Home মতামত তোমার মত লয় না কেহ আমায় বুকে টানি!আঁচল দিয়ে মুছে না কেউ...

তোমার মত লয় না কেহ আমায় বুকে টানি!আঁচল দিয়ে মুছে না কেউ আমার চোখের পানি!!

59

সরদার মোঃ শাহীন

যখন দেশে থাকি, রোজ সকালের এক রুটিন; এক অভ্যাস। নিজ থেকে ইচ্ছে করে বানিয়ে নেয়া বহু দিনের পুরনো অভ্যাস। তবে জটিল কোন অভ্যাস নয়। বলছিলাম সকালের ঘুম ভাঙে ভাঙে সময়ের কথা। কিছুক্ষণ আড়মোড় ভেঙে সকালের বিছানা ছাড়ি প্রতিদিন। ছেড়েই খালি পেটে ঢকঢক করে এক গ্লাস পানি চাইই চাই। লেবুর রসে বানানো অমস্বাদের পানি। সাথে ইসবগুলের দানা ভিজানো। বড় উপকারের জিনিস।

ব্যাস, এবার শান্তি! পেট শান্তি তো সব শান্তি। এরপর শান্তিমনে কিছুক্ষণ মোবাইল টিপতে বসি। বসি মানে, বসে বসে ম্যাসেজ দেখি। দরকারি বেদরকারি সব ম্যাসেজ। তারপর ফ্রেশ হয়ে সোজা নাস্তার টেবিল। টেবিলে রোজ রোজ একই খাবার। দুটো পাতলা শুকনো রুটি; সাথে হয় সবজি ভাজি, নয় কুসুমছাড়া ডিমের সাদা অংশ ভাজি। তবে একটি ডিম নয়, দুটো ডিমের ভাজি। সেই সাথে একটু টক দই। ব্যাস! এভাবেই চলছে বছরের পর বছর আমার সকালের নাস্তা। নাস্তার রুটিন করা মেন্যু।

রুটি খাই বেশ আয়েশ করে। গরম গরম রুটি দুটো হাতে নিয়ে প্রথমে একটু নাড়াচাড়া করি। কিছুটা ভান করেই করি। ভান করারও একটা ধরন আছে। প্রথমে উপরের রুটি নীচে রাখি। পরে নীচেরটা উপরে। কখনো নাকের কাছে এনে ঘ্রাণও শুকি। ইচ্ছে করেই শুকি। তারপরই একটু একটু ছিড়ে ছিড়ে মুখে পুরি। রুটি দুটো নিয়ে এই ভান ভান খেলাটা আমি রোজ খেলি। তবে খেলাটা কখনোই কেউ লক্ষ্য করেছে বলে আজো আমার মনে হয়নি। এমন কি আমার শোনিমের আম্মুও করেছে কি না জানি না।

জানার কথাও না। সংসার সন্তান নিয়ে এত কাজের মাঝে আমার এই তুচ্ছ খেলা তার নজরে পরার কথা না। তবে প্রথম প্রথম পরতো। প্রথম প্রথম মানে, বিয়ের প্রথম প্রথম। সে কী খেয়াল আমার সবকিছুতে! রুটি পাতলা খাই, না কি ভারী। পরোটা হলে তেলে ভাজা পরোটা, না কি ঘিয়ে ভাজা। আবার চিবিয়ে খাই, না কি দুটো কামড় দিয়েই গলায় পুরি সব খেয়াল করতো। তাকিয়ে থাকতো। হা করে তাকিয়ে থাকতো।

ভাবতাম এভাবেই বুঝি জীবন যাবে। কিন্তু জীবনের তো একটা নিয়ম আছে। বড় জটিল নিয়ম। সময়ের নিয়ম। সময় সব সময় একরকম যায় না। এখন আর বেচারী হা করে তাকিয়ে থাকে না। থাকার সময় কোথায় নিজের ভাগের নাস্তাটাই কোনরকমে মুখে পুরে দিন শুরু করে। সংসারী দিন। সংসার জীবনে দিন শুরু হয় সকালে বটে। তবে শেষ হয় না। শেষ হতে হতে সেই মধ্যরাত।

আমার মায়েরও ঠিক এমন হতো। কিন্তু শোনিমের মায়ের মত তার এত সুবিধাদি ছিল না। হাতের নাগালে সবকিছু ছিল না। গ্যাস ছিল না, বিদ্যুৎ ছিল না। কেরোসিনের হারিকেনের হালকা আলোয় রাতের সংসার করা লাগতো মাকে। বাইরের চুলায় ভিজা লাকড়ী ফুঁ দিয়ে ফুঁ দিয়ে রান্না করতে হতো। কিন্তু আগুন কি আর সহজে জ্বলতো! বরং ধোঁয়ায় ভরে যেত আঙিনা। তবুও চুলা আগুনে ভরে উঠতো না।

সাত সকালের এমনি চুলায় মা বসতেন রুটি ভাজতে। একহাতে আটার খামি করছেন, আর অন্যহাতে চুলায় আগুন জ্বালাবার আয়োজন। ভেজা লাকড়ী চুলায় দিয়ে হালকা কেরোসিন ছিটিয়ে দিতেন। তারপর দিয়াশলাইয়ের কাঠি দিয়ে আগুন জ্বালাবার গলদঘর্ম প্রচেষ্টা। কোন রকমে চুলায় আগুন ধরানো হলে চায়ের পাতিল চড়িয়ে দিতেন। পানি গরম হতে থাকতো। আর তিনি থাকতেন রুটি ভাজার কাজে। পিড়ি বেলুনের কৌশলী চাপে ঘুরে ঘুরে আটার দলা আস্তে আস্তে গোল রুটিতে রূপ নিত।

এক অপূর্ব দৃশ্য ছিল সে সব। আর্টিস্টিক রূপ। রোজ সকালে পাশে বসে মন্ত্রমুগ্ধের মত আমি সেসব দেখতাম। পেটে ক্ষুধা নিয়েই দেখতাম। মাঝেমাঝে বাতাসের যন্ত্রণায় ধোঁয়া আমার চোখেমুখেও লাগতো। মায়ের সেদিকে খেয়াল। নিজে ধোঁয়া সইতে পারতেন। কিন্তু আমারটা পারতেন না। ধোঁয়ায় আমার চোখ পানিতে ভরে উঠছে। আঁচল দিয়ে আমার চোখের পানি মুছে দিতেন মা আমার। আবার বেশি ধোঁয়ায় চোখ জ্বালাপোড়া বাড়বে ভেবে মা আমার মুখ ঘুরিয়ে বসাতেন। কিংবা বলতেন, মুখটা ঘুরে বস বাবা! চোখে বেশি ধোঁয়া লাগলে কষ্ট হবে তোর!!

অথচ সারাটি দিন এই মানুষটি রাজ্যের কষ্ট করে বেড়াতেন। পূবাইলে আমাদের ছিল বোরো ধানের জমি। অনেক জমি ছিল। প্রচুর ধান হতো। ফিবছর বর্গাচাষী ধান চাষ করলেও আমাদের ভাগের ধান মাকেই সামলাতে হতো। আব্বার চাকরির সুবাদে মা ভিন্ন স্থানে থাকলেও বৈশাখ এলে সোজা পূবাইলে চলে যেতেন। ওখানকার আমাদের সব জমি এক ফসলী জমি। তাই ফসল নিয়ে হেলাফেলা করা চলবে না।

বাড়ির বড় উঠোন। মা নিজহাতে গোবর মাখানো পানি দিয়ে উঠোন লেপে দিয়েছেন। পরপর তিনবার দিয়েছেন। ধুলোমুক্ত উঠোন বানানোর এ এক মহাকৌশল। আগেকার দিনে কৃষককূল কত বুদ্ধিই না জানতো। ধান মাড়াই হবে। কিন্তু যতটা সম্ভব ধুলোমুক্ত ধান হতে হবে। তাই উঠোনকে গোবর মেখে ধুলোমুক্ত করা। ধুলোমুক্ত উঠোনে বর্গাচাষীরা মাথায় করে আটির পর আটি কাটাধান এনে ফেলছেন। কাঁচা ধানের মৌ মৌ গন্ধে আকাশ ভারী হচ্ছে।

