Home মতামত “তোরা ভোগের পাত্র ফেলরে ছুঁড়ে ত্যাগের তরে হৃদয় বাঁধ”

“তোরা ভোগের পাত্র ফেলরে ছুঁড়ে ত্যাগের তরে হৃদয় বাঁধ”

24

সোহেল সানি:

“তোরা ভোগের পাত্র ফেলরে ছুঁড়ে ত্যাগের তরে হৃদয় বাঁধ।” আল্লাহর নৈকট্যলাভে কুরবানী বা ঈদুল আযহার তাৎপর্যকে প্রোজ্জ্বল করে তুলেছেন জাতীয় কবি নজরুল তাঁর কাব্যিক ছন্দ ধারায়। যেমনটি কবির ঈদুল ফিতরের ফল্গুধারা, “রমযানের এই রোযাশেষে এলো খুশীর ঈদ..” হযরত ইব্রাহিম (আঃ) পবিত্র কুরআনে মুসলিম জাতির পিতা। কুরবানের সৃষ্ট-ধারায় হযরত ইব্রাহীম (আঃ) বিবি হাজেরা ও ইসমাঈলের এক পরম ত্যাগ মুসলিম জাতির জন্য একটি মহত্তম আদর্শ। কুরবান বা কুরবানীকে তাঁদের স্মৃতিবিজড়িত একটি উৎসবও বলা হয়। কাফির- মুশরিকরা তাদের দেব-দেবী ও কবর-বেদীতে পুজো দেয় ও মূর্তির সম্মানে পশু বলী দেয়। প্রতিবাদস্বরূপ আল্লাহ তাঁর উদ্দেশ্যে ছালাত আদায়ে কুরবান করার আদেশদান করেন। ইব্রাহিম (আঃ) কর্তৃক তাঁর শিশুপুত্র ইসমাঈল (আঃ) কে আল্লাহর রাহে বা নামে কুরবানি দেয়ার অনুসরণে “সুন্নাতে ইব্রাহীমী হিসেবে চালু হয়। মক্কা নগরীর জনমানবহীন মিনা প্রান্তরে আল্লাহর আত্মনিবেদিত দুই বান্দা ইব্রাহিম ও ইসমাঈল আল্লাহর কাছে নিঃশর্ত আত্মসমর্পণের মাধ্যমে তুলনাহীন দৃষ্টান্ত স্থাপন করেন। বর্ষপরম্পরায় এরপর থেকে কুরবানি দিয়ে আসেন পরবর্তী নবীগণও। আল্লাহর জন্যই এই রীতি প্রবর্তিত হবার পর এটি মুসলিম সমাজে সামাজিক রীতি হিসেবে চালু রয়েছে। ঈদুল আযহার দিন সমগ্র মুসলিম জাতি ইবরাহীমী সুন্নাত পালনের মাধ্যমে আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের প্রাণপণ চেষ্টা করে। কুরবানীর স্মৃতিবাহী যিলহজ্জ মাসে হজ্জ উপলক্ষে সমগ্র পৃথিবী থেকে লাখ লাখ মুসলমান সমবেত হয় ইবরাহীম (আঃ)-এর স্মৃতি বিজড়িত মক্কা-মদীনায়। তাঁরা ইবরাহীমী আদর্শে আদর্শবান হওয়ার জন্য জীবনের সর্বশক্তি দিয়ে চেষ্টা করেন। হজ্জ মুসলিম উম্মাহর ঐক্য, সংহতি ও ভ্রাতৃত্ববোধের এক অনন্য উদাহরণ। পবিত্র কুরআনে “কুরবান” শব্দ ব্যবহৃত হলেও ফারসী ও হিন্দি- উর্দুতে শব্দটিকে “কুরবানী” রুপ দেয়া হয়েছে। অর্থ “নৈকট্য”। চিত্তশুদ্ধির ও পবিত্রতার প্রধান মাধ্যম হলো কুরবান। মুহাম্মদ (সাঃ) বলেছেন, “সামর্থ্য থাকা সত্ত্বেও যে ব্যক্তি কুরবানী করলো না, সে যেনো আমাদের ঈদগাহের নিকটবর্তী না হয়।” সুন্নাতে ইব্রাহীম” হিসেবে রাসুলুল্লাহ (সঃ) সয়ং মদীনায় প্রতিবছর আদায় করেছেন। ছাহবীরাও তাঁর পথ অনুসরণ করেন। অতঃপর অবিরত ধারায় মুসলিম উম্মাহ সামর্থবানদের মধ্যে এটা চালু হয়। কুরবানীর স্মৃতিবাহী যিলহজ্জ মাসে হজ্জ উপলক্ষে সমগ্র পৃথিবী থেকে লাখ লাখ মুসলমান সমবেত হয় ইবরাহীম (আঃ)-এর স্মৃতি বিজড়িত মক্কা-মদীনায়। তাঁরা ইবরাহীমী আদর্শে আদর্শবান হওয়ার জন্য জীবনের সর্বশক্তি দিয়ে চেষ্টা করেন। হজ্জ মুসলিম উম্মাহর ঐক্য, সংহতি ও ভ্রাতৃত্ববোধের এক অনন্য উদাহরণ। মানুষের আল্লাহর নৈকট্যলাভে কুরবানী হচ্ছে সর্বোত্তম উপায়। একমাত্র আল্লাহর কাছেই মানুষ প্রতিমুহূর্তেই করুণালাভের প্রত্যাশী। কেননা বিত্তবৈভব সমাজ, সংসার, রাষ্ট্র আল্লাহর উদ্দেশ্যেই নিবেদিত। পারিভাষিক অর্থে ‘কুরবানী’ এ মাধ্যমকে বলা হয়, যার দ্বারা আল্লাহর নৈকট্য হাছিল হয়। প্রচলিত অর্থে ঈদুল আযহার দিন আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের উদ্দেশ্যে শারঈ তরীকায় যে পশু যবহ করা হয়, তাকে ‘কুরবানী’ বলা হয়’। সকালে রক্তিম সূর্য উপরে ওঠার সময়ে ‘কুরবানী’ করা হয় বলে এই দিনটিকে ‘ইয়াওমুল আযহা’ বলা হয়ে থাকে। কুরবানী মুসলমানদের জন্য একটি ধর্মীয় ইবাদতও। যিলহজ্জ মাসের দশ থেকে বারো তারিখের মধ্যে এই ইবাদত পালন করতে হয়। ঈদুল আযহার গুরুত্ব অপরিসীম। কুরআন-হাদীছে এ ব্যাপারে যথেষ্ট তাকীদ দেয়া হয়েছে। আল্লাহ বলেন,আর কুরবানীর পশু সমূহকে আমরা তোমাদের জন্য আল্লাহর নিদর্শন সমূহের অন্তর্ভুক্ত করেছি। এর মধ্যে তোমাদের জন্য কল্যাণ রয়েছে’ (হজ্জ ৩৬)। আল্লাহ আরও বলেন, ‘আর আমরা তাঁর (ইসমাঈলের) পরিবর্তে যবহ করার জন্য দিলাম একটি মহান কুরবান। আমরা এটিকে পরবর্তীদের মধ্যে রেখে দিলাম’ (ছাফফাত ১০৭-১০৮)। আল্লাহ বলেন, ‘তুমি তোমার প্রতিপালকের উদ্দেশ্যে ছালাত আদায় কর এবং কুরবানী কর’ (কাওছার ২)। আমাদের প্রিয় নবী মুহাম্মাদ (সাঃ) বলেছেন, ‘সামর্থ্য থাকা সত্ত্বেও যে ব্যক্তি কুরবানী করল না, সে যেন আমাদের ঈদগাহের নিকটবর্তী না হয়’। ফলে প্রতি বছরই আমাদেরকে তাওহীদী প্রেরণায় উজ্জীবিত করে। আমরা নিবিড়ভাবে অনুভব করি বিশ্ব মুসলিম ভ্রাতৃত্ব। ঈদের উৎসব একটি সামাজিক উৎসব, সমষ্টিগতভাবে আনন্দের অধিকারগত উৎসব। ঈদুল আযহা উৎসবের একটি অঙ্গ হচ্ছে কুরবানী। কুরবানী হ’ল চিত্তশুদ্ধির এবং পবিত্রতার মাধ্যম। এটি সামাজিক রীতি হ’লেও আল্লাহর জন্যই এ রীতি প্রবর্তিত হয়েছে। তিনিই একমাত্র বিধাতা প্রতিমুহূর্তেই যার করুণা লাভের জন্য মানুষ প্রত্যাশী। আমাদের বিত্ত, সংসার এবং সমাজ তাঁর উদ্দেশ্যেই নিবেদিত এবং কুরবানী হচ্ছে সেই নিবেদনের একটি প্রতীক।