Home মতামত নেতিবাচকের ডামাডোলে ইতিবাচকের অভাব! নেতিবাচক প্রচার করাই যেন মোদের স্বভাব!!

নেতিবাচকের ডামাডোলে ইতিবাচকের অভাব! নেতিবাচক প্রচার করাই যেন মোদের স্বভাব!!

44

সরদার মো: শাহীন।। বড়ই বেড়াছেড়ার মধ্যে পড়েছে বিশ্ব। অবস্থা একেবারেই টালমাটাল; বেসামাল। বিশ্বের এমনতর বেসামাল পরিস্থিতিতে টেনেটুনে টিকে থাকতে পারাটাই এখন বিশাল একটা বিষয়। সবচেয়ে ভাল থাকার মত বিষয়। আল্লাহ্ পাকের দরবারে লাখো শুকরিয়া। গেল সাড়ে তিন বছর ধরে পুরো পৃথিবীর উপর দিয়ে শুধু তো ঝড়ই বয়ে যাচ্ছে। এখনো সেই ঝড়ে হারিয়ে যাইনি; বেঁচে আছি! এটাই তো আল্লাহ্পাকের বড় নিয়ামত। ভাল থাকার আশা করাটাই তো এখন অন্যায্য দাবি। কী হয়নি এই সাড়ে তিন বছরে!
প্রথমে আসলো করোনা মহামারী। চীন এবং তার আশেপাশের দেশেই সীমাবদ্ধ ছিল ভয়াল মরণব্যাধি করোনার বিস্তার। দূর থেকে দেখে আমরা মোটেও বিচলিত হইনি। হয়েছি চরম পুলকিত। চায়নীজ মুসলিমের উপর নির্যাতনের কারণে উপরওয়ালার গজব ভেবে পুলকিত হয়েছি। ওরা মুসলিমদের হিজাবে বাঁধা দিয়েছে, তাই উপরওয়ালা ওদেরকে মাস্করূপী হিজাব পড়াতে বাধ্য করেছে বলে ট্রল করে বেড়িয়েছি।
দু’দিন বাদে গজবটা যে ওদের উপরও আসবে তা ওরা ঘুনাক্ষরেও বোঝেনি। অল্প দিনেই ওদের কথিত চায়নীজ গজবটা চারিদিকে ছড়িয়ে পড়লো। মহামারী রূপ নিল অতিমারীতে। ছড়িয়ে পড়লো প্রাচ্য থেকে পাশ্চাত্যে। অবিশ্বাস্য রকমের ধাক্কা দিল পুরো বিশ্বকে। বলা যায় বিশ্বকে এক প্রকার স্থবির করে দিল করোনা। লকডাউনের ধাক্কায় অর্থনীতির চাকা পুরোটাই বন্ধ হয়ে গেল।
করোনার দীর্ঘ ছোবলের পর যেই না একটু ঘুরে দাঁড়াবার চেষ্টা করবো, অমনি যুদ্ধ লেগে গেল ইউক্রেন-রাশিয়ায়। কঠিন যুদ্ধ। এমনি এমনি লেগে যাওয়া দুপক্ষের যুদ্ধ নয়। তৃতীয় পক্ষ হতে কুটকৌশল করে লাগিয়ে দেয়া যুদ্ধ। স্যাংশনের নামে পুরো বিশ্বকে নিয়ন্ত্রণ করার এক নোংরা খেলা। ফলে যা হবার তাই হলো। ২য় বিশ্বযুদ্ধের দীর্ঘ ৭৫ বছর পর পুরো বিশ্ব হয়ে উঠলো অনেকটাই তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের মাঠ।
শুরুতে গোলাগুলিটা কেবল রাশিয়া এবং ইউক্রেনে হলেও গুলির শব্দ আর আগুনের লেলিহান শিখার আচর অন্যান্য দেশের মত আমাদের দেশকেও স্পর্শ করতে শুরু করলো। জীবনযাত্রার ব্যয় বৃদ্ধি তথা জীবনমানের নানা রকম সংকোচন নীতিতে পড়ে পরিবর্তিত হতে শুরু করলো উঠতি অর্থনীতির বাংলাদেশ। পরিষ্কার মনে হচ্ছিল এ আমার শান্তি সুখের বাংলাদেশ নয়; যুদ্ধাক্রান্ত দেশ। এ আমার সাধারণ ভাবে বেঁচে থাকা নয়; যুদ্ধের মধ্যেই বেঁচে থাকা।
