Home প্রচ্ছদ নির্বাচনি সংকট থেকে বের হওয়ার উপায়

নির্বাচনি সংকট থেকে বের হওয়ার উপায়

29

মুহাম্মদ ইয়াহ্ইয়া আখতার : বাংলাদেশে এখন নির্বাচনি সংকট চলছে। এরশাদ সামরিক সরকারের পতনের পর তিনটি নির্বাচন (পঞ্চম, সপ্তম এবং অষ্টম) গ্রহণযোগ্যভাবে অনুষ্ঠিত হয়েছিল। প্রথম জাতীয় সংসদ নির্বাচন থেকে শুরু করে সামরিক-বেসামরিক শাসনামলে অনুষ্ঠিত প্রতিটি নির্বাচনে যুগপৎ নানা মাত্রার অনিয়ম ও দুর্নীতি হয়েছিল। প্রথম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে সরকারি দলের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করার মতো শক্তিশালী কোনো দল ছিল না। নির্বাচনি প্রচারণা না করলেও সরকারি দল বিরাট সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে জয়লাভ করত। কিন্তু পরিতাপের বিষয়, দলটি বিরোধী দলগুলোকে নিশ্চিহ্ন করার নীতি গ্রহণ করায় নির্বাচনটি কালিমাযুক্ত হয়ে পড়ে। ওই নির্বাচনে ১০ জন সরকারদলীয় প্রার্থী বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হলে বিরোধী দলগুলো থেকে বলা হয়, ওইসব আসনে তাদের প্রার্থীদের মনোনয়নপত্র জমা দিতে শারীরিকভাবে বাধা দেওয়া হয়। এ ছাড়াও সরকারি দলের বিরুদ্ধে রিলিফ কাজে ব্যবহৃত গাড়ি নির্বাচনি প্রচারণায় ব্যবহার করা এবং ভোটারদের নির্বাচনি ঘুস হিসাবে রিলিফ দ্রব্য প্রদান করার অভিযোগ ছিল। নির্বাচনি ফলাফল ঘোষণায় গণমাধ্যম নিরপেক্ষতা প্রদর্শনে ব্যর্থ হয়। আইন-শৃঙ্খলাবাহিনীর সদস্যরা যোগসাজশ করে নির্বাচনে জিততে পারেন এমন সম্ভাব্য বিরোধীদলীয় প্রার্থীদের অনেকের পরাজয় নিশ্চিত করে। প্রথম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের এ দুর্নীতি ‘সূচনায় গলদ’ হিসাবে বিবেচিত হয়। এর ধারাবাহিকতায় পরবর্তীকালে সামরিক ও বেসামরিক শাসনামলগুলোয় নির্বাচনি দুর্নীতির চর্চা ও ধারাবাহিকতা চলমান রয়েছে। ব্যতিক্রম কেবল তত্ত্বাবধায়ক সরকারাধীনে অনুষ্ঠিত তিনটি নির্বাচন।

গত তিনটি সংসদ নির্বাচনে নির্বাচনের নামে প্রকৃতপক্ষে যা হয়েছে তাকে গ্রহণযোগ্য নির্বাচন বলা যায় না। নবম সংসদ নির্বাচনে ভোটের কাস্টিং রেট হলো ৮৬.৩৪%, যা হবে প্রকৃতপক্ষে শতকরা ৮৭.৬০ ভাগ। ‘না’ ভোট এবং বাতিল ভোট বাদ দিয়ে অন্যায়ভাবে ৮৬.৩৪ ভাগ ভোট পড়েছে বলে দাবি করা হয়েছে। আবার যে কমিশনের অধীনে ওই নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছিল, ওই কমিশনের একজন কমিশনার তার লেখা ‘নির্বাচন কমিশনে পাঁচ বছর’ শীর্ষক বইয়ে এই ভোট পড়ার হার শতকরা ৮৭.১২ বলেছেন। তিনিও ‘না’ ভোট বাদ দিয়ে এ পারসেন্টেজ বের করেছেন। এটা সঠিক হয়নি। কারণ, ‘না ভোট’ জেনুইন ভোট। ‘না’ ভোট প্রদানকারীরা শারীরিকভাবে ভোটকেন্দ্রে হাজির হয়েছিলেন। প্রিজাইডিং অফিসার তার সবকিছু পরীক্ষা করে তাকে ব্যালট পেপার দিয়েছিলেন এবং ভোটার নির্বাচন কমিশনের নিয়মানুযায়ী ‘না’ ভোট প্রদান করেছিলেন। কোন কেন্দ্রে কতটি ‘না’ ভোট পড়েছিল তা গণনাও করা হয়েছিল। তাহলে কেন ভোটের পারসেন্টেজ বের করার সময় ‘না’ ভোট এবং বাতিল ভোট বাদ দেওয়া হলো? এ প্রশ্নের জবাব কোনো না কোনাদিন ওই নির্বাচন কমিশনকে দিতে হবে।

