Home মতামত তেভাগা আন্দোলনের কিংবদন্তি বিপ্লবী কমরেড ইলা মিত্রের ২১তম প্রয়াণ দিবস আজ

তেভাগা আন্দোলনের কিংবদন্তি বিপ্লবী কমরেড ইলা মিত্রের ২১তম প্রয়াণ দিবস আজ

60

সৈয়দ আমিরুজ্জামান |

আজীবন সংগ্রামী ও কালের মনীষী, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দর্শন বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক, বিশিষ্ট দার্শনিক, শিক্ষাবিদ, সাহিত্যিক, জ্ঞানতাপস ও প্রবন্ধকার সরদার ফজলুল করিম তেভাগা আন্দোলনের কিংবদন্তি বিপ্লবী কমরেড ইলা মিত্র সম্পর্কে লিখেছেন, “এমন সংগ্রামী নেত্রী ও নেতা ইতিহাসে খুব কম আসেন। তাই প্রয়াত ইলা মিত্র আমাদের স্বপ্ন আশার এক বিরল প্রতীক। তাঁর সংগ্রামী জীবনের ইতিহাস আমাদের জীবনের ইতিহাস; আমাদের জীবনের মহৎ ঐতিহ্যের ভাণ্ডার। সেই মহৎ ঐতিহ্যের উত্তরাধিকারী আমরা; নতুন প্রজন্মের সংগ্রামী মানুষেরা :দেশ এবং কাল নির্বিশেষে বর্তমান মুহূর্তের পৃথিবীর সকল নির্যাতিত-নিপীড়িত মানুষ। মহৎ ঐতিহ্যের এমন প্রতীকের মৃত্যু নেই। মৃত্যু থাকে না। সেই মহৎ ঐতিহ্যকে আমাদের ক্রমাধিকভাবে অনুসন্ধান করতে হবে; আবিস্কার করতে হবে এবং ঐতিহ্যের সেই সম্ভাবের অপরাজেয় শক্তির বোধে আমাদের উদ্বুদ্ধ হতে হবে।
ইলাদি, আপনি মৃত নন; জীবিত। আপনার কাছে আমাদের জীবনের ঋণের শেষ নেই। আপনি আমাদের পাশে আছেন; আমাদের সাথে আছেন এবং আমাদের সংগ্রামের লাইনের একেবারে সম্মুখে আছেন। আমরা বলছি :জয়তু ইলা মিত্র। জয়তু ইলা মিত্র।”

নাচোলের কৃষকের কাছে রাণীমা রূপে সমাদৃতা, নাচোলের রাণী, বৃটিশ বিরোধী আন্দোলন ও তেভাগা আন্দোলনের জননন্দিত এবং কিংবদন্তি কমিউনিস্ট বিপ্লবী কমরেড ইলা মিত্রের ২১তম প্রয়াণ দিবস আজ।

বাঙালি মহীয়সী ও বিপ্লবী নারী এবং সংগ্রামী কৃষক নেতা ও সুলেখিকা। তিনি মূলত তেভাগা আন্দোলনের নেতৃত্ব দেবার জন্য সর্বাধিক পরিচিত ও জননন্দিত হয়েছেন। বাংলার শোষিত ও বঞ্চিত কৃষকের অধিকার প্রতিষ্ঠায় তিনি সংগ্রাম করেছেন। ভোগ করেছেন অমানুষিক নির্যাতন।