এদিকে গাই গরু নয়, চার পাঁচটা বিশেষ বলদ গরু আনা হয়েছে ধানের মলন দেয়ার জন্যে। দিনভর ধান কেটে রাতভর মলন দেবে। মলন দেয়া মনে, মাড়াই করা; গাছ থেকে ধানকে আলাদা করা। ধানসহ গাছের উপর দিয়ে হেঁটে হেঁটে বলদ গরুগুলো সারারাত গাছকে আলাদা করছে। আর শুকনো গাছ বা খড়ের নীচে জমছে সোনালী ধানের স্তুপ। একটা ধান উৎসবের পরিবেশ। নবান্নের উৎসব।

এমনি উৎসবে মা আমার ঘুমান না। রাতভর জেগে থাকেন। স্বাভাবিক সময়ের ঘুম পাগল মানুষটির চোখে এই সময়ে ঘুম থাকে না এক ফোঁটাও। ঘুমালে কাজের ছন্দ পতন হতে পারে। তাই রাতজেগে মা পাহারায় থাকেন। তবে এমনি এমনি বসে থাকেন না। একটু পর পর চা বানিয়ে দেন সবাইকে। গুড়ের চা। ছোট্ট ছোট্ট কাঁচের গ্লাসে কড়া মিষ্টি গুড়ের চা।

এদিকে আমি ঘুমের চোখে ঘরের যেখানে জায়গা পেয়েছি সেখানেই শুয়ে পরেছি। মা কাছে এসে ঘুম পাড়াবে এই আশায় থাকতে থাকতে কখন যে ঘুমিয়ে গেছি জানিও না। অথচ কাকডাকা ভোরে ঘুম ভাঙলে দেখতাম ঠিক ঠিক মায়ের কোলেই ঘুমিয়ে আছি। মা ঘুমাননি বটে। কিন্তু জেগে থেকেই আমাকে কোলের মধ্যে নিয়ে শুয়ে আছেন। শুধু কি শুয়ে থাকা! আঁচলে আমার পিঠটা ঢেকে বুকটার মধ্যে পেঁচিয়ে নিয়ে শুয়ে থাকা। আর একটু পর পর চুমু। কপালে, গালে কোথায় দিতেন না সেই চুমু!

চুমু দিতেন সকালে রুটি ভাঁজার সময়েও। ধোঁয়া আর আগুনের ছোঁয়ায় ঘামে মাখামাখি মা আমার। আবার চোখভর্তিও জল। ধোঁয়ার কারণে জল। ওদিকে খেয়াল নেই আমার। পাশে বসে ছোট্ট এই আমি চায়ে ভিজিয়ে ভিজিয়ে সদ্য ভাজা রুটি চিবিয়ে চিবিয়ে খাচ্ছি। একেকটা রুটি পেঁচিয়ে গোল করে ভিজিয়ে খাচ্ছি। অমৃতের মত লাগছে। দৃশ্যটির মাঝে সুন্দরের কিছু ছিল কিনা জানি না। কিন্তু মা আমাকে চেয়ে চেয়ে দেখতেন, আর মাথাটি তার বুকের কাছে, গলার কাছে নিয়ে আদর করে দিতেন। মায়ের গায়ের গন্ধ আর রুটির ঘ্রাণ একাকার হয়ে যেত।

বড় অদ্ভুত সে ঘ্রাণ। আজো প্রতিদিনের নাস্তার টেবিলে দেয়া রুটির গায়ে আমার মায়ের গন্ধমাখা সেই স্বর্গীয় ঘ্রাণ আমি খুঁজে ফিরি! বড় চুপি চুপি খুঁজি। পাতলা সাইজের দুটো শুকনো রুটির প্রতিটি ভাঁজে, প্রতিটি কোণায় খুঁজি। আমার রোজকার সকালটাই শুরু হয় মায়ের গন্ধ খুঁজে! এবার নিয়ে গেল এগারোটা বছর আমি এমনি করেই খুঁজে ফিরছি!! হয়ত কাল থেকে কালান্তরেও খুঁজে ফিরবো!!!

-লেখক: উপদেষ্টা সম্পাদক, যুগবার্তা।