উল্লেখ্য, এরশাদের পতনের পর সর্বসম্মত তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থার অধীনে পঞ্চম সংসদ নির্বাচন অবিতর্কিতভাবে অনুষ্ঠিত হয়। কিন্তু পরবর্তীকালে খালেদা জিয়া সরকার তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থাধীনে নির্বাচন দিতে না চাইলে আওয়ামী লীগ জামায়াত ও জাপাকে সঙ্গে নিয়ে ১৭৩ দিন হরতাল করার মধ্য দিয়ে কঠোর আন্দোলন করে খালেদা জিয়াকে তত্ত্বাবধায়ক সরকারাধীনে নির্বাচন দিতে বাধ্য করে। খালেদা জিয়াও একটি সন্ত্রাসকবলিত যেনতেন প্রকারের ষষ্ঠ সংসদ নির্বাচন করে ১৯৯৬ সালে সংসদে ত্রয়োদশ সংশোধনী পাশ করে সাংবিধানিক আইন করে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে সংসদ নির্বাচন দেন। এমন সাংবিধানিক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে সপ্তম ও অষ্টম সংসদ নির্বাচন গ্রহণযোগ্যভাবে অনুষ্ঠিত হয়। এ কথা স্বীকার্য, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের মধ্যে কিছু ভুলত্রুটি দেখা দিয়েছিল। নির্বাচন নিকটবর্তী হলে কে সর্বশেষ অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি হবেন তা নিয়ে রাজনৈতিক নেতৃত্ব অঙ্ক কষাকষি শুরু করেছিলেন। কিন্তু তত্ত্বাবধায়ক সরকারের এসব ত্রুটি সংস্কার করা সম্ভব ছিল। কিন্তু তেমন উদ্যোগ না নিয়ে রাজনৈতিক নেতৃত্ব মাথাব্যথা হলে মাথা কেটে ফেলার নীতি গ্রহণ করে তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থা বাতিল করে দেয়। এর পর থেকে শুরু হয় ফন্দি-ফিকিরের নির্বাচন। দশম ও একাদশ সংসদ নির্বাচন গণতান্ত্রিক বিশ্বে বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক ভাবমূর্তি ভূলুণ্ঠিত করে। এখন আবার দ্বাদশ সংসদ নির্বাচন আসন্ন হওয়ায় দশম এবং একাদশ সংসদ নির্বাচনের কলাকৌশল বাদ দিয়ে সরকার হয়তো নতুন কোনো কলাকৌশলে ক্ষমতা ধরে রাখতে চাইছে। এ জন্য সরকারের মন্ত্রী মহোদয়রা বারবার বলছেন, আগামী নির্বাচন এ সরকারের অধীনেই অনুষ্ঠিত হবে, যদিও দলীয় সরকারের অধীনে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, মন্ত্রী এবং এমপিরা ক্ষমতায় থেকে সংসদ না ভেঙে নির্বাচন করলে যে ওই নির্বাচন কিছুতেই স্বচ্ছ করা যাবে না সে বিষয়টি একাধিকবার প্রমাণিত হয়েছে।