তেভাগা আন্দোলনের জননন্দিত কিংবদন্তি নেত্রী কমরেড ইলা মিত্র ১৯২৫ সালের ১৮ অক্টোবর কলকাতায় জন্মগ্রহণ করেন। জন্মের সময় ইলা মিত্র ছিলেন ইলা সেন। তাঁর বাবা নগেন্দ্রনাথ সেন ছিলেন বৃটিশ সরকারের অধীন বাংলার একাউন্টেন্ট জেনারেল। তাঁদের আদি নিবাস ছিল তৎকালীন যশোরের ঝিনাইদহের বাগুটিয়া গ্রামে। বাবার চাকুরির সুবাদে তাঁরা সবাই কলকাতায় থাকতেন। এ শহরেই তিনি বেড়ে ওঠেন। বাবা নগেন্দ্রনাথ সেন প্রথমে এ জি বেঙ্গলের এ্যাকাউন্টেন্ট- শেষে ডেপুটি এ্যাকাউন্টেন্ট জেনারেল হন। তিন বোন আর তিন ভাইয়ের মধ্যে ইলা মিত্র সকলের বড়। পড়ালেখা করেছেন কলকাতায় বেথুন স্কুলে ও পরে বেথুন কলেজে। ছোটবেলা থেকে খেলা, গান, আবৃত্তি, অভিনয় ও লেখাপড়ার প্রতি ছিলেন অত্যন্ত নিপুণ এবং ত্রিশের দশকে বাঙলার ক্রীড়া জগতের অন্যতম তারকা। এ্যাথেলেটিকস্ ছাড়াও বাস্কেটবল, ব্যাডমিন্টন, টেনিকোয়েট প্রভৃতি বিভিন্ন প্রতিযোগিতায় চ্যাম্পিয়ন হওয়ার গৌরব অর্জন করেন। তিনিই প্রথম বাঙালী মেয়ে, যিনি ১৯৪০ সালে হেলসিঙ্কিতে অলিম্পিকের জন্য নির্বাচিত হন। কিন্তু দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের জন্য সেবার অলিম্পিক স্থগিত থাকে।

কলেজে পড়াকালীন রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়েন তিনি। কলেজে ছাত্রী সংগঠন গড়ে তোলেন। ১৯৪২ সালে ‘ভারত ছাড়’ আন্দোলনে যোগ দিয়ে আত্মগোপনে থেকে কাজ করেন ও জনগণকে সংগঠিত করেন। ১৯৪৩ সালে মহিলা আত্মরক্ষা সমিতির সভ্য হন। ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির সদস্য পদ লাভ করেন ১৯৪৩ সালে। ১৯৪৫ সালে মালদহের কৃষক আন্দোলন ও কমিউনিস্ট পার্টির নেতা রমেন মিত্রের সঙ্গে তাঁর বিবাহ হয়। ঐ বছরেই চলে আসেন মালদহ জেলার নবাবগঞ্জের রামচন্দ্রপুরহাট গ্রামে শ্বশুর বাড়ীতে।

তেভাগা আন্দোলন ও ইলা মিত্র

তেভাগা আন্দোলনের ইতিহাস জানতে হলে সে সময়ের ভূমি ব্যবস্থা বিষয়ে জানা প্রয়োজন। বাংলার গ্রামীণ সমাজে বৃটিশ শাসনের আগ পর্যন্ত ভূমির মালিক ছিলেন চাষীরা। মোগল আমল পর্যন্ত তারা এক-তৃতীয়াংশ বা কখনো কখনো তার চেয়েও কম ফসল খাজনা হিসাবে জমিদার বা স্থানীয় শাসনকর্তার মাধ্যমে রাষ্ট্রকে প্রদান করতেন। বৃটিশ শাসন আমলে চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত প্রথা প্রচলনের ফলে চাষীদের জমির মালিকানা চলে যায় জমিদারদের হাতে। জমিদাররা জমির পরিমাণ ও উর্বরতা অনুযায়ী বৃটিশদের খাজনা দিত। জমিদারদের সাথে ফসল উৎপাদনের কোনো সম্পর্ক ছিল না। এ সময় জমিদার ও কৃষকদের মাঝখানে জোতদার নামে মধ্যস্বত্বভোগী এক শ্রেণির উদ্ভব ঘটে। এরা পত্তনি প্রথার মাধ্যমে জমিদারদের কাছ থেকে জমি পত্তন বা ইজারা নিত। এই জোতদার শ্রেণি কৃষকের জমি চাষ তদারকি ও খাজনা আদায়ের কাজ করতো। ফসল উৎপাদনের সম্পূর্ণ খরচ কৃষকেরা বহন করলেও যেহেতু তারা জমির মালিক নন সে অপরাধে উৎপাদিত ফসলের অর্ধেক তুলে দিতে হতো জোতদারদের হাতে। এ ব্যবস্থাকে বলা হতো ‘আধিয়ারী’। জোতদারি ও জমিদারি প্রথা ক্ষুদ্র কৃষকদের শোষণের সুযোগ করে দেয়। খাজনা আদায়ের জন্য জোতদাররা এদেরকে দাসের মতো ব্যবহার করে। উৎপন্ন ফসলের পরিবর্তে একসময় কৃষককে বাধ্য করা হয় অর্থ দিয়ে খাজনা পরিশোধ করতে। ফলে কৃষকেরা গ্রামীণ মহাজনদের কাছ থেকে ঋণ নিতে বাধ্য হন। সর্বস্বান্ত হয়ে এক সময়ের সমৃদ্ধ বাংলার কৃষক পরিণত হন আধিয়ার আর ক্ষেত মজুরে। জমিদার-জোতদারদের এই শোষণ কৃষকের মনে বিক্ষোভের জন্ম দেয়। এই বিক্ষোভকে সংগঠিত করে ১৯৩৬ সালে গঠিত হয় ‘সর্ব ভারতীয় কৃষক সমিতি’। ১৯৪০ সালে শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হক মন্ত্রিসভার উদ্যোগে বাংলার ভূমি ব্যবস্থা সংস্কারের প্রস্তাব দেয় ‘ফাউন্ড কমিশন’। এই কমিশনের সুপারিশ ছিল জমিদারি প্রথার উচ্ছেদ করে চাষীদের সরাসরি সরকারের প্রজা করা এবং তাদের উৎপাদিত ফসলের তিনভাগের দুইভাগের মালিকানা প্রদান করা। এই সুপারিশ বাস্তবায়নের আন্দোলনের জন্য কৃষক সমাজ ঐক্যবদ্ধ হতে থাকে। এছাড়া জনসাধারণের কাছ থেকে হাটের ‘তোলা’ ও ‘লেখাই’ সহ নানা কর আদায় করা হতো। এসব বন্ধের জন্য আন্দোলন জোরদার হয়। চল্লিশের দশকে এসব আন্দোলনেও ইলা মিত্র নেতৃত্ব দেন।

