Home মতামত ধর্মীয় অনুশাসন রাষ্ট্রীয় আইনের সঠিক প্রয়োগ ও জনসচেতনতা বৃদ্ধির মাধ্যমে মাদক নিয়ন্ত্রণ...

ধর্মীয় অনুশাসন রাষ্ট্রীয় আইনের সঠিক প্রয়োগ ও জনসচেতনতা বৃদ্ধির মাধ্যমে মাদক নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব।

53

গাজী মোহাম্মদ হানিফ (জনি) : সাম্প্রতিক সময়ে বন্ধু ও শুভাকাঙ্ক্ষী অনেকেই মাদকের বিরুদ্ধে লেখালেখি করার জন্য আমাকে অনুরোধ করেন, সেই সূত্রধরে সমাজে সৃষ্টির উদ্দেশ্যে দু’চারটা কথা লিখতে বসলাম… ইদানীংকালে বিশ্বে মাদকসেবী’র সংখ্যা অনেক বেড়ে গেছে। নিত্য নতুন মাদকদ্রব্য তৈরী হচ্ছে, বিপণনের সুবিধার্থে আধুনিক ও অত্যাধুনিক অনেক খাদ্যপণ্যে সুকৌশলে মাদকদ্রব্য মিশ্রিত করা হয়ে থাকে। যুবসম্প্রদায় সেইসব খাদ্যের নামে মাদক গ্রহণ করছে। আমরা সাধারণত জানি – মদ, গাঁজা, আফিম, চরস, হিরোইন, মর্ফিন, পেথিড্রিন, সিডাক্সিন, মারিজুয়ানা, কোকেন, তাঁড়ি প্রভৃতি মাদকদ্রব্যের কথা। বিড়ি, সিগারেট, তামাক, গুল, জর্দা ইত্যাদি ও মাদকতার মধ্যে পড়ে। ইদানীং মাদক তালিকায় অত্যাধুনিক মাদকদ্রব্য প্রবেশ করেছে- যেমন ইয়াবা ট্যাবলেট বা বাবা। এছাড়া বিভিন্ন বেভারেজ কোমল পাণীয়র আদলে কিছু মাদকদ্রব্য এসেছে- মাশরুম ম্যানপাওয়ার জিনসিন ইত্যাদি নামে বাজারে পাওয়া যাচ্ছে।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার পরিসংখ্যান অনুযায়ী, বিশ্বের ৭৬ মিলিয়ন মানুষ মদপানের কারণে সৃষ্ট বিভিন্ন কঠিন রোগে ভুগছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার পরিসংখ্যান অনুসারে, বিশ্বের সব রোগ-ব্যাধির ৩.৫ শতাংশ মদপানজনিত। মদপান ও মাতলামির কারণে প্রতিবছর শুধু যুক্তরাষ্ট্রেই ১৮৫ বিলিয়ন ডলার নষ্ট হয়। ইসলাম আল্লাহর ভয়ের পাশাপাশি আইনের মাধ্যমে এ ভয়ংকর ব্যাধি সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ করেছে। মহান আল্লাহপাক বলেন, ‘হে মুমিনরা, নিশ্চয়ই মদ, জুয়া, প্রতিমা-বেদি, ভাগ্যনির্ধারক তীরগুলো নাপাক। এগুলো শয়তানের কর্ম। সুতরাং তোমরা তা পরিহার করো, যাতে তোমরা সফলকাম হও।’ (সুরা : মায়েদা, আয়াত : ৯০)

বিশ্বের বিভিন্ন দেশে বিভিন্ন ধর্মে বিভিন্ন জাতিতে মাদকদ্রব্য সেবন বিপণনকে অপরাধ হিসেবে গণ্য করা হয়ে থাকে। ইসলাম ধর্মে মাদকসেবন হারাম বা নিষিদ্ধ করা হয়েছে।
পবিত্র কোরআন কারিমে বর্ণিত হারুত ও মারুত এই মাদকের নেশায় মাতাল হয়েই জোহরার ইশারায় হত্যা, ব্যভিচারসহ নানান অপরাধে লিপ্ত হয়েছিল (সুরা-২ বাকারা, আয়াত: ১০২; তাফসিরে আজিজি ও তাফসিরে মাআরিফুল কোরআন)। শয়তান তো মদ ও জুয়া দ্বারা তোমাদের মধ্যে শত্রুতা ও বিদ্বেষ ঘটাতে চায় এবং তোমাদিগকে আল্লাহর স্মরণে ও নামাজে বাধা দিতে চায়। তবে কি তোমরা নিবৃত্ত হবে না?’ (সুরা-৫ মায়েদা, আয়াত: ৯১)।

মাদকাসক্ত হওয়ার কারণে মানব মস্তিষ্ক বিকৃতি ঘটে, মাদকসেবী মানুষের হিতাহিত জ্ঞান থাকেনা, সমাজে অশান্তি অন্যায় অত্যাচার চুরি ডাকাতি চাঁদাবাজি সহ সকল অপকর্মের পিছনে প্রতক্ষ বা পরোক্ষভাবে মাদকতা দায়ী। মাদক সেবনের কারণে মানবদেহে অনেক দুরারোগ্য কঠিন রোগ সৃষ্টি হয়ে থাকে, দীর্ঘকাল রোগ ভোগ করার পর ধীরেধীরে তাকে মৃত্যুর দিকে টেনে নিয়ে যায়।

