ডেস্ক রিপোর্ট: নন-ব্যাংকিং আর্থিক প্রতিষ্ঠানে দুর্নীতি ও অনিয়ম বন্ধে নেই কোনো কার্যকর পদক্ষেপ। তদারকির অভাবে এসব প্রতিষ্ঠানে নানা ধরনের অনিয়ম ও দুর্নীতি সংঘটিত হয়ে থাকে। বিশেষ করে তদারকি প্রতিষ্ঠানগুলোর সমন্বয়ের অভাবে একের পর এক আর্থিক কেলেঙ্কারির ঘটনা ঘটে চলেছে। গত কয়েক বছরে দেশের বেশ কয়েকটি নন-ব্যাংকিং আর্থিক প্রতিষ্ঠানে ঋণের নামে অর্থ লুটপাটের ঘটনা নজরে আসে হাইকোর্টের। এরকম দুটি প্রতিষ্ঠানে বড় ধরনের অর্থ লুটপাটের ঘটনায় দায়ী ব্যক্তিদের চিহ্নিত করতে উচ্চ আদালতের নির্দেশে গঠন করা হয় কমিটি। কমিটি অনিয়ম ও দুর্নীতি বন্ধে এ ধরনের প্রতিষ্ঠানের ওপর তদারক করতে আর্থিক প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন বিভাগ এবং আর্থিক প্রতিষ্ঠান ও বাজার বিভাগের মধ্যে কার্যকর আন্তঃবিভাগীয় সমন্বয় গড়ে তোলাসহ ৯ দফা সুপারিশ করেছে।
বাংলাদেশ ইন্ডাস্ট্রিয়াল ফাইন্যান্স কোম্পানি লিমিটেড (বিআইএফসি) ও ইন্টারন্যাশনাল লিজিং অ্যান্ড ফিন্যান্সিয়াল সার্ভিসেস লিমিটেড (আইএলএফএসএল)-এর আর্থিক কেলেঙ্কারির ঘটনায় দায়ী ব্যক্তিদের চিহ্নিত করতে আদালতের নির্দেশে গঠন করা হয় এই ফ্যাক্ট ফাইন্ডিং কমিটি। গত মাসে হাইকোর্টের কোম্পানি বেঞ্চে কমিটির সুপারিশ সংবলিত প্রতিবেদন দাখিল করা হয়। আদালত প্রতিবেদনটি নথিভুক্ত করে এবং পরে আদেশ দেওয়া হবে বলে জানানো হয়েছে।
সুপারিশে আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর সুষ্ঠু তদারকির জন্য নিয়ন্ত্রণকারী সংস্থা বা কর্তৃপক্ষ বাংলাদেশ ব্যাংক, আরজেএসসি, বিএসইসির মধ্যে কার্যকর সমন্বয় জোরদারের কথা বলা হয়েছে। প্রকৃত খেলাপি ঋণ চিহ্নিতকরণ ও তার তথ্য দ্রুত সিআইবিতে সংরক্ষণ নিশ্চিতের ব্যবস্থা করার জন্য পরিদর্শক দলে সিআইবি সদস্য অন্তর্ভুক্ত রাখা প্রয়োজন বলে মত দিয়েছে কমিটি। এছাড়া এই দুটি প্রতিষ্ঠানে কেলেঙ্কারির ঘটনার জন্য বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক পাঁচ ডেপুটি গভর্নরসহ প্রায় আড়াই শ ব্যক্তি জড়িত বলে প্রতিবেদনে উঠে এসেছে, যাদের যোগসাজশে কয়েক হাজার কোটি টাকা লুটপাট করা হয়েছে এসব আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে।
উল্লেখযোগ্য সুপারিশসূমহ:
নন-ব্যাংকিং আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য বজায় রাখতে এবং পাবলিক মানির (জনগণের আমানত) ঝুঁকি বৃদ্ধি বন্ধে আন্তঃব্যাংক লেনদেনের কার্যক্রম পরিচালনা পুরোপুরি পরিহারের ব্যবস্থা গ্রহণ করা দ্রুত দরকার। আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে বন্ড ও একই ইনস্ট্রুমেন্ট ইস্যুর মাধ্যমে দীর্ঘমেয়াদি তহবিল সংগ্রহ করতে হবে। প্রতি বছর ভিজিলেন্স, অফসাইট সুপারভিশন ও মনিটরিংয়ে প্রাপ্ত বা উদ্ঘাটিত তথ্য বিশ্লেষণে ঝুঁকি বিবেচনায় সংশ্লিষ্ট আর্থিক প্রতিষ্ঠানে বিশেষ পরিদর্শন কার্যক্রম পরিচালনার ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। অবশিষ্ট আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে দৈবচয়নের ভিত্তিতে প্রতি বছর কমপক্ষে একটিতে বিশেষ পরিদর্শন করতে হবে এবং উদ্ঘাটিত অনিয়মের বিষয়ে আইনানুগ কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ নিশ্চিত করতে হবে। বাংলাদেশ ব্যাংকের নথি ব্যবস্থাপনা ও সংরক্ষণ আধুনিকায়ন করতে নথির নোটাংশ, পত্রাংশ ও অনুচ্ছেদে নাম্বারিং করতে হবে এবং সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাকে চিহ্নিত করার সুবিধার্থে নথির নোট উপস্থাপনকারী থেকে অনুমোদনকারী পর্যন্ত প্রত্যেক কর্মকর্তার স্বাক্ষরের সঙ্গে তার নামের সিল ব্যবহার বাধ্যতামূলক করতে হবে।
এছাড়া বর্তমান আর্থিক প্রতিষ্ঠান আইন, ১৯৯৩-এ কোনো আর্থিক প্রতিষ্ঠানের পরিচালক পর্ষদে পরিচালক নিয়োগের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ ব্যাংকের অনুমোদন গ্রহণের বিধান নেই। ফলে আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো ইচ্ছেমতো পরিচালক নিয়োগ করে থাকে, অনেক ক্ষেত্রে স্বতন্ত্র পরিচালক হিসেবে পরিচালকদের স্বার্থসংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান থেকে বা তাদের সঙ্গে সম্পর্কিত ব্যক্তিদেরও নিয়োগ করে থাকে। এক্ষেত্রে আর্থিক প্রতিষ্ঠানের পরিচালক পর্ষদে পরিচালক নিয়োগের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ ব্যাংকের অনুমোদন বা অনাপত্তি গ্রহণের শর্তারোপ করা প্রয়োজন।
সুপারিশে আর্থিক প্রতিষ্ঠান আইন, ১৯৯৩-এর ১৮ ধারায় উল্লিখিত আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর (ক) নেওয়া আমানতের প্রদেয় সুদের সর্বোচ হার, (খ) কার কাছ থেকে কত ঋণ গৃহীতব্য হবে তার সর্বোচ্চ পরিমাণ, (গ) প্রদত্ত ঋণ পরিশোধের সর্বোচ্চ সময়সীমা, (ঘ) প্রদত্ত বিভিন্ন শ্রেণির ঋণের সুদের সর্বোচ্চ হার ও হিসাবায়ন পদ্ধতি, (ঙ) ঋণ দেওয়ার সর্বোচ্চ সীমা, (চ) বাংলাদেশ ব্যাংকে রক্ষিত রিজার্ভ, (ছ) আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর দায় পরিশোধের সক্ষমতার মতো যৌক্তিক পর্যায়ে ইক্যুইটি উন্নীত করাসহ জনস্বার্থে মুদ্রানীতির উন্নতি বিধানকল্পে অন্যান্য বিষয় নিয়ন্ত্রণে ব্যাংলাদেশ ব্যাংককে অবিলম্বে ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। বহির্নিরীক্ষক ফার্মের জরিমানা/দণ্ড হওয়া মাত্রই সংশ্লিষ্ট ফার্মকে আর্থিক প্রতিষ্ঠানের নিরীক্ষা কার্যক্রম পরিচালনার যোগ্য ফার্মের তালিকা হতে বাদ দিতে হবে। বিআইএফসিতে সব অনিয়ম ও অবৈধ কর্মকাণ্ড সংঘটনে দায়ী ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে এবং সেই সঙ্গে তাদেরও ভবিষ্যতে এরূপ কর্মকাণ্ডে জড়িত ব্যক্তিদের ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানে সব নিয়োগ লাভের অযোগ্য করার ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। বাংলাদেশ ব্যাংকের আইনজীবী ব্যারিস্টার খান মোহাম্মদ শামীম আজিজ হাইকোর্টে এই প্রতিবেদন দাখিল করেন।
ইত্তেফাক