জীবনযুদ্ধের যাঁতাকলে নিত্যদিন পিষ্ঠ হয়ে বেঁচে থাকাটা তো যুদ্ধের মধ্যেই বেঁচে থাকা। অনেকটা ৩য় বিশ্বযুদ্ধের মত। আমাদের দেশের কেউ বুঝুক বা না বুঝুক, মানুক বা না মানুক; বহির্বিশ্ব এটাকে ৩য় বিশ্বযুদ্ধ হিসেবেই দেখছে। বিদেশে যেখানে যার সাথেই দেখাসাক্ষাত হয়, শুরুর কথা একটাই, বিশ্বযুদ্ধটা শেষ হবে কবে? সবাই কেবল প্রশ্নটাই করতে পারে। কেউই উত্তর দিতে পারে না। শুধু পারে হতাশার বহিঃপ্রকাশ করতে।
এমনতর হতাশার সংবাদ নিয়ে মিডিয়াও চলছে। সমস্যা হলো, সাপ্তাহিক সিমেকের। হতাশার খবর ছাপানোর জন্যে তো সিমেকের জন্ম হয়নি। সিমেক হতাশার নয়, আশাবাদের খবর ছাপায়। নেতিবাচক নয়, ইতিবাচক সংবাদ প্রকাশ করে। দুঃখজনক হলেও সত্যি, সাপ্তাহিক সিমেকে ছাপাবার মত ভাল খবর আজকাল আর তেমন পাইই না। ভাল খবর খোঁজার জন্যে রোজ দেশ বিদেশের অনেকগুলো পত্রিকা পড়ি। আগে পড়তাম সকালে ঘুম থেকে জেগে। এখন পড়ি মাঝরাতে, ঘুমুতে যাবার আগে।
দুর্ভাগ্য! ভাল খবর পড়ে ঘুমুতে যাবার সুযোগ আর হয় না। যা পড়ি, সবই হতাশার খবর। এসবের মধ্যে হতাশ হবার মত সত্যি খবর যেমনি পাই, মিথ্যে কিংবা বিকৃত খবরও পাই প্রচুর। একটা শ্রেণী আছে, যারা মিথ্যেকে সত্যি হিসেবে প্রচার করে কিংবা ভালকে খারাপ দেখাবার চেষ্টা করে খুব মজা পায়। মজা নেবার জন্য ভাল কিছুকে পেঁচিয়ে পেঁচিয়ে খারাপ বানিয়ে আতঙ্ক ছড়াবার চেষ্টা তারা নিত্যদিন করে।
বেশিদিনের কথা না। গত জুনের কথা। সংসদে দেশের বাজেট দেয়া হলো। স্বাভাবিক ভাবেই সব বাজেটেরই ভালমন্দ দুটি দিকই থাকে। আলোচনা এবং সমালোচনার বহু উপাদান থাকে। সে সব নিয়ে কথাবার্তা আমরা সাধারণেরা উপভোগও করি। কিন্তু আলোচনা বা সমালোচনার নামে যখন কোন তথ্যকে বিকৃতভাবে কেউ উপস্থাপন করে তখন গায়ে লাগে। বিশেষ করে, বিশেষ কেউ যখন বলে তখন বেশি গায়ে লাগে।
যাকে তাকে নিত্যদিন কাফের ফতোয়া দেয়া বিশেষ একজন মাওলানা সাহেব আছেন। প্রতিদিনই তিনি ফতোয়া দেন, কথা বলেন। ইদানীং বলেন না এমন কোন বিষয় নেই। তিনি দেশ নিয়ে, রাজনীতি নিয়ে অহরহই বলছেন। বলেছেন বাজেট নিয়েও। কথা বলাটা তাঁর অধিকার। কিন্তু বুঝেশুনে এবং জেনেশুনেও তিনি সত্যকে বিকৃত করে উপস্থাপন করেন নিজস্ব বলার ভঙ্গিমায়। শ্রোতাদের কাছে তা খাঁটি সত্য হিসেবেই প্রতীয়মান হয়। অধিকারটা লঙ্ঘন করেন তিনি ঠিক এই জায়গায়।
বাজেট দেবার পরই তিনি হুঙ্কার দিলেন। বললেন, রিক্সাওয়ালাকেও ২,০০০ টাকা কর দিতে হবে কেন? অথচ এমন কথা বাজেটের প্রস্তাবনাতেই ছিল না। ছিল শুধু তাঁদের জন্যে, যাঁদের করধার্য্যতুল্য আয় থাকুক বা না থাকুক, যদি তারা সরকার প্রদত্ত ৩৮টি বিশেষ সুবিধা পেতে যায়, তাহলে কমপক্ষে ২,০০০ টাকা কর দিতে হবে। আসলে যাঁদের এই ৩৮টি সুবিধা নেবার দরকার আছে, তাঁদের কাছে বছরে ২,০০০ টাকা কর দেবার মত যথেষ্ট টাকাও থাকে। কোন রিক্সাচালকের এ পরিমাণ টাকা যেমনি থাকে না, তেমনি ঐ ৩৮টি সুবিধার একটিও তার লাগে না।