সরকার আইন তৈরি করে সার্চ কমিটি গঠন করে নতুন নির্বাচন কমিশন গঠন করেছে। আমলানির্ভর এ কমিশন গঠনে লুকোচুরি ও ছলচাতুরি করা হয়েছে। সার্চ কমিটি নির্বাচন কমিশন গঠনে প্রস্তাবিত ভুলে ভরা ৩ শতাধিক নাম প্রকাশ করলেও এ কমিটি ২০ ও ১০ জনের সংক্ষিপ্ত তালিকা প্রকাশ না করে জনগণকে তাদের তথ্য জানার অধিকার থেকে বঞ্চিত করেছে। নতুন নির্বাচন কমিশন দলীয় সরকারের অধীনে স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারবে না। এ কারণে সিইসি শপথ নেওয়ার পর প্রেস ব্রিফিংয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর কাছে সমঝোতা প্রস্তাব দিয়েছেন। বিচক্ষণ সিইসি বুঝতে পেরেছেন, নির্দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন অনুষ্ঠিত না হলে তার পক্ষে গ্রহণযোগ্য নির্বাচন করা খুবই কঠিন হবে। কারণ, দলীয় ব্যবস্থাধীনে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী প্রবল ক্ষমতা নিয়ে নিজ পদে আসীন থাকবেন। মন্ত্রী-এমপিরাও নিজ নিজ পদে থাকবেন। জাতীয় সংসদ ভাঙা হবে না। নির্বাচন কমিশনের প্রশিক্ষিত লোকবল বাদ দিয়ে প্রশাসনিক কর্মকর্তাদের জনগণের টাকা খরচ করে প্রশিক্ষণ দিয়ে নির্বাচনের কাজে ব্যবহার করা হবে। এমতাবস্থায় সরকারদলীয় প্রার্থী ছাড়া আর কোনো দলের পক্ষে নির্বাচনে জয়লাভ করা সম্ভব হবে না। সে জন্য সিইসি হয়তো ভেবেছেন, রাজনৈতিক সমঝোতার মাধ্যমে যদি একটি অস্থায়ী নির্বাচনকালীন নির্দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন হয় তাহলে কমিশনের পক্ষে স্বাধীনভাবে কাজ করা সহজ হবে।

ক্ষমতাসীন দলের সদিচ্ছা না হলে নির্দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন করা যাবে না। সরকারি দলের সংসদে দুই-তৃতীয়াংশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা রয়েছে। সরকার চাইলে নির্দলীয় নির্বাচনকালীন সরকার গঠনের জন্য সংসদে বিল এনে ‘তত্ত্বাবধায়ক’ বাদে যে কোনো নাম দিয়ে একটি অস্থায়ী নির্বাচনকালীন সরকার গঠন করতে পারবে। সে ক্ষেত্রে ওই সরকারের অধীনে কমিশনের পক্ষে স্বাধীনভাবে কাজ করা সম্ভব হবে। কিন্তু সরকারের তেমন ইচ্ছা আছে বলে প্রতীয়মান হচ্ছে না। মাননীয় মন্ত্রীরা সম্প্রতি বারবার বলছেন যে, তারা সংবিধানের বাইরে যাবেন না। নির্বাচন সংবিধান অনুযায়ী আওয়ামী লীগ সরকারের অধীনেই অনুষ্ঠিত হবে। তবে এমন নির্বাচন করতে চাইলে সে নির্বাচনে প্রধান বিরোধী দলসহ অনেক দল অংশগ্রহণ নাও করতে পারে। কারণ, রাজনৈতিক দল নির্বাচন করে নির্বাচন জিতে সরকার গঠন করে দেশ পরিচালনার জন্য। কিন্তু দলগুলো যদি বুঝতে পারে, যে ব্যবস্থায় নির্বাচন হবে তাতে জনসমর্থন থাকলেও তারা জিততে পারবে না, তাহলে বড় দলগুলো কেন নির্বাচনে অংশগ্রহণ করবে?

