Home মতামত দিন যায়, কিন্তু কথা যায় না!!!

দিন যায়, কিন্তু কথা যায় না!!!

29

সরদার মোঃ শাহীন:

রমজান গেল, রমজানের ঈদ গেল। মাঝে কত্ত কিছু হয়েও গেল। শুধু মাঝে হবে কেন? বাংলাদেশে প্রায় প্রতিদিনই কিছু না কিছু হয়। প্রায় প্রতিদিনই একটা করে নতুন ঘটনা ঘটে, আর আগেরটা টুপ্পুস করে চাপা পড়ে যায়। দেখা গেছে একটা বিষয় নিয়ে লিখতে বসেছি। লেখা প্রায় শেষের দিকেও। অথচ পুরো লেখাটা শেষ হবার আগেই আরেকটা বিষয় এসে সামনে হাজির হয়। অধিকতর সিরিয়াস বিষয়। শেষ হয় হয় করা লেখার বিষয়বস্তু ততক্ষণে বাসী বা পুরোনো হয়ে যায়। হয়ে যায় অপ্রয়োজনীয়।
নিত্যদিন নতুন নতুন ঘটনা ঘটার এই এক বিড়ম্বনা। লেখকদের জন্যে বলা চলে মহাবিড়ম্বনা। অবশ্য যারা সত্যিকারের লেখক, নিত্যদিন লেখে, তাদের জন্যে তেমন সমস্যা হয় না। তারা যথেষ্ঠ অভ্যস্ত, লেখায় তারা দারুণ পটু। কিন্তু আমার মত যারা প্রতিদিন লেখে না, তাদের জন্যে এ এক বিড়ম্বনাই বটে। লেখায় বিষয়বস্তুর গুরুত্ব বুঝতে পারি না। গুরুত্ব বোঝার আগেই লেখা তার নিজের গুরুত্বই হারিয়ে ফেলে।
তবে গুরুত্ব শব্দটা আজকাল মিডিয়ায় খুব গুরুত্ব পাচ্ছে। কথায় কথায় গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের গুরুত্বপূর্ণ খবর মিডিয়া খুব গুরুত্বের সাথেই প্রকাশ করছে। ভাবসাব এমন যেন এখানে গুরুত্বহীনের কোন জায়গা নেই। আবার মিডিয়া নিজেই গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের জন্ম দিচ্ছে। জন্ম দিচ্ছে গুরুত্বপূর্ণ ঘটনারও। ঘটনার পর ঘটনা যেমনি জন্ম নিচ্ছে, তেমনি জন্ম নিচ্ছে গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিরাও। এবং পুরোনো গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের চেয়ে নতুন গুরুত্বপূর্ণরা বেশি কভারেজ পাচ্ছে।
বাংলাদেশের আকাশে এমনই দু’একজন গুরত্বপূর্ণ ব্যক্তির আগমন ঘটেছে সমসাময়িক সময়ে। যেনতেন গুরুত্বপূর্ণ নন। বুদ্ধিজীবীতুল্য গুরুত্বপূর্ণ। যেমনি কথার ঝাঁঝ, তেমনি অকাট্য যুক্তি। কথার উচ্চারণে ত্রুটি থাকলেও যুক্তিতে নেই। এমন কোন জায়গা নেই, যেখানে তাদের উপস্থিতি নেই কিংবা কদর নেই। দেশের পাশাপাশি ইদানীং বিদেশেও তাদের উপস্থিতি শুরু হয়েছে। কদরও বেড়েছে। তাদের কদর সব জায়গায়, সবখানে।
প্রতিটি দিন তারা মিডিয়া কভারেজ পাচ্ছেন বড় জায়গা জুড়ে। সব ব্যাপারে কমেন্টও দিচ্ছেন। তারা সোশ্যাল মিডিয়ায় যখন যা পোস্ট দেন, তাই মেইনষ্ট্রিম পত্রিকায় শিরোনাম হয়। আর পত্রিকা পায় লাইক। বাহারী কিসিমের লাইক। লাইকের পর লাইক পড়তে থাকে। বলা যায় হিড়িক পড়ে যায়। পড়ে যায় কমেন্টের ঝড়। সদ্যজাত আইকনদের বন্দনায় মুখে ফেনা তুলে ফেলে সকলে।
ফেনা তাদেরও ওঠে। একজন তো কাউকে পেলে ফানা ফানাও করে ফেলেন। কাউরে কসুর করে কথা বলেন না। পটপট করে বলতেই থাকেন। কেউ তাকে নিয়ে কিছু একটু বলেছে তো, অমনি উনি ঝাঁপিয়ে পড়েন। ঝাঁপিয়ে পড়েন মন্ত্রী মিনিস্টারের উপরও। কথায় কথায় উনি লাইভে আসেন। নোটিশ দিয়েই আসেন। আর মিডিয়াও নোট নেবার জন্যে বসে থাকে। মান্যবরের লাইভ শেষ হতে দেরী হয়, কিন্তু তাকে নিয়ে নিউজ কভারেজ করতে মিডিয়ার একটুও দেরী হয় না।