১৯৪২ সালে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরবর্তী সময়ে অর্থাৎ বাংলা ১৩৫০ সনে সমগ্র বাংলায় দেখা দেয় দুর্ভিক্ষ, যা পঞ্চাশের মন্বন্তর নামে পরিচিত। এ দুর্ভিক্ষের সময় কৃষকের ওপর শোষণের মাত্রা ভয়াবহ রূপ ধারণ করে। এসময়কার অর্থনৈতিক দুরবস্থা ও রাজনৈতিক অস্থিরতার ফলে মরিয়া হয়ে ওঠে শোষিত কৃষকেরা। তিনভাগের দুইভাগ ফসল কৃষকের এই দাবি নিয়ে বেগবান হয় তেভাগা আন্দোলন। ১৯৪৬-১৯৪৭ সালে দিনাজপুরে কমরেড হাজী দানেশের প্রচেষ্টায় ও নেতৃত্বে সূচিত হয় এক যুগান্তকারী তেভাগা আন্দোলন। কমিউনিস্ট পার্টি ও কৃষক সমিতি প্রান্তিক চাষীদের সংগঠিত করে আন্দোলনকে জোরদার করতে থাকে। পার্টি থেকে রমেন্দ্র মিত্রকে গ্রামের কৃষক সমাজের মধ্যে কাজ করার দায়িত্ব দিয়ে কলকাতা থেকে নিজ গ্রাম রামচন্দ্রপুর হাটে পাঠালে স্বামীর সাথে ইলা মিত্র সরাসরি মাঠ পর্যায়ে কৃষক সংগঠনের সাথে যুক্ত হন।
১৯৪৬ সালে হিন্দু মুসলিম দাঙ্গা শুরু হলে কমিউনিস্ট পার্টি দাঙ্গা বিধ্বস্ত এলাকায় সেবা ও পুনর্বাসনের কাজ করতে এগিয়ে আসে।