মানুষ আল্লাহর জন্য সর্বোচ্চ ত্যাগ স্বীকার করবে, এই শিক্ষাই ইবরাহীম (আঃ) আমাদের জন্য রেখে গেছেন। মহানবী মুহাম্মাদ (ছাঃ) আমাদের জন্য ঐ ত্যাগের আনুষ্ঠানিক অনুসরণকে বিশেষ মর্যাদা দিয়ে গেছেন। আর ঈদুল আযহার মূল আহবান হ’ল সৃষ্টিকর্তা আল্লাহর প্রতি একনিষ্ঠ আনুগত্য প্রকাশ করা। সকল দিক হ’তে মুখ ফিরিয়ে এক আল্লাহর দিকে রুজু হওয়া। সম্পদের মোহ, ভোগ-বিলাসের আকর্ষণ, সন্তানের স্নেহ, স্ত্রীর মুহাববত সবকিছুর ঊর্ধ্বে আল্লাহর সন্তুষ্টি প্রতি আত্মসমর্পণ করে দেওয়াই হ’ল ঈদুল আযহার মূল শিক্ষা। স্বামী, স্ত্রী ও শিশুপুত্রের গভীর আত্মবিশ্বাস, অতলান্তিক ঈমানী প্রেরণা, আল্লাহর প্রতি নিশ্চিন্ত নির্ভরতা ও অবশেষে আল্লাহকে খুশী করার জন্য তাঁর হুকুম মোতাবেক জীবনের সর্বাধিক প্রিয় একমাত্র সন্তানকে নিজ হাতে যবহ করার কঠিনতম পরীক্ষায় উত্তরণ-এসবই ছিল আল্লাহর প্রতি অটুট আনুগত্য, গভীর আল্লাহভীতি এবং নিজের তাওহীদ ও তাকওয়ার সর্বোচ্চ পরাকাষ্ঠা। ইবরাহীম (আঃ) আল্লাহর হুকুমে পুত্র কুরবানী করেছিলেন। মূলতঃ তিনি এর দ্বারা পুত্রের মুহাববতকে কুরবানী করেছিলেন। আল্লাহর ভালোবাসার চাইতে যে পুত্রের ভালোবাসা বড় নয়, এটিই প্রমাণিত হয়েছে তাঁর আচরণে। আল্লাহ এটাই চেয়েছিলেন। আর এটাই হ’ল প্রকৃত তাক্বওয়া বা আল্লাহভীতি।

মানুষ আল্লাহর জন্য সর্বোচ্চ ত্যাগ স্বীকার করবে, এই শিক্ষাই ইবরাহীম (আঃ) আমাদের জন্য রেখে গেছেন। মহানবী মুহাম্মাদ (ছাঃ) আমাদের জন্য ঐ ত্যাগের আনুষ্ঠানিক অনুসরণকে বিশেষ মর্যাদা দিয়ে গেছেন। আর ঈদুল আযহার মূল আহবান হ’ল সৃষ্টিকর্তা আল্লাহর প্রতি একনিষ্ঠ আনুগত্য প্রকাশ করা। সকল দিক হ’তে মুখ ফিরিয়ে এক আল্লাহর দিকে রুজু হওয়া। সম্পদের মোহ, ভোগ-বিলাসের আকর্ষণ, সন্তানের স্নেহ, স্ত্রীর মুহাববত সবকিছুর ঊর্ধ্বে আল্লাহর সন্তুষ্টি প্রতি আত্মসমর্পণ করে দেওয়াই হ’ল ঈদুল আযহার মূল শিক্ষা। স্বামী, স্ত্রী ও শিশুপুত্রের গভীর আত্মবিশ্বাস, অতলান্তিক ঈমানী প্রেরণা, আল্লাহর প্রতি নিশ্চিন্ত নির্ভরতা ও অবশেষে আল্লাহকে খুশী করার জন্য তাঁর হুকুম মোতাবেক জীবনের সর্বাধিক প্রিয় একমাত্র সন্তানকে নিজ হাতে যবহ করার কঠিনতম পরীক্ষায় উত্তরণ-এসবই ছিল আল্লাহর প্রতি অটুট আনুগত্য, গভীর আল্লাহভীতি এবং নিজের তাওহীদ ও তাকওয়ার সর্বোচ্চ পরাকাষ্ঠা। ইবরাহীম (আঃ) আল্লাহর হুকুমে পুত্র কুরবানী করেছিলেন। মূলতঃ তিনি এর দ্বারা পুত্রের মুহাববতকে কুরবানী করেছিলেন। আল্লাহর ভালোবাসার চাইতে যে পুত্রের ভালোবাসা বড় নয়, এটিই প্রমাণিত হয়েছে তাঁর আচরণে। আল্লাহ এটাই চেয়েছিলেন। আর এটাই হ’ল প্রকৃত তাক্বওয়া বা আল্লাহভীতি। ইবরাহীম (আঃ) তাঁর প্রিয়পুত্র ইসমাঈল (আঃ)-কে কুরবানী করে এক বিস্ময়কর দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন, যাতে অনাগত ভবিষ্যতের