তিনি যাই বলেন, যাই করেন, তাই হিট। জিরো থেকে হিরো হয়েছেন বলে নিজেই দাবী করেন। চরম জনপ্রিয় এক মহা ভাগ্যবান মানুষ তিনি। কেবল মহা ভাগ্যবানই নন, মহা হুমকিবাজও। ইদানীং মামলার হুমকিটুমকিও দেয়া শুরু করেছেন। দিচ্ছেন মরণের হুমকিও। ক’দিন আগে কিংবদন্তী তুল্য একজন গুরুজনকে চ্যালেঞ্জও ছুঁড়ে দিয়েছেন।
চ্যালেঞ্জ কিংবা হুমকির ভয়তে তার নামটি পর্যন্ত আমি আজ এখানে নিতে সাহস পেলাম না। পুটি মাছের প্রাণের এই আমার এত সাহস তো থাকারও কথা না। সাহস থাকে গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের। দু’জনার বাকীজনও তেমনি গুরুত্বপূর্ণ একজন ব্যক্তি। বেজায় গুরুত্বপূর্ণ। যে কোন বিষয়ে পটর পটর করায় তার জুড়ি মেলা ভার। প্রতিদিন প্রতিক্ষণ পটপট করেন। পটপট জনসভায় করেন, লাইভেও করেন। বয়সের তুলনায় কথার ভার বেশি। ধার বেশি। বিরোধী রাজনীতির নেতৃত্ব শূন্যতায় ভারী ভারী কথা বলার দায়িত্ব যেন তারই কাঁধে পড়েছে। যেন তিনি বিরোধী রাজনীতির অঘোষিত মুখপাত্র হয়েই উদিত হয়েছেন।
উদিত হয়েছেন বেশি দিন হয়নি। ছাত্র রাজনীতি দিয়ে তার উত্থান। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক আসিফ নজরুল তার ভিতরে বঙ্গবন্ধুর ছায়াও দেখতে পেয়েছিলেন। রাজনীতির শুরুতেই বিশ্ববিদ্যালয় রাজনীতিতে ফাটাফাটি রকমের বাজিমাত করেছেন বলে তার আকাঙ্খাও ফাটাফাটি রকমের বড়। বড় নেতা এখনও হতে না পারলেও রাজনীতিতে বড় পদ অলরেডী পেয়ে গেছেন। কথাও বলেন সকল সময় বড় বড়।
ভয়াবহ রকমের দেশ দরদী তিনি। দরদী বলেই বিশ্বাস করেন ক্ষমতায় যাওয়া ছাড়া দেশের জন্যে কাজ করা সম্ভব নয়। দেশের মঙ্গলের জন্যে তাই খুব তাড়াতাড়ি সবাইকে ল্যাং মেরে এখনই প্রধানমন্ত্রী হতে চান। বিদেশের এক হোটেলের রিসিপশানে দেখলাম প্রবাসী সাঙ্গসাথীরা বাংলাদেশের পরবর্তী প্রধানমন্ত্রী হিসেবে তাকে পরিচয় করিয়ে দিচ্ছেন। তিনিও মুচকী হেসে হামভরা ভাব প্রকাশ করেছেন। আর গোপনে হ্যান্ডশ্যাক করেছেন নিষিদ্ধ বিদেশি গোয়েন্দাদের সাথেও। বাজারে চাউর হয়েছে বিদেশি জঙ্গীদের সাথেও তার সখ্যতার কথা।
জানা যায়, এই সখ্যতায় রোজগারপাতিও বেশি। ঘন ঘন বিদেশ যাবার হয়ত ওটাই মূল কারণ। দেশের রাজনীতি অস্থির করে তোলার জন্যে টাকার দরকার। নানা খরচাপাতির বিষয় আছে। তাই কেবল বিদেশী সংস্থা নয়, টাকা তোলেন প্রবাসী বাংলাদেশীদের কাছ থেকেও। টাকা তোলার জন্যে প্রবাসীদের নিয়ে ওখানে যে কয়টা জমায়েত করেছেন, হৈচৈ মারামারি ছাড়া একটা জমায়েতও শেষ করতে পারেননি। যেখানেই যান, একটা না একটা ক্যাঁচাল তিনি বাঁধাবেনই। আমজনতার কাছ থেকে মোটামুটি মানের দৌঁড়ানি না খেয়ে কোন জমায়েত থেকে হোটেলে ফিরতে পারেননি তিনি একবারও।