তাহলে কি দাঁড়ালো? মাওলানা সাহেব জেনেবুঝে জাস্ট মিথ্যে কথা বলেছেন। বলে বলে তাঁর শ্রোতাদের কঠিনভাবে উস্কানী দিয়েছেন। উস্কানী তিনি বিদ্যুত নিয়েও দিয়েছেন। তাঁর অকাট্য যুক্তি; যেহেতু বিদ্যুৎ নেই, তাই এতদিন ধরে বানানো বিদ্যুৎ কেন্দ্রের কথা সব মিছা। বাস্তবে তার এই দাবিটাই মিছা। সমস্যাটা বিদ্যুত কেন্দ্র নিয়ে নয়। সমস্যাটি বিদ্যুৎ উৎপাদনের। জ্বালানী স্বল্পতার কারণে বিদ্যুৎ উৎপাদনে সমস্যা হচ্ছিল। ইউক্রেন যুদ্ধে জ্বালানী এখন সোনার চেয়ে মূল্যবান হয়ে উঠছে সারা বিশ্বে।
ব্যাপারটিকে একটু ভিন্নভাবে দেখলে কেমন হয়? বিদ্যুৎ সাপ্লাই কমে যাওয়ায় জনগণ অসন্তুষ্ট হচ্ছিল সরকারের প্রতি। সাময়িক লোডশেডিংয়ের কারণে সরকারের বিরুদ্ধে জনগণের ক্ষোভ প্রচন্ড বাড়তে শুরু করেছিল। তবে ক্ষোভের মাত্রাই বলে দিয়েছে ক’দিন আগেও বিদ্যুৎ ছিল। গত চৌদ্দ বছর ধরে বিদ্যুত খাতের উন্নয়নের মাধ্যমে সরকার জনগণের কল্যাণমূলক সেবা করেছেন বলেই বিদ্যুৎ ছিল। বর্তমানের গরম তো আগেও ছিল। শুধু লোডশেডিং ছিল না বলে আমরা সেটা অনুভব করতে পারিনি।
পাশের দেশ ভারতের কোলকাতার মানুষও অনুভব করতে পারে না। লোডশেডিং এর কথা কোলকাতার মানুষ জানেই না। গেল ৪০ বছরে ওরা লোডশেডিং দেখেনি। লোডশেডিং শব্দটাই ওদের জানা নেই। কিন্তু একটা সময় লোডশেডিং ছিল। লোডশেডিং এ অন্ধকারে ডুবে থাকতো কোলকাতা। কেন্দ্রীয় সরকারের সহযোগিতায় পশ্চিমবঙ্গ সরকার একের পর এক বিদ্যুৎ কেন্দ্র বানাতে পারায় এর সুফল আজ জনগণ পাচ্ছে।
বাংলাদেশও নিশ্চিত পাবে। এটা আমাদের দেশের জ্ঞানপাপীরা স্বীকার না করলেও খোদ ভারতবাসীরা করছে। পাকিস্তানীরা করছে। ওদের টিভিতে নিত্যদিন এসব নিয়ে প্রোগ্রাম হচ্ছে। কোন এক আড্ডায় একই কথা বেশ জোর দিয়ে বলছিলেন দিল্লী জামিয়া ইসলামিয়ার প্রফেসর বিশ্বজিত। উড়িষ্যার মানুষ হওয়ায় বাংলায় বেশ সুন্দর করে কথা বলতে জানেন। সমাজ বিজ্ঞানের একজন পন্ডিততুল্য মানুষটি বাংলাদেশের উন্নতির ভুয়সী প্রশংসা করলেন সেদিন।
বললেন, ‘বাংলাদেশের উন্নয়ন এখন একটা বিশ্বমডেলে রূপ নিয়েছে। দেশটির অর্থনীতির প্রায় সব সূচকই উর্ধ্বমুখী। এটা একটা বিস্ময়।’শুনে আমি আনন্দিত হয়েছি, কিন্তু মুখ ফোটে বলতে পারিনি তাঁকে; “বিদেশীদের চোখে পড়া এত এত উন্নয়নের পরেও যেভাবে আমাদের উন্নয়নকে খাটো করে আমার দেশের লোকেরাই কথা বলে, ট্রল করে; সেটাও এক বিস্ময়। মহাবিশ্বের নতুন বিস্ময়!!”
-লেখক: উপদেষ্টা সম্পাদক, যুগবার্তা।