বাংলাদেশের প্রচলিত আইনে মাদকসেবী বিপণনকারীর কঠোর সাজার বিধান থাকলেও মাদকতা কমছেনা, দিনদিন যেন এটা আরো বৃদ্ধি পাচ্ছে। ধর্মীয় অনুশাসন রাষ্ট্রীয় আইনের সঠিকতর প্রয়োগ ও জনসচেতনতা বৃদ্ধির মাধ্যমে মাদক নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব। যুগেযুগে মাদকসেবী অপরাধীদের বিভিন্ন শাস্তির পদ্ধতির মধ্যে ইতিহাস ঘেঁটে মধ্যযুগীয় কিছু শাস্তির বিষয় অবগত হলাম তাই আপনাদের জ্ঞাতার্থে নিম্মে তাহা তুলে ধরলাম-

মধ্যযুগে মদ্যপায়ীদের শাস্তি দেবার জন্য একটি অভিনব কায়দা ছিল। এটিকে বলা হতো ড্রাঙ্কারস ব্যারেল (Drunkard’s Barrel). তখনকার সময়ে মাত্রাতিরিক্ত মদ্যপান যারা করতো, তারা সমাজে নানা ধরনের অসামাজিক কার্যকলাপের সাথে যুক্ত ছিল এবং সমাজকে নানাভাবে হেয় করত। রাত বিরাতে তাদের জ্বালায় অতিষ্ট হয়ে থাকত পথচারী এবং ঘরে বাস করা মানুষেরা।
হেঁড়ে গলায় অশ্লীল গান গাওয়া, গালিগালাজ করা কিংবা মাত্রাতিরিক্ত অসংলগ্ন আচরণের জন্য এদের শায়েস্তা করার একটি অভিনব উপায় আবিষ্কার করা হয়। মদভর্তি একটি পিপার ভেতর মদ্যপায়ীকে আটকে ফেলা হয়। তার মাথা, দুইপাশে দুই হাত এবং পা দুটি বের হয়ে থাকে যাতে সে চলাফেরা করতে পারে। মদের পিপা থেকে মদ এই ফুটোগুলো দিয়ে আস্তে আস্তে গড়িয়ে পড়তে থাকে। হতভাগ্য ঐ মদ্যপায়ী কোনো মদ পান করতে পারতো না। এমনকি এই অবস্থা থেকে মুক্তি পাবারও কোনো উপায় থাকেনা, যদি বাইরে থেকে কেউ তাকে সাহায্য না করে। পুরো শহর এভাবে মদের পিপা শরীরে বহন করে তাকে হাঁটানো হতো। চারদিক থেকে দুয়ো টিটকারি দিতো শহরবাসী। অনেকে আবার মদের বোতল থেকে মদ ছিটিয়ে দিতো তার সারা মুখে। পঁচা ডিম ও টমেটো ছুড়ে মারতো তার মুখে, কেউ কেউ জুতা ও ঢিল ছুড়ে মারতো তার দিকে। তাকে লজ্জা দেবার জন্য এরচাইতে আর ভালো কোন উপায় ছিল না।
বেচারা মদ্যপায়ী আর কোনো মদের দোকানে যেতেও পারত না চক্ষুলজ্জা ও অপমানের ভয়ে। স্পেনে ও ফ্রান্সে বেশ কিছুকাল পর্যন্ত এই ধরণের শাস্তির প্রথা চালু ছিল।

মধ্যযুগে আরো বেশ কিছু কায়দায় মানুষকে শাস্তি দেয়া হতো। তারমধ্যে একটি শাস্তি ছিল এমন যে- আরোপিত ঐ ব্যক্তিকে শহরের একদম মুখ্যদ্বারে ঝুলিয়ে রাখা হতো এবং শকুনেরা এসে খুবলে খেয়ে যেত তার শরীরের মাংস। বর্তমানকালে শকুন যেমন বিলুপ্ত হয়ে গেছে ঠিক ঐ ধরণের শাস্তিও বিলুপ্তি ঘটেছে। এমনই আরো অনেক ধরনের শাস্তির প্রচলন ছিল মধ্যযুগে। কালের প্রথায় ও মানুষের মাঝে মূল্যবোধ ও সমাজের প্রতি দায়িত্ব পরিবর্তন হবার কারণে- মানবাধিকার সংগঠন গুলোর তৎপরতার কারণে এসব শাস্তি থেকে বর্তমান পৃথিবী অনেকটাই মুক্ত। তবে অমানবিক মনে করলেও এইসব শাস্তি কিন্তু মাদক নিয়ন্ত্রণে কার্যকর ভূমিকা রাখতো।

আসুন, আমরা মাদকতা’কে না বলি। সমাজের অশান্তির কারণ এই মাদকের বিরুদ্ধে জনসচেতনতা ও জনমত তৈরী করি। শিক্ষিত জাতি গঠন, ধর্মীয় অনুশাসন ও প্রচলিত আইনের সঠিকতর প্রয়োগ বা আরো কঠোর আইন তৈরীর মাধ্যমে, শরীর গঠনে সহায়ক খেলাধুলা ও শিল্প সাহিত্য সংস্কৃতি চর্চায় সবাইকে উৎসাহিত করার মাধ্যমে- বর্তমান যুবসমাজকে মাদকতা থেকে দূরে রাখা যেতে পারে।

আসুন, আমরা সচেতন হই, মাদকসেবী ও মাদক বিপণনকারীকে আইনের হাতে সোপর্দ করি। ভবিষ্যৎ পৃথিবী হোক মাদকমুক্ত সুন্দর ও শান্তিময়।-লেখক: চিকিৎসক, সাংবাদিক, কবি ও মানবাধিকার কর্মী। মোবাইল : ০১৮১১-১৭৭৭০৪, সোনাগাজী, ফেনী।