নোয়াখালীর দাঙ্গায় কমিউনিস্ট পার্টির ডাকে হাসনাবাদে চলে যান এবং দাঙ্গা-বিধ্বস্ত দুর্গত মানুষের সেবার কাজে আত্মনিয়োগ করেন। তাঁর শ্বশুরবাড়ীর রামচন্দ্রপুরহাট গ্রাম মুসলমান অধ্যুষিত অঞ্চল। ১৯৪৭ সালে দেশভাগের পর মালদহের ঐ অঞ্চল পূর্ব পাকিস্তানের রাজশাহী জেলার অন্তর্ভূক্ত হয়। দেশ ভাগের পর থেকে তিনি থেকে গেলেন পূর্ব পাকিস্তানে। শুরু করলেন মুসলিম মেয়েদের নিরক্ষরতার বিরুদ্ধে দুঃসাহসিক অভিযান। এর পাশাপাশি কৃষক সমিতির মাধ্যমে কৃষকদের জমির লড়াই ‘তেভাগা আন্দোলনে’ সামিল হয়ে তার নেতৃত্ব দিতে থাকেন আত্মগোপন করে। কৃষকের ঘরে ঘরে রাণীমা রূপে সমাদৃতা হলেন। ইতিহাস তাঁকে দাঁড় করাল নাচোলের মাঠে। পুলিশের গুলিতে প্রাণ দিল অসংখ্য সাঁওতাল কৃষক আর তাদের তীরে নিহত হ’ল জনা চার-পাঁচ পাকিস্তানী পুলিশ। জোতদার-জমিদারদের ত্রাস, মুসলিম লীগ সরকারের চক্ষুশূল কমরেড ইলা মিত্র ধরা পড়লেন পুলিশের হাতে। পাশবিক আক্রোশের বলি হয়ে বর্বরোচিতভাবে নির্যাতিত হলেন। ফলে মৃত্যু তাঁর শিয়রে এসে দাঁড়ায় বারবার। তবু তাঁকেই সেই অবস্থায় ফাঁসীর আসামী রূপে দাঁড় করান হল। অপর দিকে পূর্ব পাকিস্তানের প্রগতিশীল মানুষ, ছাত্র ও যুবসমাজ তাঁর মুক্তির জন্য তীব্র আন্দোলন গড়ে তোলেন। সারাবিশ্বে শুরু হল তাঁর মুক্তির জন্য বিক্ষোভ। এর ফলে ফাঁসীর কবল থেকে মুক্ত হয়ে যাবজ্জীবন কারাদন্ডে দন্ডিত হলেন। কিন্তু ১৯৫০-৫৪ চার বছর পূর্ব পাকিস্তানের জেলে থাকার পর অবস্থা মরণাপন্ন হয়ে উঠলে পাকিস্তানের সরকার তাঁকে প্যারোলে মুক্তি দিয়ে পশ্চিমবঙ্গে পাঠায়। কলকাতায় এসে দীর্ঘদিন চিকিৎসার ফলে তিনি কিছুটা সুস্থ হন। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এম.এ. পাশ করে ১৯৫৮ সালে সাউথ সিটি কলেজে (শিবনাথ শাস্ত্রী কলেজ) অধ্যাপনা শুরু করেন। ১৯৭২ সাল থেকে চারবার মানিকতলা কেন্দ্রে বিধানসভার সদস্যা নির্বাচিত হন। ১৯৬২ সাল থেকে শিক্ষক প্রতিনিধিরূপে পাঁচবার কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনেটে সদস্যা নির্বাচিত হয়েছেন। পরবর্তীতে ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির পশ্চিমবঙ্গ শাখার প্রাদেশিক কমিটির সদস্যা, ভারতীয় মহিলা ফেডারেশনের জাতীয় পরিষদের সদস্যা, পশ্চিমবঙ্গ মহিলা সমিতির সহ-সভানেত্রী, পশ্চিমবঙ্গ স্পোর্টস কাউন্সিলের স্ট্যাডিং কমিটির সদস্যা এবং কলিকাতা ও অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রগতিশীল আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত থাকেন। ১৯৬২, ’৭০ ও ’৭৮-এ পশ্চিমবঙ্গের নানা আন্দোলনে যোগ দিয়ে কারাবরণ করেন। সুলেখিকা কমরেড ইলা মিত্র ‘হিরোশিমার মেয়ে’ অনুবাদ করে সোভিয়েত ল্যান্ড নেহেরু পুরস্কার লাভ করেন। তাঁর অনুবাদগ্রন্থ জেলখানার চিঠি, মনেপ্রাণে (দু’খন্ড), লেনিনের জীবনী ও রাশিয়ার ছোটগল্প পাঠক সমাজে আদৃত। তাঁর দৃঢ়তা অতুলনীয়। মানবতাবোধ ও বিরামহীন কর্মতৎপরতার জন্য নতুন প্রজন্মের কাছে তিনি ছিলেন আদর্শ। তিনি বীরাঙ্গনারূপে কৃষক আন্দোলনের ইতিহাসে স্মরণীয়।

ইলা মিত্রের জবানবন্দি:

‘আমার বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগ সম্পর্কে আমার বক্তব্য হচ্ছে, আমি সম্পূর্ণ নির্দোষ এবং আমি এই মামলার ব্যাপারে কিছুই জানি না। গত ৭-১০-৫০ তারিখে আমাকে বোরহানপুরে গ্রেফতার করা হয় এবং পরদিন আমাকে নাঁচল থানা হেড কোয়ার্টারে পাঠানো হয়। কিন্তু পাহারাদার পুলিশরা আমার ওপর অত্যাচার করে। নাঁচল পুলিশ আমাকে একটা সেলের মধ্যে রাখে। সেখানে একজন পুলিশ কর্মকর্তা আমাকে এ মর্মে ভীতি প্রদর্শন করে যে, হত্যাকান্ড সম্পর্কে আমি সম্পূর্ণ স্বীকারোক্তি না করলে ওরা আমাকে উলঙ্গ করবে। জবাবে বললাম, এ ব্যাপারে আমি কিছুই জানি না। এটুকু বলার সঙ্গে সঙ্গে পুলিশ আমার পরনের সমস্ত কাপড় খুলে নিল এবং আমাকে সম্পূর্ণ উলঙ্গ অবস্থায় থানার হাজতে আটকে রাখল। আমাকে কোন খাবার দেয়া হয়নি, এমনকি এক ফোঁটা পানি পর্যন্তও না। একদিন সন্ধ্যায় স্বীকারোক্তি আদায়ের জন্য সিপাহীরা এসে বন্দুকের কুঁদা দিয়ে আমার মাথায় আঘাত করতে শুরু করে এবং পুলিশের সেই দারোগার সামনে আমার নাক দিয়ে রক্ত পড়তে থাকে। এরপর ওরা আমার পরনের কাপড় ফেরত দেয়। রাত প্রায় ১২টার দিকে আমাকে সেল (হাজত) থেকে বের করা হয় এবং আমাকে সম্ভবত পুলিশের দারোগার বাসায় নিয়ে যাওয়া হয়। অবশ্য এ ব্যাপারে আমি নিশ্চিত নই।’
‘আমাকে যে কামরায় নিয়ে যাওয়া হয়, সেখানে আমার স্বীকারোক্তি আদায়ের জন্য ওরা নৃশংস ধরনের পন্থা অবলম্বন করে। আমার চারপাশে দাঁড়িয়ে ওরা আমার পা দু’টাকে লাঠির মধ্যে রেখে ক্রমাগতভাবে চাপ দিতে শুরু করে। ওদের ভাষায় আমার বিরুদ্ধে ‘পাকিস্তানী ইনজেকমন’ পন্থায় ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছিল। এই ধরনের অত্যাচার চলার সময় ওরা রুমাল দিয়ে আমার মুখ বেঁধে রেখেছিল এবং আমার চুল ধরেও টান দিচ্ছিল। কিন্তু আমাকে দিয়ে জোরপূর্বক কিছুই বলাতে সক্ষম হয়নি। এতসব অত্যাচারের দরুণ আমার পক্ষে আর হেঁটে যাওয়া সম্ভব না হওয়ায় ওরা আমাকে ধরাধরি করে সেলে নিয়ে গেল। এবার পুলিশের সেই দারোগা সিপাহীদের ৪টা গরম ডিম আনার নির্দেশ দিয়ে বলল যে, এবার মেয়েটাকে কথা বলতেই হবে। এবার শুরু হলো নতুন ধরনের অত্যাচার। ৪/৫ জন সিপাহী মিলে জোর করে আমাকে চিৎ করে শুতে বাধ্য করল এবং তাদের একজন আমার গোপন অঙ্গ দিয়ে একটা গরম ডিম ভিতরে ঢুকিয়ে দিল। সে এক ভয়াবহ জ্বালা। প্রতি মুহূর্তে অনুভব করলাম, আমার দেহের ভিতরটা আগুন দিয়ে পুড়ে যাচ্ছিল। আমি জ্ঞান হারিয়ে ফেললাম। ১৯৫০ সালের ৯ ফেব্রুয়ারি সকালে জ্ঞান ফিরে এলো। একটু পরে জনাকয়েক পুলিশ সঙ্গে করে আমার আবার সেই দারোগার আগমন হলো। সেলে ঢুকেই সে আমার তলপেটে বুট দিয়ে প্রচন্ড জোরে লাথি মারল। আমি দারুণ ব্যথায় কুঁকড়ে গেলাম। এরপর ওরা জোর করে আমার ডান পায়ের গোড়ালিতে একটা লোহার পেরেক ঢুকিয়ে দিল। আমি তখন অর্ধ-চৈতন্য অবস্থা মেঝেতে পড়ে রয়েছি। কোনরকম স্বীকারোক্তি না পেয়ে দারোগা তখন রাগে অগ্নিশর্মা। যাওয়ার আগে বলে গেল, “আমরা আবার রাতে আসব। তখন তুমি স্বীকারোক্তি না দিলে একের পর এক সিপাহী তোমাকে ধর্ষণ করবে।”