দৌঁড়ানী খেয়েছেন অন্য দেশেও। সেদিন তো দৌঁড়ানি খেয়ে একদেশ থেকে অন্যদেশেও পালিয়েছেন। রাতের অন্ধকারে পালিয়েছেন। তবে সাভারের সাংবাদিক শামছুজ্জামান পালাননি। কিছু বুঝে ওঠার আগেই তিনি গ্রেফতার হয়ে যান। দু’দিন বাদে মুক্তিও মেলে তার। কিন্তু মুক্তিতেই সব প্রশ্নের সমাধান পাওয়া যায়নি। তার করা নিউজটি এখনো উদ্দেশ্যপ্রণোদিত বিতর্কিত নিউজ হিসেবেই রয়ে গেছে। যে জাকির হোসেনের বরাতে স্বাধীনতা দিবসের দিন দেশের স্বাধীনতাকে কটাক্ষ্য করে নিউজটি বানিয়েছেন, আজো সেই জাকির হোসেনকে তারা হাজির করেননি মিডিয়ার সামনে। কারণ হয়ত একটাই; হয় জাকির হোসেন ভয়তে মিডিয়ায় আসেনি, নয় এই নামের চরিত্রটাই কাল্পনিক এবং বানোয়াট। বানোয়াট না হলেও সবুজের ছবি তোলায়ও ঘাপলা আছে। শিশু সবুজ সেটা নিজ বয়ানেই মিডিয়ায় জানিয়েছে।
জানিয়েছে, তাকে ১০ টাকা দিয়ে ছবি তোলা হয়েছে। কাজেই নিউজটি সামান্য ভুল বলে চালাবার চেষ্টা করা হলেও বুঝতে হবে এর পেছনে অসামান্য অসৎ পরিকল্পনা ছিল। বস্তুনিষ্ঠ সংবাদের নামে বিকৃত স্টোরি তৈরি করা জাস্ট অনৈতিকতা। স্বাধীনতার মত একটা স্পর্শকাতর বিষয় নিয়ে এমন করা ধৃষ্টতা। এটা প্রমাণিত, শামছুজ্জামান ৯ বছরের একটি শিশুকে ১০ টাকা দিয়ে নিজের ভাষ্য ওই শিশুকে দিয়ে বলিয়েছিলেন। এটি অবশ্যই চাইল্ড অ্যাবিউজ ও এক্সপ্লয়েটেশন। মহান স্বাধীনতা দিবসে তিনি বাংলাদেশের স্বাধীনতাকে খাটো করে দেখানোর চেষ্টা করেছেন যা অবশ্যই অপরাধযোগ্য শাস্তি ।
প্রতিটি নাগরিকের বাক প্রকাশে স্বাধীনতা থাকা দরকার। কিন্তু প্রতারণামূলক কাজের মাধ্যমে সামাজিক অস্থিরতা তৈরি করা সৎ সাংবাদিকতার পরিপন্থী। চুলচেরা বিশ্লেষণে ঐ সংবাদটি নিংসন্দেহে কৌশলী এবং অসৎ উদ্দেশ্যমূলক। এমন কাজ পত্রিকাটি আগেও করেছে। সুকৌশলে করেছে। তাদের কূটকৌশল ধরিয়ে দেবার কাজ একক ভাবে করে গেছেন প্রথিতযশা প্রয়াত সাংবাদিক গাফ্ফার চৌধুরী। এ নিয়ে তিনি দিনের পর দিন কলাম লিখেছেন। জাতিকে সত্য তুলে ধরে পত্রিকাটির আসল মোটিভ চেনাবার চেষ্টা করেছেন।
পত্রিকাটি যত না সাংবাদিকতা করে, তার চেয়ে ঢের বেশি করে একটি নতুন রাজনৈতিক শক্তি হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠা করার কাজ। প্রবল পরাক্রমশালী বিদেশীশক্তির সহযোগিতা নিয়েই দীর্ঘদিন ধরে কাজটি করে যাচ্ছে। ২০০৬ এর জরুরী আইন আর মাইনাস টু ফরমুলা তার চাক্ষুস উদাহরণ। তখন পারেনি। মুখে যতই সাংবাদিকতার স্বাধীনতার কথা বলুক, আরেকটি নতুন এক এগারো সৃষ্টির উদ্দেশ্যে পর্দার অন্তরালে থেকে এমন প্রচেষ্টা আজো থামেনি।
মনে রাখতে হবে, সাংবাদিকতার স্বাধীনতা এক জিনিস আর সেই স্বাধীনতার নামে দেশের স্বাধীনতাকে কূটকৌশলে প্রশ্নবিদ্ধ করা অন্য জিনিস। এই দুই স্বাধীনতাকে এক করার সুযোগ নেই। একে আলাদাভাবে দেখতে হবে। আলাদা ভাবে রাখতে হবে। তা না করে এই দুইকে গুলিয়ে ফেললে সেটা হবে রাষ্ট্রদ্রোহীতার সামিল। রাষ্ট্র এই স্বাধীনতা কাউকে দেয়নি। কোনদিনও দেবে না। দেবার প্রশ্নই ওঠে না!!!

-লেখক: উপদেষ্টা সম্পাদক, যুগবার্তা।