এসব দেখে অনেকেই দেশের গণতন্ত্রের ভবিষ্যৎ নিয়ে শঙ্কিত। তারা ভাবছেন, আবার যদি একতরফা নির্বাচন হয়, আর সে নির্বাচন গ্রহণযোগ্য না হলে গণতান্ত্রিক বিশ্বে বাংলাদেশের ভূলুণ্ঠিত ভাবমূর্তি উদ্ধার করা যাবে না। তবে সরকার অদৃশ্য নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে আমলানির্ভর নির্বাচন কমিশন, প্রশাসন ও পোশাকধারী বাহিনী ব্যবহার করে যদি দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে ইঞ্জিনিয়ারিং করতে চায়, তবে তা কঠিন হতে পারে। কারণ, এবার বন্ধুপ্রতিম কতিপয় পরাশক্তিধর দেশ বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া ও নির্বাচনের ওপর নজর রাখছে। এরা কূটনৈতিকভাবে সরকারকে স্বচ্ছ নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য চাপে রাখতে চাইছে বলে অবস্থাদৃষ্টে প্রতীয়মান হচ্ছে। দেশীয় রাজনীতিতে বিদেশিদের হস্তক্ষেপ কাম্য নয়। কিন্তু যেহেতু স্বদেশি রাজনীতিবিদরা একাধিকবার ফন্দি-ফিকিরের নির্বাচন করেছেন, সে কারণে জনগণ যে কোনো উপায়ে তাদের ভোটের মর্যাদা প্রতিষ্ঠায় চেষ্টা করবেন। এ কারণেই হয়তো পরাশক্তিধর কতিপয় রাষ্ট্রের বাংলাদেশি নির্বাচনের ওপর নজরদারি করা প্রত্যাশিত মাত্রায় সমালোচিত হচ্ছে না।

সবচেয়ে ভালো হয় সরকার যদি নিজেই উদ্যোগী হয়ে ভালো নির্বাচন অনুষ্ঠানে আন্তরিক উদ্যোগ গ্রহণ করে। এমন ইচ্ছা থাকলে সরকারকে কয়েকটি কাজ করতে হবে। সর্বপ্রথমে সবগুলো দলের সঙ্গে বসে খোলামন নিয়ে আলাপ-আলোচনা ও পরামর্শ করে জাতীয় সংসদে নির্বাচনকালীন অস্থায়ী সরকার গঠনের জন্য একটি বিল উত্থাপন ও পাশ করে ওই নির্বাচনকালীন সরকারের অধীনে সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠানের ব্যবস্থা করতে হবে। নির্বাচন কমিশনকে নির্বাচন পরিচালনায় পূর্ণ স্বাধীনতা দিতে হবে। নির্বাচন কমিশনকে ডিসি, এডিসি ও প্রশাসকদের পরিবর্তে লোকবলসমৃদ্ধ নির্বাচন কমিশন কর্মকর্তাদের মধ্য থেকে জেলা নির্বাচন কর্মকর্তা ও অন্য অভিজ্ঞ কর্মকর্তাদের রিটার্নিং ও অ্যাসিট্যান্ট রিটার্নিং অফিসার নিয়োগ দিতে পরামর্শ দিতে হবে। বিতর্কিত ও ব্যয়বহুল ইভিএমে কিছুতেই নির্বাচন করা যাবে না। এর পরিবর্তে কাগজের ব্যালটে ভোট অনুষ্ঠানের জন্য ইসিকে দলগুলোর পক্ষ থেকে সর্বসম্মত পরামর্শ দিতে হবে। নতুন পাশ করা আইনে নির্বাচনকালীন সরকার যেন নির্বাচন কমিশনকে নির্বাচন পরিচালনায় সার্বিক সহায়তা প্রদান করে সে ব্যবস্থা সুনিশ্চিত করতে হবে। ফন্দি-ফিকিরের নির্বাচন অনুষ্ঠানে পর আসন্ন দ্বাদশ সংসদ নির্বাচন জাতির সামনে স্বচ্ছ ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন অনুষ্ঠানের মাধ্যমে ভূলুণ্ঠিত গণতান্ত্রিক ভাবমূর্তি উদ্ধারের সুযোগ এনে দিয়েছে। সবাই মিলে সে সুযোগ কাজে লাগাতে হবে। সম্মিলিত প্রচেষ্টায় দ্বাদশ সংসদ নির্বাচন ইনক্লুসিভ হলে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে দেশ গণতান্ত্রিক চর্চার পথে পা বাড়াতে পারবে।-যুগান্তর