‘গভীর রাতে ঐ দারোগা আর সিপাহীরা আবার এলো এবং আমাকে হুমকি দিল স্বীকারোক্তি দেয়ার জন্য। কিন্তু আমি তখনও কিছু বলতে অস্বীকার করলাম। এবার ৩/৪ জন মিলে আমাকে মেঝেতে ফেলে ধরে রাখল এবং একজন সিপাহী আমাকে রীতিমতো ধর্ষণ করতে শুরু করল। অল্পক্ষণের মধ্যেই আমি সংজ্ঞা হারিয়ে ফেললাম।’

‘পরদিন ১০-১-৫০ তারিখে যখন আমার জ্ঞান ফিরে এলো তখন দারুণভাবে রক্তক্ষরণ হচ্ছিল এবং আমার কাপড়-চোপড় ছিল রক্তে ভেজা। এই অবস্থাতেই আমাকে নাঁচল থেকে মহকুমা সদর চাঁপাইনবাবগঞ্জে নিয়ে যাওয়া হলো। এখানে জেলের সিপাহীরা জেল গেটেই আমাকে কিল-ঘুষি মেরে অভ্যর্থনা জানালো। আমার শারীরিক অবস্থা তখন খুবই শোচনীয়। কোর্ট ইন্সপেক্টর এবং জনা কয়েক সিপাহী মিলে আমাকে ধরাধরি করে একটা সেলে নিয়ে এলো। তখনও আমার রক্তক্ষরণ হচ্ছিল এবং শরীরে প্রচন্ড জ্বর। সম্ভবত সরকারী হাসপাতালের একজন ডাক্তার আমার দেহের তাপমাত্রা পরীক্ষা করে ১০৫ ডিগ্রী নোট করলেন। তখন ডাক্তার জানতে পারলেন যে, আমার দারুণভাবে রক্তক্ষরণ হয়েছে, তখন তিনি আমাকে এ মর্মে আশ্বাস দিলেন যে, শুশ্রুভার জন্য একজন মহিলা নার্স পাঠানো হবে। তিনি কিছু ওষুধ দেয়া ছাড়াও দুটো কম্বলের ব্যবস্থা করে দিয়েছিলেন।’

২০০২ সালের ১৩ অক্টোবর কিংবদন্তি মহান এই বিপ্লবীর মৃত্যু হয়।

সুপ্রিয় পাঠক, তেভাগা আন্দোলনের কিংবদন্তি বিপ্লবী কমরেড ইলা মিত্রের ২১তম প্রয়াণ দিবসকে উপলক্ষ করে এই নিবন্ধটি লেখা হলেও মহান, কৃতিমান মানুষদের নিয়ে সব সময়ই লেখা যায়। পরিশেষে, সমাজতন্ত্র অভিমুখী অসাম্প্রদায়িক জনগণতান্ত্রিক ও বৈষম্যহীন ব্যবস্থা গড়ে তোলার প্রত্যয়ে সমতা-ন্যায্যতার প্রশ্নে বাংলাদেশকে এগিয়ে নেওয়ার প্রয়োজনেই বিশ্বজনীন মহান এই গুণীর রাজনীতি, আত্মোৎসর্গ, জীবন সংগ্রাম, কীর্তি, ইতিহাস, তত্ত্ব ও অনুশীলন সম্পর্কে পাঠ প্রাসঙ্গিক ও জরুরী। বিপ্লবী কমরেড ইলা মিত্রের প্রতি আমাদের বিনম্র শ্রদ্ধা ও অভিবাদন!

-লেখক: মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক গবেষক, সাংবাদিক ও কলামিস্ট।