে চাইছিলেন না কারণ তাহলে তাকে তারই স্বজনদের হত্যা করতে হবে। কিন্তু ভগবান কৃষ্ণ তাকে অস্ত্র ধরতে উৎসাহ দিয়ে বলেন, যারা মারা যাবে তাদেরকে তিনি আগেই মেরে রেখেছেন, অর্জুন হবেন তার যন্ত্র মাত্র।

অস্ত্র তৈরির সময় ওপেনহাইমার তার সহকর্মীদের বলতেন- পরমাণু বোমা ব্যবহৃত হলে কী হবে তা বিজ্ঞানীদের বিষয় নয়, তাদের দায়িত্ব তাদের কাজ করা। কিন্তু যুদ্ধের পরে ওপেনহাইমারের নিজের যুক্তির ওপর আস্থা নড়ে গেছিল। পরে আরো শক্তিশালী হাইড্রোজেন বোমা তৈরিরও বিরোধিতা করেছিলেন তিনি। পরে এ কারণে ১৯৫৪ সালে তার বিরুদ্ধে মার্কিন সরকার তদন্ত করে ও তার সিকিউরিটি ক্লিয়ারেন্স কেড়ে নেয়। অবশ্য পরে ১৯৬৩ সালে তােেকএনরিকো ফার্মি পুরস্কার দেয়- যদিও ক্লিয়ারেন্স ফেরত দেয়া হয় তার মৃত্যুর ৫৫ বছর পরে

ওপেনহাইমার তার বাকি জীবনে একদিকে তার কাজ নিয়ে গর্ব, অন্যদিকে এর পরিণাম নিয়ে অপরাধবোধ- এই দুই সমান্তরাল অনুভূতি নিয়েই বেঁচে ছিলেন। তরুণ বয়স থেকেই অত্যধিক ধূমপান করতেন ওপেনহাইমার। একারণে তার কয়েক দফা যক্ষ্মা হয়। ১৯৬৭ সালে গলদেশের ক্যান্সারে প্রয়াত হন তিনি। তিনি বলেছিলেন, একই ভুল আবার না করাই হচ্ছে বিজ্ঞানের কাজ। এটা কবিতা নয়।
-আমাদের সময়.কম