অগণিত মানুষ আল্লাহর নিকট আত্মসমর্পণের বাস্তব শিক্ষা লাভ করতে পারে। প্রতি বছর যিলহজ্জ মাসে মুসলিম জাতি পশু কুরবানীর মাধ্যমে ইবরাহীম (আঃ)-এর স্মৃতি স্মরণ করে এবং পশু কুরবানীর সাথে সাথে নিজেদের পশুবৃত্তিকে কুরবানী দিয়ে আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের চেষ্টা করে। ইসমাঈল নবীন বয়সেই বিশ্ববাসীকে আত্মসমর্পণের এক বাস্তব ও জ্বলন্ত শিক্ষা প্রদান করেন। মূলতঃ আল্লাহর রাহে নিজের সর্বস্ব বিলিয়ে দেওয়ার নামই হ’ল আত্মসমর্পণ। পিতা-পুত্র আল্লাহর প্রতি পূর্ণ আত্মসমর্পণের যে অনুপম আদর্শ স্থাপন করে গেছেন, তা যেমন অতুলনীয়, তেমনি চির অনুকরণীয়। আজকে ইবরাহীমী আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে পশু কুরবানীর সাথে সাথে আমাদের দৃপ্ত শপথ নিতে হবে যে, আল্লাহর সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে জান, মালসহ যেকোন ত্যাগ স্বীকার করতে আমরা প্রস্ত্তত আছি। আর এটিই হ’ল কুরবানীর শিক্ষা। এই স্বর্ণোজ্জ্বল আদর্শ যুগে যুগে বিশ্ববাসীকে বারবার এই পরম সত্যটিকেই হৃদয়ঙ্গম করাতে চেয়েছে যে, আল্লাহই ইবরাহীম (আঃ) সকল পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন করেছিলেন, হয়েছিলেন স্বয়ং আল্লাহ ঘোষিত মানবজাতির ইমাম। তিনি মানবজাতির আদর্শ। আল্লাহ বলেন, ‘তোমরা যারা আল্লাহ ও পরকালের ভয় কর তাদের জন্যে ইবরাহীম ও তাঁর অনুসারীদের মধ্যে রয়েছে উত্তম আদর্শ’ (মুমতাহিনা ৪-৬)। আদম (আঃ)-এর সময় থেকেই চলে আসা কুরবানীর প্রথা পরবর্তীকালের সকল নবী-রাসূল, তাঁদের উম্মত আল্লাহর নামে, কেবল তাঁরই সন্তুষ্টির জন্য কুরবানী করে গেছেন। এ কুরবানী কেবল পশু কুরবানী নয়। নিজের পশুত্ব, নিজের ক্ষুদ্রতা, নীচতা, স্বার্থপরতা, হীনতা, দীনতা, আমিত্ব ও অহংকার ত্যাগের কুরবানী। নিজের ছালাত, কুরবানী, জীবন-মরণ ও বিষয়-আশয় সব কিছুই কেবল আল্লাহর নামে, শুধু তাঁরই সন্তুষ্টির জন্য চূড়ান্তভাবে নিয়োগ ও ত্যাগের মানস এবং বাস্তবে সেসব আমল করাই হচ্ছে প্রকৃত কুরবানী। এই কুরবানীর পশু যবেহ থেকে শুরু করে নিজের পশুত্ব যবেহ বা বিসর্জন এবং জিহাদ-কিতালের মাধ্যমে আল্লাহর রাস্তায় শাহাদতবরণ পর্যন্ত সম্প্রসারিত। এই কুরবানী মানুষের তামান্না, নিয়ত, প্রস্তুতি, গভীরতম প্রতিশ্রুতি থেকে আরম্ভ করে তার চূড়ান্ত বাস্তবায়ন পর্যন্ত সম্প্রসারিত। একমাত্র সার্বভৌম ক্ষমতার মালিক, তাঁর ইচ্ছা ও সন্তুষ্টির প্রতি আনুগত্য প্রদর্শনই প্রকৃত মুমিনের কাজ এবং তাতেই নিহিত রয়েছে অশেষ কল্যাণ ও প্রকৃত সফলতা।

-লেখকঃ সিনিয়র সাংবাদিক, কলামিস্ট ও ইতিহাস গবেষক।